Advertisement
০৭ মে ২০২৪

রাজ্যের চার পুলিশ সুপার, এক জেলাশাসক-সহ এক লপ্তে বদলি ৩৭ অফিসার

পুলিশ-প্রশাসনের নিচুতলা পর্যন্ত মোট ৩৭ জন কে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ধরিয়ে দিল দিল্লির নির্বাচন সদনমুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী ইঙ্গিতটা দিয়েই গিয়েছিলেন মঙ্গলবার। ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই রাজ্যের চার পুলিশ সুপার, এক জেলাশাসক-সহ পুলিশ-প্রশাসনের নিচুতলা পর্যন্ত মোট ৩৭ জন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ধরিয়ে দিল দিল্লির নির্বাচন সদন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৩:৪৬
Share: Save:

মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী ইঙ্গিতটা দিয়েই গিয়েছিলেন মঙ্গলবার। ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই রাজ্যের চার পুলিশ সুপার, এক জেলাশাসক-সহ পুলিশ-প্রশাসনের নিচুতলা পর্যন্ত মোট ৩৭ জন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ধরিয়ে দিল দিল্লির নির্বাচন সদন। বৃহস্পতিবার রাতে নবান্নকে তার এক ঝাঁক অফিসার সরানোর নির্দেশ ধরানোর পাশাপাশি, ভিন রাজ্যের সিইও-দের (রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার) নেতৃত্বে রাজ্যে পাঁচটি বিশেষ নজরদারি দল পাঠানোর সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছে কমিশন। রাজ্য প্রশাসনের উপরে আস্থা না রেখে কমিশন যে ভোট-পর্বের প্রতিটি ধাপেই নিজের নজরদারি কঠোর থেকে কঠোরতর করছে, এ দিনের ঘোষণায় সেটাই আবারও প্রমাণ হল বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের বহু কর্তা।

নবান্নের অন্দরেই গুঞ্জন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশন এ বার এ রাজ্যে কার্যত বেনজির ভূমিকা নিচ্ছে। শাসক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অফিসারদের সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা হয়তো নতুন নয়। আগের লোকসভা নির্বাচনেও এ ধরনের পদক্ষেপ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এক লপ্তে এত জন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ার উদাহরণ তাঁরা মনে করতে পারছেন না। সেই সঙ্গে ভিন্‌ রাজ্যের এত জন সিইও-কে এনে ভোট প্রস্তুতি নজরদারি করানোর ঘটনা এর আগে ঘটেনি। আজ, শুক্রবারই পাঁচ রাজ্যের সিইও-রা এখানে পা রেখে ছড়িয়ে পড়বেন বিভিন্ন জেলায়। পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে তাঁরা জেলায় জেলায় ঘুরবেন। প্রতি দলে থাকবেন পাঁচ জন।

কমিশনের এক কর্তা জানান, রাজ্য সরকারের আইএএস-আইপিএস অফিসারেরা নির্বাচনের নিয়ম-বিধি মেনে কাজ করছেন কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে ওই পাঁচটি দলের নেতৃত্বে থাকবেন ভিন্‌ রাজ্যের পাঁচ মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও)। এ ছাড়া প্রতিটি দলে থাকবেন অন্য রাজ্যের এক জন করে আইপিএস এবং অতিরিক্ত বা উপ নির্বাচনী অফিসার। থাকবেন নির্বাচন কমিশনের সচিব বা উপসচিব পদমর্যাদার এক জন অফিসারও। ২২ মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি দল চারটি করে জেলায় ঘুরে বেড়াবে। কমিশনের ওই কর্তাটির দাবি, এ ভাবে ভিন্‌ রাজ্যের সিইও-দের পাঠানো মানেই হল এ রাজ্যের সিইও-র উপরে পুরোদস্তুর ভরসা করছে না কমিশন।

সেই ‘ভরসার অভাব’ থেকেই হুগলির জেলাশাসক এবং বর্ধমান, মালদহ, নদিয়া এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপারকেও এ দিন সরিয়ে দিয়েছে কমিশন। ওই চার এসপি মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। হুগলির জেলাশাসককে লোকসভার ভোটেও সরতে হয়েছিল। এ ছাড়া কলকাতার দুই নির্বাচনী অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এ বার। সরানোর তালিকায় রয়েছে একাধিক মহকুমা, ব্লক এবং থানা স্তরের অফিসারও। কমিশনের এক কর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট অফিসারদের অতীতের কাজকর্ম এবং হালফিলের ভূমিকা খতিয়ে দেখেই এই সিদ্ধান্ত। এঁরা কেউ নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না।

কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শাসক দলের কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল একে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, এ রকম আগেও হয়েছে। যাঁদের সরানো হল, তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হবে। গত লোকসভা ভোটে যে পাঁচ জন অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছিল কমিশন, ভোটের পর মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া মমতার ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘যাঁদের আনা হল, তাঁরাও তো এই সরকারেরই অফিসার।’’ তবে বিরোধীরা এই পদক্ষেপে খুশি। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘প্রশাসনের অনেকেই শাসক দলের হয়ে কাজ করছিলেন। তাই এটার প্রয়োজন ছিল।’’ বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও দাবি করেন, ‘‘এটা খুব জরুরি ছিল।’’

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

বদলির বিষয়টাকে খানিক লঘু করে দেখলেও পাঁচ রাজ্যের সিইও-র নেতৃত্বে বিশেষ দল পাঠানোর সিদ্ধান্তটা কিন্তু রাজ্য প্রশাসন ও শাসক দলের অস্বস্তি কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। যদিও মুখে তা স্বীকার করছেন না কেউ। বরং দলের সহ-সভাপতি ও সাংসদ মুকুল রায় বলেন, ‘‘এটা নতুন নয়, এর আগে ২০০৪ সালে ভিন্‌ রাজ্যের এক জন সিইও পর্যবেক্ষক হয়ে এসেছিলেন।’’ কিন্তু ঘটনা হল, এক আর পাঁচ যে এক নয় সেটা সকলেই বিলক্ষণ বুঝছেন। জনান্তিকে নবান্নের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘যা দেখছি, তাতে কমিশন আমাদের স্বাধীন ভাবে নড়াচড়া করতে দেবে না বলেই মনে হচ্ছে।’’

প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন কেন এতটা কড়াকড়ি করছে? নসীম জৈদী কেন গোড়া থেকেই বলে আসছেন এ বারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটকে তাঁরা অন্য চোখে দেখছেন? কমিশনের কর্তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পর্যবেক্ষক থাকা সত্ত্বেও লোকসভা ভোট যে কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছিল, সে কথা কমিশন মনে রেখেছে। পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোটে বিপুল অশান্তির কথা কমিশন জেনেছে। তাই প্রথম থেকেই ঠিক হয়, এ বারের ভোটে রাজ্য প্রশাসনকে খুব বেশি মাথা তুলতে না দিয়ে ভোট পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত কমিশনই নেবে, জানাচ্ছেন কমিশনের এক কর্তা। তার উপরে এ সপ্তাহের গোড়ায় কমিশনের ফুল বেঞ্চ যখন রাজ্যে আসে, তখন তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। মীরাদেবী নিজে সুপ্রিম কোর্ট অবধি লড়ে পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনিয়েছিলেন। কিন্তু তাও হিংসা ঠেকানো যায়নি। সেই অভিজ্ঞতার কথা মীরা জানিয়ে এসেছেন বলে কমিশন সূত্রে খবর। কমিশন মীরার কাছে জানতে পেরেছে, পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও রাজ্য প্রশাসনের অসহযোগিতায় তাদের যথাযথ ভাবে কাজে লাগানো যায়নি। আবার রাজ্যের পর্যবেক্ষকরা সঠিক রিপোর্ট দেননি বলে গোলমালের সব খবর পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশন এ সব কথাই মাথায় রেখেছে।

সেই সঙ্গে এ রাজ্যে শুধু বুথ পাহারা দিলেই যে ভোট অবাধ হয় না, সেটাও কমিশন তার পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছে। সেই কারণে এ বার কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গ্রামের ভিতরে ঢোকাচ্ছে। সার্বিক ভাবে এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে চাইছে। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে যাতে কাউকে আটকানো না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছে। সেই কারণেই সিইও-দের দল জেলায় জেলায় ঘুরে পরিস্থিতি সরেজমিন যাচাই করবেন। ডিএম-এসপিরা কমিশনের নির্দেশ মানছেন কি না, ভয়ের পরিবেশ রয়েছে কি না, শাসক দলের লোকেরা প্রভাব খাটাচ্ছে কি না, প্রশাসন পক্ষপাত করছে কি না, সব মানুষকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কি না— দেখবেন তাঁরা। তালিকা মেনে আগাম গ্রেফতারের কাজ কতটা এগোল, তার তথ্য-তালাশ করবেন। বিভিন্ন জেলা প্রশাসন যে রিপোর্ট দাখিল করেছে, প্রতিনিধিদল তার সত্যতাও যাচাই করতে পারে বলে কমিশন সূত্রের খবর। সামগ্রিক ভাবে নিজের প্রস্তুতিতে যাতে ফাঁক না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছে কমিশন।

এমনিতেই এ বার কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের আনা হচ্ছে নজরদারির আওতায়। মঙ্গলবার দফায় দফায় বৈঠকে রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে রীতিমতো ধমক দিয়ে কমিশন বুঝিয়ে দিয়েছিল, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের পথে গড়বড় হলে তারা কাউকে রেয়াত করবে না। দলদাসত্বের অভিযোগ ওঠা অফিসারদের একাংশকে বদলির ইঙ্গিতও সে দিনই মেলে। বুধবার কমিশন জানিয়ে দেয়, প্রতি জেলায় এক জন করে পুলিশ পর্যবেক্ষক থাকবেন। গত বার গোটা রাজ্যের জন্য ছিলেন ৪ জন পুলিশ পর্যবেক্ষক, এ বার তা বেড়ে হয়েছে ২১ জন। এ ছাড়া ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্যে মোট ১৯৩ জন সাধারণ পর্যবেক্ষক এবং ৬৬ জন হিসাব পর্যবেক্ষক থাকছেন। আসার কথা বিশেষ পর্যবেক্ষকেরও। প্রতি কেন্দ্রে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষের দিন থেকে ভোটগ্রহণের দিন পর্যন্ত তাঁরা রাজ্যে থাকবেন। আর তার পরেই এ দিন একসঙ্গে ৩৭ অফিসারকে সরিয়ে ও পাঁচটি বিশেষ দল পাঠানোর কথা ঘোষণা করে রাজ্যের উপরে কার্যত সাঁড়াশি চাপ তৈরি করল কমিশন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE