Advertisement
১১ মে ২০২৪

বাঙালি ভোট হারিয়েও ক্ষতি অগপর

এক সময় রাজ্যের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দল। সরকারও গড়েছে তারা। দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনের পথ পেরিয়ে সোজা রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছানো সেই অসম গণ পরিষদ আপাতত জাতীয় দলগুলির করুণা-নির্ভর।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৬ ০৪:১০
Share: Save:

এক সময় রাজ্যের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দল। সরকারও গড়েছে তারা। দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনের পথ পেরিয়ে সোজা রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছানো সেই অসম গণ পরিষদ আপাতত জাতীয় দলগুলির করুণা-নির্ভর।

পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে আঞ্চলিক দলের উত্থান ঘটছে, ক্ষমতা দখল করছে তারা, সেখানেই একেবারে বিপরীত ছবি অসমে। এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৩০টি আসনে লড়ছে অতুল বরা, প্রফুল্ল মহন্তর দল।

রাজ্যে অগপর পতনের আরও এক বড় কারণ, বরাক উপত্যকার ২০ লক্ষাধিক ভোট হাতের বাইরে থেকে যাওয়া। বাঙালি বিরোধী দলের পরিচিতি এখনও অগপকে তাড়া করে। যখন প্রফুল্ল মহন্ত প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন তখন শহিদুল আলম চৌধুরি আলগাপুরের বিধায়ক হন। ২০১১ সালের নির্বাচনেও অগপ থেকে একমাত্র বিধায়ক ছিলেন তিনিই। প্রথম বার আনোয়ার হুসেনও অগপ বিধায়ক হন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের জনসমর্থনে জেতেন। এমনকী স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলির মতে, এ বার অগপ বিজেপির হাত ধরায় বিজেপি সম্পর্কে লোকসভা ভোটের জনপ্রিয়তার হাওয়াও স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। বরাক উপত্যাক বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ দে বলেন, ‘‘বরাকের মতোই ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিরাও এখনও অগপকে বিদ্বেষের চোখে দেখন। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদেরও ভয় অগপকে। বাংলাভাষী মুসলিমদের আতঙ্ক আরও বেশি। বাঙালি ও সংখ্যালঘুদের বড় অংশ মিলিয়ে ৩৫ শতাংশ ভোট চলে গেলে আঞ্চলিক দলের টিঁকে থাকা মুশকিল হবেই।’’

অসম আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি থেকেই অগপর জন্ম। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা প্রফুল্ল মহন্ত ছাত্রাবাস থেকে দিসপুরে শপথ নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম দফায় সরকার চালানোর সময়ই একদিকে অনভিজ্ঞতা ও অন্য দিকে নেতাদের স্বার্থের সঙ্ঘাতে দলে ভাঙন ধরে। ১৯৯১ সালে ভৃগুকুমার ফুকন, দীনেশ গোস্বামী, বৃন্দাবন গোস্বামী, পুলকেশ বরুয়ারা মূল অগপ ছেড়ে ‘নতুন অসম গণ পরিষদ’ গঠন করেন। সে বার ১২১টি আসনে লড়ে অগপ মাত্র ১৯টিতে জেতে। নতুন দল ৮৫টি আসনে লড়ে জেতে ৫টিতে।

দলের বর্তমান নেতাদের মতে, আঞ্চলিক ভোটব্যাঙ্ক ভাগ হয়ে যাওয়ার সেই ধাক্কাই দলের কফিনে প্রথম পেরেক পুঁতে দেয়। বিভাজনের ক্ষতি বুঝে ১৯৯৬ সালে ফের একজোট হয় দল। বামদের সাহায্য নিয়ে ইউপিপিএ জোট আবার ক্ষমতায় আসে। ২০০০ সালে অতুল বরা ও পুলকেশ বরুয়ারা দল ছেড়ে ‘তৃণমূল গণ পরিষদ’ তৈরি করেন। ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে বামদলগুলির সঙ্গত্যাগ করে অগপ বিজেপির হাত ধরে। অগপ ৭৭টি আসনে লড়ে মাত্র ২০টি ও বিজেপি ৪৬টি আসনে লড়ে ৮টি আসন পায়। তখন থেকে রাজ্যের ক্ষমতা ফের কংগ্রেসের হাতে।

২০০৫ সালে দলবিরোধী কাজ ও গুপ্তহত্যায় মদতের অভিযোগে অসম গণ পরিষদ দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তের সভাপতি পদ কেড়ে নেয়। তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। তিনি ‘প্রগতিশীল অসম গণ পরিষদ’ গঠন করেন। ২০০৮ সালের অক্টোবরে গোলাঘাট সম্মেলনে অতুল বরা, পুলকেশ বরুয়া, প্রফুল্ল মহন্তরা ফের মূল অগপ-য় ফিরে আসেন।

২০১১ সালের নির্বাচনে ১০৪টি আসনে জিতে অগপর ঝুলিতে আসে ১০ জন বিধায়ক। বিজেপির হাতে মাত্র ৫ জন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৭টি আসন পেলেও অগপ একটিও কেন্দ্রে জিততে পারেনি। ফলে অস্তিত্ব বাঁচাতে এ বার বিজেপির সামনে নতজানু হয়ে, তাদের শরিক হিসেবে জোট করতে বাধ্য হন অতুল বরা, প্রফুল্ল মহন্তরা।

দলের এই পতনের জন্য প্রফুল্ল মহন্তর স্বৈরাতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিকে দায়ী করেছেন বর্তমান ও প্রাক্তন একাধিক অগপ নেতা, বিধায়ক। সেই সঙ্গে অনভিজ্ঞতার কারণে উন্নয়নে ব্যর্থ হওয়া, সরকারি কর্মীদের বেতন দিতে না পারা, স্বজনপোষণ করতে গিয়ে রাজকোষ খালি করে ফেলাকেও অগপর পতনের কারণ বলে ধরা হয়। অগপ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া নেতা অপূ্র্ব ভট্টাচার্যের মতে, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেই অগপতে রাশ ধরার কেউ ছিল না। মহন্ত নিজের মত অনুযায়ী কাজ করতেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতি কোনও দিনই অগপয় ছিল না। সেই সঙ্গে ছিল না দুরদর্শিতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা।

মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের মতে, জাতীয় দল কেন্দ্রের সাহায্য আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যে ভাবে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে, শুধুমাত্র আঞ্চলিকতাবাদের আদর্শ সামনে রেখে চলা দলের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে অসম আন্দোলনের জেরে রাজ্যের মোট ভোটের প্রায় ২৫ শতাংশ বাঙালি ভোট থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে অগপ। আঞ্চলিক দল হলেও ২৫টির বেশি জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করার মতো ক্ষমতা মহন্তদের ছিল না।

২০১১ সালে অগপ ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন সর্বানন্দ সোনোয়াল। তিনিও তোপ দাগেন প্রফুল্ল মহন্তর বিরুদ্ধে। সর্বানন্দের মতে, মহন্ত নিজের ইচ্ছামতো এআইইউডিএফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিলেন। যে আসু থেকে অগপর জন্ম, সেই আসুর সঙ্গে দলের দুরত্ব বাড়ছিল। দলত্যাগী বেশির ভাগ নেতার অভিযোগের তীর যাঁর দিকে সেই মহন্ত এখন নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত। এই প্রশ্নের কোনও জবাব তিনি দেননি। সমাজবাদী পার্টির রাজ্য সভাপতি তথা নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির মুখ্য উপদেষ্টা নেতা হাফিজ রশিদ চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, প্রফুল্ল মহন্তর মতো সর্বজনগ্রাহ্য নেতাকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়া ও নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার ফলেই অগপ আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘‘অতুল বরা এখন দলের সভাপতি হলেও তিনি একেবারেই স্থানীয় নেতা। মহন্তর মতো ধার বা ভার তাঁর নেই।’’

অগপ নেতাদের মতে, দলের মধ্যে বার বার বিভাজন অগপর ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল। অগপতে মহন্ত বনাম অন্য নেতাদের স্বার্থের সংঘাত এ বারের জোটের লড়াইতেও বর্তমান। মহন্ত জোট চান না বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন। দল চালাতে গেলে যে পরিমাণ তহবিলের প্রয়োজন তাও নেই। দলের সভাপতি অতুল বরা মেনে নেন, ‘‘বিভিন্ন কারণে আমরা এখন দুর্বল হয়ে পড়েছি। তাই বিজেপির হাত ধরে লড়া ভিন্ন উপায় ছিল না।’’ সব মিলিয়ে দলের যা অবস্থা, তাতে এ বারের ভোটে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে রাজ্যে আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে একসময়ের শাসক দল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 asom gana parishad trouble
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE