Advertisement
E-Paper

ভোট-অঙ্কেও ভূতের ছাপ

তেনাদের কারসাজি টের পাওয়া গিয়েছিল ভোটের দিনই। আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও সে কথা বলা হয়েছিল পর দিনই। সাত দিন পরে কেশপুরের বুথ ভিত্তিক ভোটদানের তালিকা হাতে আসার পরেও দেখা গেল, ভূতের গন্ধে ম ম করছে সব হিসেব।

বরুণ দে

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪০
১১ এপ্রিল, ভোটের দিন বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা ছিল সরুই প্রাথমিক স্কুলের বুথ। অথচ এই বুথে ভোট পড়েছে ৯৩.৭৯ শতাংশ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

১১ এপ্রিল, ভোটের দিন বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা ছিল সরুই প্রাথমিক স্কুলের বুথ। অথচ এই বুথে ভোট পড়েছে ৯৩.৭৯ শতাংশ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

তেনাদের কারসাজি টের পাওয়া গিয়েছিল ভোটের দিনই। আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও সে কথা বলা হয়েছিল পর দিনই।

সাত দিন পরে কেশপুরের বুথ ভিত্তিক ভোটদানের তালিকা হাতে আসার পরেও দেখা গেল, ভূতের গন্ধে ম ম করছে সব হিসেব।

ভোটের দিন এই সন্দেহজনক গন্ধটাই পাওয়া গিয়েছিল কেশপুরের সরুই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৭৭ নম্বর বুথে। ১১ এপ্রিল দিনের বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা ছিল এই বুথ। অথচ সকাল সাড়ে ন’টায় বুথে পৌঁছে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, ১,০৬৪ জন ভোটারের মধ্যে ২০৮ জন ভোট দিয়ে দিয়েছেন। এ-ও দেখা গিয়েছিল, বুথের বাইরে লোক জড়ো করে চোরা সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে তৃণমূল। দিনের শেষে সরুইয়ের এই বুথে ভোটদানের হার ৯৩.৭৯ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনে পাঠানো রিপোর্ট বলছে, ১,০৬৪ জন ভোটারের মধ্যে ৯৯৮ জনই ভোট দিয়েছেন।

গন্ধটা যে ছিল সন্দেহজনক, ভোটের দিনই তা টের পেয়েছিল আনন্দবাজার।

শুধু সরুই নয়, ফাঁকা বুথে তরতরিয়ে ভোটদানের হার চড়ার দৃশ্য দেখা গিয়েছিল আরও অনেক বুথে। আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনও সেই ভূতের কারসাজির কথাই বলা হয়েছিল। সাত দিন পরে কেশপুরের বিভিন্ন বুথে প্রদত্ত ভোটের তালিকা হাতে আসার পরেও দেখা যাচ্ছে সত্যি ভূতের নেত্যই হয়েছে। কোনও বুথে ভোটের হার ৯৮ শতাংশের বেশি। কোথাও ৯৭%, কোথাও ৯৬%। আর ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে, এমন বুথের সংখ্যা নয় নয় করে ১৯টি। হিসেব বলছে, কেশপুরের বাহানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩০ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৯৮.১৯%, বিনজুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩১ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৯৭.৪২%, নরসিংহপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৩৮ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৯৭.৩৬%।

এই কেন্দ্রে নির্বাচনের দিন মারধর, হুমকি, বুথ দখলের অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। আর ভোটের এই চড়া হার দেখে বিরোধীদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বুথে বুথে ভুতের দাপাদাপিই হয়েছে ভোটের দিন। সিপিএমের কেশপুর জোনাল সম্পাদক মানিক সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘কেশপুরে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। তৃণমূলের লোকেরা বহু বুথ দখল করে, ছাপ্পা দিয়েছে।’’ একই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনের কাছে যে ধরনের তৎপরতা আশা করা হয়েছিল, এখানে তা দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীও নিষ্ক্রিয় থেকেছে।

সুনসান বুথেও চড়চড়িয়ে ভোটের হার বাড়ার দৃশ্য এ বার জঙ্গলমহলে প্রথম দফার ভোট থেকেই দেখা যাচ্ছে। বেলপাহাড়ির লালজল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে তো ১০০% ভোট পড়েছে বলে প্রথমে নির্বাচন কমিশনে রিপোর্ট জমা পড়েছিল। সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে হইচই হওয়ায় ভোটের তিন দিন পরে রাতারাতি নতুন তালিকা যায় কমিশনে। সেখানে লালজলের ওই বুথে ভোটের হার কমে হয় ৮৯.৪৩%।

কেশপুরের ক্ষেত্রে অবশ্য হিসেব বদলের ঘটনা ঘটেনি। কমিশনে প্রথমে যে তালিকা গিয়েছে, তাতেই দেখা যাচ্ছে বহু বুথে ভোটের হার ৯৫%-এর বেশি। আর তাতেই ভূতের গন্ধ পাচ্ছে বিরোধীরা। তবে কেশপুরের কোনও বুথেই পুনর্নির্বাচন দাবি করেনি বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, কয়েকটি বুথে ফের ভোট চেয়ে কী লাভ! গোটা বিধানসভা এলাকাতেই তো ভূতের নেত্য হয়েছে।

বিরোধীশূন্য রাজনীতি, রিগিং, বুথ-জ্যামের মতো অভিযোগ সেই বাম আমল থেকেই শুনছে কেশপুর। এখানে বরাবর জোর যার মুলুক তার। কেশপুর যখন ‘লাল দুর্গ’, সেই সময় ২০০১ সালে সিপিএম প্রার্থী নন্দরানি ডল জিতেছিলেন ১ লক্ষ ৮ হাজার ভোটে। রাজ্যের মধ্যে সেটাই ছিল সর্বাধিক ব্যবধান। ২০০৯ সালের লোকসভায় কেশপুর থেকে বামেরা ‘লিড’ পেয়েছিল ১ লক্ষ ১২ হাজারের। যে ভুতুড়ে ভোট নিয়ে এত কাঁটাছেঁড়া, তা ওই সব সময়েও কেশপুরবাসীর বড্ড চেনা ছিল। বুথমুখো না হওয়ার হুমকি, অবাধ ছাপ্পা, বিরোধী-হীন বুথে একশো ভাগ ভোট করা, এ সবই দস্তুর ছিল কেশপুরে।

২০০১-এ বিধানসভা ভোটে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি ছিল, ‘কেশপুর সিপিএমের শেষপুর’ হবে। হয়নি। উল্টে সিপিএমের নন্দরানি ডল জেতেন ১ লক্ষ ৮ হাজার ভোটে। রাজ্যে সেটাই ছিল রেকর্ড ব্যবধান। বিস্তর বিতর্কেও বদলায়নি ছবি। ২০০৬-এ সিপিএম এখানে জেতে ৬৬ হাজার ভোটে। রং বদলায়নি ২০১১-র ঝড়েও। ৩৪ হাজার ভোটে জেতেন সিপিএমের রামেশ্বর দোলুই।

রাজ্যে পালাবদলের পরে তাই আশা জেগেছিল কেশপুরে। মানুষজন ভেবেছিলেন এ বার হয়তো ভোটের ছবিটা পাল্টাবে। কারণ, বদলের বার্তা দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু কোথায় কী! রাজ্যপাটে আসতেই কেশপুরেও শুরু হয়ে যায় শাসক দলের দাপট। সামনে আসে বিরোধীশূন্য কেশপুরের চেনা ছবি।

২০১১-র পর থেকেই বাম আমলের সব রেকর্ড ভেঙে দেয় তৃণমূল। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরিখে কেশপুরে তৃণমূলের ‘লিড’ ১ লক্ষ ৩৩ হাজার। ২০১৪ সালের লোকসভায় সংখ্যাটা ছিল ১ লক্ষ ১৭ হাজার। এ বারও তৃণমূল কেশপুরে রেকর্ড ভোটে জেতার ভাঙার পণ করেছে। দলের ব্লক সভাপতি সঞ্জয় পান জোর গলায় বলছেন, ‘‘এ বার মার্জিন এক দশ (এক লক্ষ দশ হাজার) হবে বলেই আমরা আশাবাদী।’’

২০১১ সালের ঝড়েও কেশপুর আসন ধরে রেখেছিল সিপিএম। তারপর অবশ্য এলাকায় আর লাল পতাকা ওড়েনি। একে একে কার্যালয় বন্ধ হয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। ফলে, এই কেন্দ্রে জয়ের আশা সে ভাবে সিপিএমের ছিল না। তবে তৃণমূল পূর্ব মেদিনীপুর থেকে শিউলি সাহাকে এনে প্রার্থী করায় দলে কোন্দল দেখা দেয়। তাতে কিছুটা অক্সিজেন বাম বাম শিবির। কমিশনের কড়াকড়িতে বিরোধীরা একটু-আধটু প্রচারও সারতে পারে। ফলে, একটু হলে নির্বিঘ্ন-অবাধ ভোটের ফসল ঘরে তোলার আশা করেছিল বাম শিবির।

কিন্তু ভোটের দিন সব ছবি পাল্টে যায়। ফাঁকা বুথে দেদার চলে ভূতের কীর্তি। বুথ ভিত্তিক পরিসংখ্যান আসার পরেও যে ভাবে বুথে বুথে ভুতেদের দাপাদাপির ছবি দেখা যাচ্ছে, তাতে বিরোধীদের সব আশায় জল পড়েছে। কেশপুরের এক সিপিএম নেতার আক্ষেপ, ‘‘ভোটের দিন তো বুথে ভূতেরাই ঘুরে বেড়িয়েছে। মানুষ আর কোথায় ভোট দিতে পারল!’’

assembly election 2016 vote ghost
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy