Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

হাত আঁকলে হাত কাটব, হুমকি হুমাইপুরে

গ্রামের এক প্রান্তে ভাণ্ডারদহ বিল। পারাপার হচ্ছে নৌকা।‌ নৌকা থেকে নেমে কিছুটা গেলে লালনগর হাইস্কুল। আশপাশে যত দেওয়াল, শুধু জোড়াফুলের পতাকা আর তৃণমূল প্রার্থী নিয়ামত শেখের সবুজ-হলুদ দেওয়াল ‌লিখন।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ০২:৫৩
Share: Save:

গ্রামের এক প্রান্তে ভাণ্ডারদহ বিল। পারাপার হচ্ছে নৌকা।‌

নৌকা থেকে নেমে কিছুটা গেলে লালনগর হাইস্কুল। আশপাশে যত দেওয়াল, শুধু জোড়াফুলের পতাকা আর তৃণমূল প্রার্থী নিয়ামত শেখের সবুজ-হলুদ দেওয়াল ‌লিখন।

কংগ্রেস আর সিপিএম হাওয়া!

বসন্তের ঝিলমিল পাতা গজানো ঝাঁকড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পাশের চায়ের দোকানের দিকে আঙুল তোলেন ফকরুল ইসলাম— ‘‘সকাল বিকেল ওখানে জনা চল্লিশ লোক আড্ডা দেয়। সেখান থেকেই ছুড়ে দেওয়া হয় কথা— ‘হাত আঁকলে হাত থাকবে না।’ ‘তৃণমূলকে ভোট না দিলে লটকে দেব। কেউ কিস্সু করতে পারবে না।’ ‘পুলিশ কিচ্ছু করবে না। আমরা কে জানিস?’

ওরা কারা?

‘‘সবাইকে চিনি না। তবে কয়েক জনকে চিনি। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে দেখেছি’’— নিচু গলায় বলেন সামসুল মণ্ডল।

হরিহরপাড়া বিধানসভা এলাকায় হুমাইপুর পঞ্চায়েতের লালনগর গ্রাম। চায়ের দোকান থেকে কিছুটা এগিয়ে গ্রামের পশ্চিম দিকে নাজুফা বিবির বাড়ি। গত পঞ্চায়েত উপ-নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলেন।

পাঁচ মাস আগের সেই নির্বাচন, যাতে তৃণমূলের সন্ত্রাস রুখতে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল বলে অভিযোগ। মাত্র ছয় ভোটে পঞ্চায়েত আসনটি কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। তার পর থেকেই এই গ্রাম কার্যত তৃণমূলের দখলে।

‘‘ভোটের দিন পুলিশ গুলি না চালালে আজ আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। তৃণমূলের গুন্ডারা আমাকে মেরেই ফেলত’’ — দাবি নাজুফা বিবির— ‘‘সেই থেকে গ্রামের প্রতিটা মানুষ আতঙ্কে। ওরা প্রকাশ্যে মারছে না। কিন্তু....’’ কথা শেষ করতে না দিয়ে পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে মুখ চাপা দেন তাঁর স্বামী আত্তাজুল শেখ। তার পর বলেন, ‘‘খেটে খাই আমরা। বেশি কিছু বল‌লে কাজ হারাতে হবে।’’

লালনগর গ্রামে ভোটার হাজারের কিছু বেশি। কংগ্রেসের অভিযোগ, তৃণমূলের গুন্ডারা পকেটে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরছে। দেওয়াল লিখতে গেলে বা কোনও রকম বিরোধী সুর শুনলেই ‘লাশ ফেলে দেওয়া’র হুমকি দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের এক বাসিন্দা ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনে এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন।

গ্রামের মসজিদের কাছে একটু আবডালে দাঁড়িয়ে অভিযোগ ঝরে পড়ে এক কংগ্রেস কর্মীর গলায়—‘‘হরিহরপাড়ায় কংগ্রেস প্রার্থী দেবে বলে প্রদেশ নেতৃত্ব সূত্রে খবর পেতেই আমরা দেওয়াল ধরে ধরে চুন লাগিয়ে হাত প্রতীক আঁকতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম বিকেলেই মোটরবাইকে এসে দু’জন আমাদের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে বলে যায়, ‘এর পরিণাম কিন্তু ভাল হবে না। ওই হাত কেটে দেওয়া হবে!’ আমরা তা নেতাদের জানিয়ে বাড়ি ঢুকে গিয়েছি।’’

এর পরে আর কারও বেরনোর সাহস হয়নি। যতই আধা সেনা আসুক, ভোট মিটে যাওয়ার পরে কী ভাবে গ্রামে থাকবেন, তা ভেবেই ঘরে বসে রয়েছেন কংগ্রেস কর্মীরা। একই কারণে দেওয়াল দখল করেও না লিখেই ফিরতে হয়েছে সিপিএমের লোকজনকেও।

কংগ্রেস প্রার্থী আলমগির মিরের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলকে ভোট না দিলে খুনের হুমকি চলছে চার মাস ধরে। আমাদের কেউ দেওয়াল লিখতে গিলেই মিলছে হাত কেটে নেওয়ার হুমকি। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া এলাকায় সুস্থ ভাবে ভোট করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনের কাছে এ অভিযোগ দায়ের হয়েছে। দেখা যাক, কোন ফল মেলে কি না।’’

তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন পাল্টা বলেন, ‘‘হুমকির অভিযোগ মিথ্যে। লালনগর গ্রামে কংগ্রেসের কেউ নেই। যে কয়েক জন ছিল, তারাও তৃণমূলে চলে এসেছে। লোকের অভাবেই দেওয়াল লিখতে পারেনি ওরা।’’

মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, ‘‘অভিযোগের বিষয়ে আমরা বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছি। যারা অভিযোগ করছে, তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে। প্রয়োজনে ওই এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী রুট মার্চ করবে।’’

গত রবিবার লালনগর ও পাশের কয়েকটি গ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনী টহলও দিয়েছে। কিন্তু তাতে ভয় কাটেনি।

ফল?

হরিহরপাড়া থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে লালনগর গ্রামের দেওয়ালে হাসছে শুধুই ঘাসফুল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

alleged cangress assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE