Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
সাওগ্রামে লাঠি কেন্দ্রীয় বাহিনীর

বুথে যেতে ভয়, ঘরেই জরিনা

২০১০ সালের পর থেকে মনিরুল ইসলাম এবং তাঁর অনুগামীদের ভয়ে গ্রামছাড়া জরিনা বিবিরা। ওই বছরেই বালির ঘাট নিয়ে মীমাংসার জন্যে সালিশি সভার নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে জরিনা বিবির তিন ছেলেকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে মনিরুল ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে।

লাভপুরের সাওগ্রামে গণ্ডগোলের পরে জনতার জটলা। রবিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

লাভপুরের সাওগ্রামে গণ্ডগোলের পরে জনতার জটলা। রবিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৫
Share: Save:

বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বুথ। অথচ এ বারও সেই বুথে পৌঁছতে পারলেন না জরিনা বিবি এবং তাঁর পরিবার। দেওয়া হল না ভোটও।

২০১০ সালের পর থেকে মনিরুল ইসলাম এবং তাঁর অনুগামীদের ভয়ে গ্রামছাড়া জরিনা বিবিরা। ওই বছরেই বালির ঘাট নিয়ে মীমাংসার জন্যে সালিশি সভার নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে জরিনা বিবির তিন ছেলেকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে মনিরুল ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তেরা কখনই সে দাবি মানতে চায়নি। ঘটনা হল, তারপর থেকে গ্রামছাড়া পরিবার। আর এ দিকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্যে ঘরে ফেরার আর্জি জানান জরিনা বিবিরা। এ বারও অন্যথা হয়নি।

কিন্তু, প্রশাসন তাঁদের নিরাপত্তা দিয়ে গ্রামে ফেরানোর কোনও ব্যবস্থাই করেনি বলে অভিযোগ। বর্তমানে জরিনা রয়েছেন মুর্শিদাবাদে তাঁর এক ছেলের কাছে। রবিবার সেখান থেকে ফোনে তিনি বলেন, ‘‘ভোটের অনেক আগেই নিরাপত্তা দিয়ে গ্রামে ফেরানোর আর্জি রেখেছিল ছেলে আনারুল। শনিবারও সে একই দাবি নিয়ে লাভপুরের বিডিও-র কাছে গিয়েছিল। কিন্তু, বিডিও কোনও ব্যবস্থা করেননি। ফলে এ বারও আমাদের ভোট দেওয়া হল না।’’ লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি।

লাভপুরের দারকা পঞ্চায়েতের পাশাপাশি দু’টি গ্রাম নবগ্রাম, বুনিয়াডাঙা। নবগ্রামে বাড়ি মনিরুলের। বুনিয়াডাঙায় জরিনাবিবি ও তাঁর ছেলেদের। বুনিয়াডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০৮ নম্বর বুথে নাম রয়েছে জরিনা বিবির পরিবারের ৫২ জন সদস্য এবং মনিরুল ইসলামের পরিবারের। এ দিন সাড়ে দশটা নাগাদ ওই বুথে দুই ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ভোট দেন মনিরুল। ভোটকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দাবি করেন, ‘‘কোথাও অশান্তি নেই। সন্ত্রাসের পরিবেশের তো প্রশ্নই নেই। তবু সংবাদমাধ্যমের একাংশ অপপ্রচার করছে।’’ মনিরুল যাই বলুন না কেন, ‘শান্তি’র অন্য ছবি দেখা গেল ওই বুথেই। বুথেই এজেন্ট ছিলেন সিপিএমের নিশারউদ্দিন শেখ। সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, নিশারকে ভয় দেখিয়ে বুথ ছাড়তে বাধ্য করেছে মনিরুল বাহিনী। ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সামশের মুরশিদ জানান, সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে খেয়ে আসছি বলে ওই এজেন্ট আর ফেরেননি। সিপিএমের অভিযোগ, সেই সুযোগে অবাধে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল।

নব গ্রামের ১১৩ নম্বর বুথেও দেখা মেলেনি সিপিএমের পোলিং এজেন্টের। জানলা দিয়ে দেখা গিয়েছে, এক যুবক হাতে ধরে নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়াচ্ছেন এক মহিলাকে। সে দিকে ক্যামেরা তাক করতেই কার্যত রে রে করে ছুটে আসেন কয়েক জন যুবক। দাবি করেন, ‘‘এখানে শান্তিতে ভোট হচ্ছে। বদনাম না করে অন্য কোথাও যান!’’

দারকা পঞ্চায়েতেরই দরবারপুর গ্রামের ১০৪ নম্বর বুথে গিয়ে দেখা গেল পাশাপাশি বসে রয়েছেন সিপিএমের এজেন্ট শেখ শের মহম্মদ এবং তৃণমূলের এজেন্ট ফরিদ হোসেন। পাশাপাশি প্রিসাইডিং অফিসার সৌমেন রায়ের পাশে ঠায় চেয়ারে বসে কে, কোথায় ভোট দিচ্ছে সে নজরদারি করতে দেখা গেল সোয়েব আলি নামে মাঝ বয়সের এক ব্যক্তিকে। পরিচয় জানতে চাইতেই সোয়েব জানান, তিনি তৃণমূলের দ্বিতীয় এজেন্ট। কিন্তু, একসঙ্গে দু’জন বুথে কেন? সেটা কি বৈধ? প্রশ্নের মুখে প্রিসাইডিং অফিসার কবুল করেন, ‘‘না।’’ তা হলে থাকতে দিয়েছেন কেন? উত্তর দেননি তিনি। এ দিকে, সোয়েবকে ক্যামেরা বন্দি করতেই বুথ ছাড়েন তিনি।

দারকা গ্রামের ১০৭ নম্বর বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা সংবাদমাধ্যমকে ঢুকতে দেয়নি। বৈধ পরিচয় পত্র থাকার পরেও। অথচ গেটের মুখ থেকেই দেখা যাচ্ছিল বুথের সামনে ভোটার ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু লোক। এরপরেই লাভপুর ২ নম্বর পঞ্চায়েতের আলাস গ্রামে গিয়ে দেখা গেল অন্য এক ছবি। উজ্জ্বল গড়াই নামে এক তৃণমূল কর্মী বুথে আসা ভোটারদের নকল ইভিএম মেশিনে মনিরুলকে ভোট দেওয়ার কথা প্রকাশ্যেই বলছিলেন। স্থানীয় সিপিএম কর্মী বাবলু মেটে জানান, সকাল থেকেই তৃণমূলের কর্মীরা এ ভাবে বিধি ভেঙে প্রচার করছিল। নিষেধ সত্বেও কানে তোলেনি। এমনকী গ্রামে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে জানিয়েও লাভ হয়নি।

এ দিন লাভপুর এলাকায় সবথেকে বড় ঘটনাটি ঘটে দারকা পঞ্চায়েতের সাও গ্রামে। ওই গ্রামটি মনিরুলের খাসতালুক নামে পরিচিত। এলাকার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মনিরুলের ডান হাত হিসেবে পরিচিত লখরিদ শেখ। তিনি আবার সাও গ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১১৬ এবং ১১৭ নম্বর বুথের নির্বাচনী এজেন্টও। সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, লখরিদের নেতৃত্বে তৃণমূলের লোকেরা ব্যাপক ছাপ্পা দিতে শুরু করেছিল। সিপিএমের স্থানীয় লোকেরা প্রতিবাদ করে। অভিযোগ, তারপরেই টহলরত কেন্দ্রীয় বাহিনী তৃণমূলকে হঠাতে চাঠিচার্জ শুরু করে।

কেন্দ্রীয় বাহিনীকে রুখতে তৃণমূল নেতৃত্ব গ্রামের মহিলাদের এগিয়ে দেন বলেও অভিযোগ। মহিলারা বুথ লক্ষ্য করে ইট, পাথর ছুড়তে শুরু করে। তাতে পুলিশের একটি গাড়ির কাচ ভাঙে বলে খবর। গ্রামের তৃণমূল কর্মীদের হাতে কিছুক্ষণ কার্যত ঘেরাও থাকেন জনা দশেক জওয়ান। তার জেরে ১১টা ৩০ থেকে ১ টা ২০ পর্যন্ত দুই বুথে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে। সে খবর পেয়ে এলাকায় পৌঁছয় আরও কেন্দ্রীয় বাহিনী-সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী। অভিযোগ, লাঠিচার্জ করে জওয়ানদের মুক্ত করা হয়। রবিবার বেলা একটা নাগাদ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে গ্রামবাসী। তাঁদের অনেকের অভিযোগ, জওয়ানেরা আক্রোশ মেটাতে বহু নিরীহ গ্রামবাসীকে লাঠিপেটা করেছে। রেয়াত করেনি এক প্রতিবন্ধীকেও। পুলিশ সূত্রের খবর, প্রায় ১০ জনকে লাভপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। গোটা ঘটনায় মনিরুলের বক্তব্য, ‘‘দলের লোকেরা এক জায়গায় বসেছিল। জওয়ানেরা সেটাকে জটলা ভেবে ভুল করে। তাই ভুল বুঝে লাঠি চালায়। তারপরেই গ্রামের লোকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।’’ তারই জেরে ইট-পাটকেল ছোড়ার ঘটনা বলে দাবি এলাকার তৃণমূল প্রার্থীর।

সিপিএমের জোনাল কমিটির সম্পাদক মানিক মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাসের দল দারকা পঞ্চায়েতের এবং ঠিবা পঞ্চায়েতের তিনটি বুথে এজেন্ট দিয়েও বসিয়ে রাখতে পারিনি। তৃণমূলের লোকেরা এই এলাকায় অবাধে ছাপ্পা চালিয়েছে। জওয়ান, নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও সুরুহা হয়নি।’’ এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি মনিরুল ইসলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 terror
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE