দুই মেয়ের সঙ্গে ফিরহাদ হাকিম। খিদিরপুরে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
মাঝখানে মাত্র দু’তিন হাতের ব্যবধান। এক জনকে ঘিরে সবুজ আবির মাখা ভিড়ের বলয়। মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি। অন্য জনের পাশে ভিড় পাতলা হতে হতে ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়ার অবস্থা। পরস্পরকে দেখে কয়েক মুহূর্ত থমকালেন। থমকাল জনতাও। স্লোগান থেমে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে সামান্য গুঞ্জন শুরু হল। শক্ত হয়ে উঠল সমর্থকদের চোয়াল। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্য। দ্রুতই নিজেদের সামলে নিলেন তাঁরা।
প্রথম জন কলকাতা বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রের জয়ী তৃণমূল প্রার্থী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। অন্য জন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, জোট প্রার্থী রাকেশ সিংহ।
খিদিরপুরের সেন্ট টমাস স্কুলের গণনা কেন্দ্রে ববির সামনে যখন ক্যামেরার আলোর ঝলকানি, তখন একলা দাঁড়িয়ে থাকা রাকেশ বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘‘মানুষ যদি ওঁকে বেছে নেয়, তা হলে আর আমার কী বলার থাকতে পারে?’’
জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলবেন না? রাকেশ ঘাড় নেড়ে ‘না’ বললেন। ভিড়ের ফাঁক গলে এক বার হাত নাড়লেন ববিকে। পাল্টা হাত নাড়েন ববিও। ফলপ্রকাশের পরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর যোগাযোগ সীমাবদ্ধ থাকে এইটুকুতেই।
নারদ-কাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম নাম ছিল ববি হাকিমের। তাই এ বারের নির্বাচনে রাজ্যের যে ক’জন হেভিওয়েট প্রার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহ ছিল বিভিন্ন মহলে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনিই। ববি-ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, তাঁর নিজেরও এ নিয়ে টেনশন কিছু কম ছিল না। আদৌ জিতবেন কি না, জিতলে ব্যবধান কত হবে, সে নিয়ে চর্চা চালিয়েছেন বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত। এ দিন সকাল থেকে গণনা কেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে হাজির ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে। বেলা ১২টা নাগাদ ববি নিজে ঢোকেন গণনাকেন্দ্রে।
ভোটের ঠিক আগেই নারদ-কাণ্ডে যে ভাবে তাঁর নাম জড়িয়েছিল, তাতে কি মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ততা সম্পর্কে তিনি নিজেও নিশ্চিত ছিলেন? এই প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে এক গাল হেসে লম্বা একটা শ্বাস ফেলেছেন তিনি। বস্তুত, এ দিন গোটা বন্দর এলাকায় তাঁর অনুগামীরাই যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা প্রথমে নিজেদের ঘর থেকে বেরোননি। সকাল ন’টার পরে ফল যে তাঁদের পক্ষেই যেতে চলেছে, সে সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বেরোন তাঁরা। গার্ডেনরিচের ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রঞ্জিত শীল, ১৩৫ নম্বরের শাম্স ইকবাল বা ১৩৬ নম্বরের সামসুজ্জামান আনসারিরা ১০টার পরে দলীয় অফিসে গিয়ে বসতেই দলের কর্মীরা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। শুরু হয় আবির খেলা, মিছিল, কান ফাটানো স্লোগান আর বাজি ফাটানোর পর্ব। যদিও চাপের কথা স্বীকার না করে মুখে সামসুজ্জামান বলেছেন, ‘‘জয় নিশ্চিত ছিল জানতাম। তাই পাঁচ হাজার বাক্স বিরিয়ানি অর্ডার দেওয়া আছে।’’ রঞ্জিত শীলের দাবি, ‘‘আগেই চার হাজার লাড্ডু আর এক হাজার সবুজ রসগোল্লা অর্ডার দিয়েছিলাম। বাড়ি বাড়ি বিলি করব।’’
শাম্স ইকবালের বাবা, হরিমোহন ঘোষ কলেজে পুলিশকর্মী খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নারও বাড়িতে টিভির পর্দায় চোখ ছিল। ফল সম্পর্কে নিশ্চিত হতেই ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ববির কাছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর ছেলেই ছিলেন ববির ছায়াসঙ্গী।
গত বার তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল ২৫ হাজারের কিছু বেশি। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৫৪৮। এতটা কি তিনি নিজেও আশা করেছিলেন? উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে ববি বলেন, ‘‘মানুষ যখন দেন, তখন এ ভাবেই উজাড় করে দেন। তাঁরা প্রমাণ করে দিলেন, কোনও কুৎসা বা অপপ্রচার নয়, তাঁরা আমাদের কাজটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।’’
সকালে গণণা কেন্দ্রে সমর্থকদের নিয়ে হাজির ছিলেন আত্মবিশ্বাসী রাকেশ। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমর্থকদের আর দেখা মেলেনি। দেখা মেলেনি এলাকার সিপিএম বা কংগ্রেস নেতাদেরও। ১২টা বাজার আগেই খিদিরপুরের দাপুটে সিপিএম নেতা ফৈয়াজ খান দলবল নিয়ে পার্টি অফিসে ঢুকে যান। কিন্তু এলাকার কংগ্রেসকর্মীরা রাতারাতি কোথায় উধাও হলেন? কংগ্রেস নেতা, তথা জোটপ্রার্থী রাকেশের জবাব, ‘‘গার্ডেনরিচের দায়িত্ব কংগ্রেস নেতা মহম্মদ মোক্তারকে দেওয়া হয়েছিল, তিনি পিছন থেকে ছুরি মেরেছেন। আর যে ওয়ার্ডটা (৭৫) সিপিএমের, সেখানেই ১৪০০ ভোটে হারলাম। এটাই আমার আফসোসের জায়গা।’’ এর পাল্টা মোক্তারের জবাব, ‘‘হেরে গিয়ে ভুলভাল বকছে।’’
রাতারাতি জোটের চেহারাটা কি বেআব্রু হয়ে পড়ছে? ববির মন্তব্য ‘‘জোট পুরো ফোট হয়ে গিয়েছে। একে-তাকে ধরে কি আর ক্ষমতায় আসা যায়?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy