পরাজয়ের পরে গণনাকেন্দ্রে গদাধর হাজরা। —নিজস্ব চিত্র।
দু’জনের কাছেই এ বারের ভোট ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। যে জিতবেন, প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার ব্যাপারে তিনি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন অনেকটাই। দু’জনেই তৃণমূলের। এক জন ঘোষিত প্রার্থী। অন্য জন, এলাকার অঘোষিত ‘রাজা’।
দিনের শেষে ভোটের ফল বলছে, অজয় নদের পাড়ে লাল মাটির নানুরে জিতেছে সিপিএম। কিন্তু, বীরভূমের ওই তল্লাটের বাচ্চা মাত্রও জানে, সিপিএম নয়, আসল লড়াইয়ে জিতেছেন কাজল শেখ! তাঁর মেশিনারির কাছেই হার মানতে হয়েছে নানুরের তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরাকে। ১১-০ ফল করার যে হুঙ্কার ভোটের আগে থেকে বারবার ছেড়েছেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, তা থমকে গিয়েছে নানুরে। গোটা বীরভূমে এই কাজলই একমাত্র কাঁটা গদাধরের বর্তমান ‘গডফাদার’ অনুব্রতর।
গদাধর অনুগামীদের অভিযোগ, নানুরে প্রায় ২৬ হাজার ভোটে সিপিএম প্রার্থী শ্যামলী মণ্ডলের জয়ের পিছনে ‘আসল কারিগর’ কাজলই! তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে নানুরের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তৃণমূল সমর্থক ভোটারদের ভোটও গিয়েছে সিপিএমের ঝুলিতে। কাজলেরই ‘নির্দেশে’ ১৭ এপ্রিল, বীরভূমে ভোটের দিন নানুরের অন্তত ৫১টি বুথে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এজেন্টই বসাতে পারেননি গদাধর। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে যখন এজেন্ট বসিয়েছেন, ততক্ষণে খেল খতম! কাজল নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘নানুরের ফলে আমি খুব ব্যথা পেয়েছি।’’
শুধু নানুর নয়, অজয়ের ও-পারে বর্ধমানের কেতুগ্রামে নিজের দাদা তথা তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজকে জেতানোও এ বার চ্যালেঞ্জ ছিল কাজলের কাছে। বিশেষ করে নানুরে ধাক্কা খেয়ে কেতুগ্রামে পাল্টা ঘা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল অনুব্রত-শিবির। সাহানেওয়াজ নিজেও ঘনিষ্ঠ মহলে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু, কাজল আড়ালে থেকে দাদাকে জেতানোর জন্য যাবতীয় চেষ্টা চালিয়েছেন। গ্রামীণ বর্ধমানে ভোট ছিল ২১ এপ্রিল। এ দিন দেখা গেল, ৮ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতে গিয়েছেন কাজলের দাদা। কেতুগ্রাম ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহের শেখ তাই বলছেন, ‘‘কাজলদা আমাদের মাথার উপরে সব সময় থাকেন। বিধায়কও কেতুগ্রামের মাটিতে পড়ে থাকতেন। মানুষ তার দাম দিয়েছে।’’
তবে, কাজলের আসল লড়াই ছিল নানুরেই। এমনিতেই গদাধরের তিন অনুগামীকে খুনের মামলা ঝুলছে ঘাড়ের উপরে। দীর্ঘদিন হল গ্রামছাড়া। এই অবস্থায় কাজল জানতেন, ভোটের লড়াইয়ে গদাধরকে না হারালে তাঁর নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বই সঙ্কটের মুখে পড়বে। তাই গদাধরকে হারাতে যা যা করার, সবই তিনি করেছেন বলে অভিযোগ। যদিও অভিযোগ উড়িয়ে কাজলের দাবি, ‘‘আমার নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে। দলের নির্দেশে আমি বাইরে ছিলাম। বিশেষ কাউকে ভোট দিতে বলিনি, ভোট দিতে নিষেধও করিনি। আশা করি, খুব দ্রুত নানুরকে আবার দখলে নিতে পারব।’’
কাজল যা-ই দাবি করুন, ভোটে হেরে খাপ্পা গদাধর। এ দিন বোলপুরের পারুলডাঙ্গা আশ্রম বিদ্যালয়ের গণনাকেন্দ্রে প্রথম দিকে অবশ্য তৃণমূল প্রার্থী খোশমেজাজেই ছিলেন। তখন নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের আওতাধীন বোলপুর ব্লকের কিছু পঞ্চায়েতের গণনা চলছিল। ওখানে গদাধরের প্রভাব বেশি। অল্প ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন গদাধর।ছবিটা বদলাতে শুরু করে, নানুর ব্লকের বিভিন্ন পঞ্চায়েতের গণনা শুরু হতেই। দেখা যায়, গদাধরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন সিপিএম প্রার্থী। হার নিশ্চিত জেনে, ফল ঘোষণার আগেই গণনাকেন্দ্র ছারেন গদাধর। কাজলের নাম না করে বললেন, ‘‘বিশ্বাসঘাতকতা করেই আমাকে হারানো হল।” অনুব্রত নিজেও বলছেন, নানুরে হারবেন, কল্পনাও করেননি। বিকেলে বোলপুরে পার্টি অফিসে বিধ্বস্ত গদাধরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘‘মন খারাপ কোর না। আমি যদি বেঁচে থাকি, পাঁচ বছর পরে তুমি আবার বিধায়ক হবে।’’
কিন্তু তত দিন? গদাধরের পাশে থাকবেন কি কেষ্ট? প্রশ্ন রয়েই গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy