Advertisement
১১ মে ২০২৪

ছেলেটা মরে যাবে কিছু করুন, আর্জি বাবার

হাত জড়ো করে পুলিশের কাছে অনুনয়-বিনয় করছিলেন ছেলের বাবা। বলছিলেন, ‘‘আমাদের অ্যাম্বুল্যান্সটা পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন স্যার। ছেলেটার অবস্থা খারাপ। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারলে মরেই যাবে।’’

যত দূর চোখ যায় গাড়ির সারি। ডায়মন্ড হারবার স্টেশন রোডের প্রতিদিনের পরিস্থিতি।

যত দূর চোখ যায় গাড়ির সারি। ডায়মন্ড হারবার স্টেশন রোডের প্রতিদিনের পরিস্থিতি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৬ ০১:১৫
Share: Save:

হাত জড়ো করে পুলিশের কাছে অনুনয়-বিনয় করছিলেন ছেলের বাবা। বলছিলেন, ‘‘আমাদের অ্যাম্বুল্যান্সটা পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন স্যার। ছেলেটার অবস্থা খারাপ। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারলে মরেই যাবে।’’

‘স্যার’-এর তখন ঢের কাজ। অসহায় বাবার কথায় কান দেওয়ার অবকাশ কোথায়!

তিনি তাই স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে ছেলের বাবাকে দিলেন চার কথা শুনিয়ে। পরামর্শ দিলেন, বাইপাস ধরে বেরিয়ে যেতে হাসপাতালের পথে। কিন্তু ডায়মন্ড হারবার স্টেশন রোডের যানজটের হাত থেকে রেহাই পেতে তেমন কোনও বাইপাস যে আদৌ নেই, তা হয় তো জানাই ছিল না কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মীটির।

শেষমেশ, যানজটে মিনিট কুড়ি আটকা পড়ে যখন মাস চারেকের শুভঙ্করকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছল ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালে, ততক্ষণে সব শেষ। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, পথেই মারা গিয়েছে শিশুটি।

সোমবার বিকেলে ঘটনায় তুমুল উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় মানুষজন। মিনিট কুড়ি অবরোধ চলার পরে লাঠি উঁচিয়ে অবরোধ হঠিয়ে দেয় পুলিশ।


তখনও অ্যাম্বুল্যান্সে আটকে (বাঁ দিকে)। পুলিশের সঙ্গে চলছে ধস্তাধস্তি (ডান দিকে)।

তারপরেও যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। হবেই বা কী করে! সারা বছর দিনরাতের বেশির ভাগ সময় এমনই যানজটের কবলে ফেঁসে থাকে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ডায়মন্ড হারবার স্টেশন রোড। কান্নায় ভেঙে পড়ে শুভঙ্করের বাবা মদন মিস্ত্রি বললেন, ‘‘যানজটের মধ্যে গাড়ি একটুও এগোচ্ছিল না। অথচ, ছেলেটার অবস্থা চোখের সামনে খারাপ হচ্ছিল। গোঙাচ্ছিল। আমি হাত জো়ড় করে অনুরোধ করি পুলিশ কর্মীর কাছে। কিন্তু আমার কথায় কান তো দিলেনই না। উল্টে আমাকে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বললেন।’’ তাঁর দাবি, পুলিশকর্মী তাঁকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অন্য রাস্তা ধরারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে অন্য রাস্তা আর কোথায়!

পুলিশ কর্মীর কাছে অনুরোধ রেখেছিলেন অ্যাম্বুল্যান্সের চালক প্রসেনজিৎ মণ্ডলও। বলেছিলেন, ‘‘স্যার, একটু জায়গা বের করে দিন। বাচ্চাটার অবস্থা মনে হয় খারাপ।’’

জানা গেল, পুলিশ কর্মীটি নাকি মারের ভয় দেখিয়ে চুপ থাকতে বলেন অ্যাম্বুল্যান্স চালককে। বলেন, সাইরেন বন্ধ করে অপেক্ষা করতে।

সেই অপেক্ষারই খেসারত দিতে হল চার মাসের শুভঙ্করকে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ঢোলাহাটের সাঙ্গিবেড়িয়া গ্রামের মদনবাবুর ছেলের জ্বর হয়েছিল। বেলা ৪টে ১০ নাগাদ ডায়মন্ড হারবার স্টেশন মোড়ে ঢোকার মুখেই অ্যাম্বুল্যান্সটি লম্বা যানজটে আটকে পড়ে। পরে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি বাধে উত্তেজিত জনতার।

কী বলছেন পুলিশ কর্তারা?

জেলা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘যতদূর জানি, শিশুটি আগেই মারা গিয়েছিল। যানজটের জন্য সমস্যা হয়নি।’’ তিনি জানান, যানজট কাটানোরই চেষ্টা করা হচ্ছিল। কাউকে কোনও ধমকধামক দেওয়া হয়নি।

যানজটের সমস্যা অবশ্য এই রাস্তায় নতুন নয়। লোকজনের খানিক গা সওয়াও হয়ে গিয়েছে। অফিস টাইমে বা দিনের ব্যস্ততম সময়েও এই সামান্য পথটুকু পেরোতে ঘণ্টাখানেকও লেগে যায় এক এক সময়। ফাঁকা থাকলে যা পেরোতে সাইকেলে মিনিট দ’শেকের বেশি লাগার কথাই নয়। এক পাশে ফুটপাথ দখল করে গজিয়ে উঠেছে সারি সারি ফলের দোকান। অন্য পাশে দোকানপাট সাজিয়ে বসেছেন হকারেরা। পিছনে মূল দোকানপাট তো আছেই। স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড এখনও গড়ে ওঠেনি শহরে। অটো, ম্যাজিক গাড়ি, টোটো, ইঞ্জিন ভ্যানের দাপাদাপি তো আছেই। সে সবও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার দু’ধারে। ইচ্ছে মতো যতক্ষণ খুশি দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস দশা রাস্তার।

ট্রেন ঢুকলে রাস্তায় ভিড় আরও বাড়ে। গরমে কাহিল অবস্থা হয় সাধারণ মানুষে। এই রাস্তা দিয়ে স্কুল, কলেজ, অফিস, কাছারিতে যেতে হয় অসংখ্য মানুষকে। ডায়মন্ড হারবার জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। পিকনিকের মরসুমে তো বটেই, সারা বছরই কমবেশি পর্যটকদের ভিড় থাকে। তাঁরাও নাকাল হন যানজটে। জেলা হাসপাতালে ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে। সেখানে নানা দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। সকলকেই দুর্ভোগ পোহাতে হয় এই রাস্তায় চলাফেরা করতে গিয়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা বিকাশ মণ্ডল, অনিমেশ পাত্র, নিখিল দাসরা জানালেন, যানজটে ফেঁসে এর আগেও রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এই রাস্তায়। ক’দিন আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত এক বৃদ্ধকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স বেশ খানিকক্ষণের জন্য আটকে পড়েছিল যানজটে। তাঁকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে বাঁচানো যায়নি।

কিন্তু যানজট কমবে কবে? স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলগুলিরই সদিচ্ছার অভাব আছে। পুরভোটই হোক বা বিধানসভা ভোট— যানজট সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যায় নেতানেত্রীদের মুখে। কিন্তু ভোট মিটলে পরিস্থিতি যে কে সেই!

উপ পুরপ্রধান পান্নালাল হালদার বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। পুলিশকে বলব, যানজট কমাতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে। পুরসভার কাছে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

শহরবাসীর বিস্ময়, এরপরেও অভিযোগ জানাতে হবে? দিনের পর দিন নাকের ডগায় যানজট হলেও তা হলে কি চোখ বুজে পুর কর্তৃপক্ষ?

বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী দীপক হালদার বলেন, ‘‘আমি যতটুকু শুনেছি, হাসপাতালে আনার ঘণ্টা দু’য়েক আগেই মারা গিয়েছিল শিশুটি। যানজটে আটকে পড়ে এই ঘটনা ঘটেছে, তা বলা হয় তো ঠিক নয়। তবে যানজট সমস্যার জন্য এখন ভোটের সময় তো কিছু করা যাবে না। ভোট মিটলে দেখব।’’ সিপিএম প্রার্থী আবুল হাসনাতের কথায়, ‘‘মানুষ বাড়লেও রাস্তা বাড়ছে না। এটা সমস্যা তো বটেই।’’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, শিশুটিকে যখন আনা হয়েছিল, তখন দেহে প্রাণ নেই। তবে কখন সে মারা গিয়েছিল, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট এলে জানা যাবে।’’

ছোট্ট শুভঙ্কর অবশ্য জানতেই পারল না, তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য কার কতটুকু দায়িত্ব ছিল!

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE