Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বোমা-বাঁশ-ছাপ্পায় ভূতের কেত্তন

ছেলের নামটা ঠিক কী যেন, মনেই করতে পারলেন না মা

সকাল সকাল ভোট দিতে এসেছিলেন মাঝবয়সি আলিয়া বিবি। ভোটার কার্ড দেখিয়ে টিপ ছাপ দিয়ে আঙুলে কালিটাও লাগিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু ভোটটা আর দেওয়া হল না।ইভিএমের দিকে এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। পাশ থেকে এগিয়ে এলেন ‘বৌমা’ সাহানারা মণ্ডল। শাশুড়ি অন্ধ। তাই ভোটটা দিয়ে দিলেন তিনিই।

বেতবেড়িয়ার একটি একটি বুথে ভোট দিতে লম্বা লাইন।

বেতবেড়িয়ার একটি একটি বুথে ভোট দিতে লম্বা লাইন।

সুস্মিত হালদার
বেতবেড়িয়া শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০১
Share: Save:

সকাল সকাল ভোট দিতে এসেছিলেন মাঝবয়সি আলিয়া বিবি। ভোটার কার্ড দেখিয়ে টিপ ছাপ দিয়ে আঙুলে কালিটাও লাগিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু ভোটটা আর দেওয়া হল না।

ইভিএমের দিকে এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। পাশ থেকে এগিয়ে এলেন ‘বৌমা’ সাহানারা মণ্ডল। শাশুড়ি অন্ধ। তাই ভোটটা দিয়ে দিলেন তিনিই।

যদিও বুথের বাইরে বেরোতেই ‘মা’ মনে করতে পারলেন না ‘ছেলে’র নাম। আর ‘বৌমা’কে প্রশ্ন করতে, তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘‘উনি তো আমার শাশুড়ি। চোখে দেখতে পান না। তাই...।’’

সাহানারাকে দেখিয়ে এর পর আলিয়া বিবিকে প্রশ্ন করা হল— ‘‘ইনি কে?’’ উত্তর এল, ‘‘বৌমা।’’ —তা আপনার ছেলের নামটা কী?’’ প্রশ্নটা শুনে এ বার থমকে গেলেন প্রৌঢ়া। এ-দিক ও-দিক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তার পর আস্তে আস্তে বললেন, ‘‘ঠিক মনে করতে পারছি না বাবা।’’

কী বলছেন চাপড়ার বেতবেড়িয়ার ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সিদ্দিক রহমান? বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনিও যেন আকাশ থেকে পড়লেন। থতমত খেয়ে বললেন, ‘‘তাই নাকি? এমন হয়েছে বুঝি? কই জানি না তো!’’

বৃহস্পতিবার বেতবেড়িয়ায় ভরদুপুরে এ ভাবেই দাপিয়ে বেড়িয়েছে ‘ভূত’। দিনের শেষে তাই শাসকদল ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট হয়েছে বললেও প্রশ্ন উঠছে অবাধ হয়েছে কি? বেতবেড়িয়া গ্রামের চারটি বুথের একটিতেও তৃণমূল ছাড়া অন্য কারও এজেন্ট ছিল না। তৃণমূলের দাবি, এ গ্রামের সবাই তৃণমূল করে। তাই সিপিএমের হয়ে কেউ এজেন্ট হতে চায়নি। শুধু তাই নয়, তাদের আরও বক্তব্য, ২০১১-র পর থেকে কোনও ভোটেই কোনও বুথে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের এজেন্ট ছিল না।

ভূতের ভয় যে রয়েছে, সে অভিযোগ কিন্তু শুধু বিরোধীদের নয়। একই কথা জানাচ্ছে গ্রামবাসীও। ২৯ নম্বর বুথের কাছে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কয়েক জন লোক। ভোট দিতে যাওয়ার কোনও তাড়া আছে বলে মনে হল না। বিষয়টা পাড়তেই তাঁদের ভিতর থেকে হাবিল মণ্ডল, আব্দুর রহিমরা জানিয়ে দিলেন, ‘‘এ আর নতুন কথা কী! গত বিধানসভার ভোটের পর থেকে আর কোনও ভোটেই তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের এজেন্ট থাকে না।’’

কিন্তু কেন? গোটা গ্রামে কি সত্যিই একজনও তৃণমূল-বিরোধী ভোটার নেই? এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন চাপড়া ব্লকের যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি প্রার্থী রুকবানুর রহমানের ডান হাত সুকদেব ব্রহ্ম। বাড়ি সুঁটিয়া। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দেখা গেল বেতবেড়িয়ার চারটি বুথেই ভোটের তদারকি করতে। ২৬ নম্বর বুথের সামনে তাঁর দেখা পাওয়া যেতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়া গেল। একগাল হেসে বললেন, ‘‘হ্যাঁ। এটা ঘটনা। এই পাঁচ বছরে এলাকায় এত উন্নয়ন হয়েছে যে সকলেই এখন তৃণমূল করেন। তাই সিপিএমের হয়ে কেউ এজেন্ট হতে চাননি। আমরা তো আর ওদের এজেন্ট ভাড়া করে দিতে পারি না।’’

কিন্তু গ্রামের হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে অন্য গল্প। শাসক-বিরোধী কেউ নেই এমনটা নয়, বরং শোনা যাচ্ছে ‘ভূতের’ ভয়ে তারা তটস্থ। আশপাশে কান পাতলেই শোনা যায় ভুতুরে ভোটারদের ফিসফাস। ভূতের তাণ্ডবে গ্রামে ফিরতে পারেননি গ্রামছাড়ারা। গ্রামেরই কয়েক জনকে প্রশ্ন করতে বোঝা গেল আতঙ্কটা? চার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তার পর গলাটা খানিক নামিয়ে নিয়ে তাঁরা বললেন, ‘‘হ্যাঁ। শান্তিই রয়েছে। শ্মশানের শান্তি।’’

২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর গ্রামের স্কুল নির্বাচনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল সিপিএম কর্মী আশাদুল শেখকে। ময়নাতদন্তের পরে তার দেহটা পর্যন্ত গ্রামে আনাতে পারেনি পরিবার। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আশাদুলের পরিবার-সহ বেশ কিছু সিপিএমকর্মীর বাড়ি। গ্রাম ছাড়া হয়েছিল কয়েকশো মানুষ। এই ঘটনায় হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানের স্বামী আশরফ ঘরামীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ নাকি তাকে খুঁজেই পায়নি এত দিন।

সেই আশরফের কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করে কেউ কেউ এ বার গ্রামে ঢুকতে পারলেও প্রায় ৮৩ জন ভোটার এখনও গ্রামছাড়া। নির্বাচন কমিশনের এত হাঁকডাক সত্ত্বেও তারা এ বারও ভোট দিতে পারলেন না। সিপিএম প্রার্থী সামশুল ইসলাম মোল্লা বলছেন, ‘‘সকলেরই তো প্রাণের মায়া আছে। স্কুল ভোটে যদি কাউকে খুন হতে হয়, এটা তো বিধানসভা ভোট।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Fake Voters TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE