জীবদ্দশায় দেখে যেতে চেয়েছিলেন, দমদম পুনরুদ্ধার হয়েছে। জ্যোতি বসুর এই ইচ্ছাপূরণ হয়েছিল। বাম রাজনীতিতে তাঁরই সহচর অশোক ঘোষের সে সুযোগ হয়নি। তবে জীবদ্দশায় যা হয়নি, মৃত্যুর পরে তাঁর জন্য সেটাই করে দেখাতে কোমর বেঁধেছে ফরওয়ার্ড ব্লক!
শেষ পর্বের ভোটে গোটা বাম মহলের নজর আপাতত কোচবিহারের দিনহাটা আসনের দিকে। দমদম লোকসভা কেন্দ্র ১৯৯৮-৯৯ সালে হারিয়েছিল সিপিএম। দিনহাটা বিধানসভা ফব-র হাতছাড়া হয়েছে, এমন নয়। কিন্তু দিনহাটার বিধায়ক এবং পুরসভার চেয়ারম্যান উদয়ন গুহ দল বদলে চলে গিয়েছেন তৃণমূলে। দিনহাটা তথা কোচবিহারের অবিসংবাদী বাম নেতা কমল গুহের পুত্রের এ কী ‘অধঃপতন’, তা-ই নিয়ে প্রবল সরব ফব। আবার উদয়নবাবুও তাঁর বাবার দৃষ্টান্ত দিয়েই পাল্টা যুক্তিতে নেমেছেন। তৃণমূলের মধ্যে তাঁকে নিয়ে অস্বস্তি সামাল দিতে উদ্যোগী হয়েছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ফব নেতৃত্ব দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য হাফিজ আলম সৈরানি ও নরেন চট্টোপাধ্যায়কে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন দিনহাটায় মর্যাদার লড়াই জিতে আসার জন্য।
তাঁদের মধ্যে নরেনবাবু রবিবার সংহতি ময়দানে জমায়েত দেখে আশ্বস্ত! তাঁর কথায়, ‘‘উদয়নবাবুর সঙ্গে কিছু কাউন্সিলর গিয়েছেন। কিন্তু সংগঠন এবং সাধারণ সমর্থকেরা আমাদের সঙ্গে আছেন। এ বার ভোটেই মানুষ জবাব দিয়ে দেবেন!’’ মানুষ যাতে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র জবাব দেন, দিনহাটার প্রচারে ঘুরে ঘুরে সেই আর্জিই জানাচ্ছেন ফব প্রার্থী অক্ষয় ঠাকুর। বিধায়ক অক্ষয়বাবুকে অন্য কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিনহাটায় নিয়ে আসা হয়েছে এককালীন ঘনিষ্ঠ সতীর্থ উদয়নবাবুকে বিপাকে ফেলার জন্যই। শুধু তা-ই নয়। প্রয়াত অশোকবাবুর স্নেহভাজন, কলকাতা জেলার যুব নেতা দেবব্রত রায়ও এখন ঘাঁটি গেড়েছেন দিনহাটায়। তাঁর দাবি, ‘‘দিনহাটা কেন্দ্রের মধ্যে কিছু গ্রামীণ এলাকায় মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে। সেখানেও মানুষ এখন ভয় ভেঙে বেরোচ্ছেন।’’
উদয়নবাবু তার মানে এখন সাঁড়াশি চাপে!
এক দিকে পুরনো দল নেমেছে আদা-জল খেয়ে। অন্য দিকে নতুন দলের একাংশ তাঁর গলায় জয়মাল্য উঠতে দিতে মোটেও আগ্রহী নয়! তিনি কি তা হলে উত্তরের রেজ্জাক মোল্লা হবেন? উদয়নবাবু অবশ্য আশঙ্কাকে আমল দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের এখানে অবস্থা ওই রকম নয়! ঐক্যবদ্ধ ভাবে আমরা এখানে লড়াই করছি।’’ রেজ্জাক যেমন তাঁর পুরনো তালুক ক্যানিং পূর্ব থেকে এ বার ভাঙড়ে আরাবুল ইসলামের এলাকায় এসে দাঁড়িয়েছেন, অক্ষয়বাবুকেও তেমনই দিনহাটা বিধানসভা এলাকার বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে— মনে করিয়ে দিচ্ছে তৃণমূল।
ফব-র আক্রমণের মোকাবিলা? উদয়নবাবুর বক্তব্য, ‘‘যে কমল গুহ নিয়ে এত কথা, তাঁকে ১৯৯২ সালে বহিষ্কার করেছিল ফব। আমাকেও দলে কোণঠাসা করা হয়েছিল। বুঝতে পেরে আমি দল ছেড়ে দিয়েছি।’’ ফব নেতারা আবার পাল্টা বলছেন, কমলবাবু দলের বাইরে গিয়েও কখনও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে নাম লেখাননি। পরে আবার ফ ব-য় ফিরে এসেছিলেন। তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে এখন আর কমলবাবুর পরম্পরা নিয়ে দাবি করা সাজে না!
বাম জমানাতেই ২০০৮ সালে দিনহাটায় আইন অমান্য আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ৫ জন ফব কর্মী-সমর্থকের। সরকারের শরিক থেকেও ঘটনার প্রতিবাদে বাংলা বন্ধ ডেকেছিলেন অশোকবাবুরা। ওই ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করার দাবি নিয়ে অশোকবাবুদের সঙ্গে দলের মধ্যেই টানাপড়েন বেধেছিল উদয়নবাবুর। এখনও ‘পঞ্চ শহিদে’র পরিবারকে নিজেদের দিকেই টেনে রেখেছে ফব। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সৈরানির দাবি, ‘‘শহিদের পতাকা ওই ভাবে বদলে যায় না!’’
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট দিনহাটা তথা গোটা কোচবিহারে মসৃণ বলেই বাম শিবিরের দাবি। তা উদয়নবাবুকে যে ভাবাচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারছেন বামেরা। এমনকী, উদয়নবাবুর অনুগামীদের একান্ত আলোচনায় শোনা যাচ্ছে, ‘কংগ্রেসের সঙ্গে যে জোটটা হচ্ছেই, সেটা দাদা আগেভাগে নিশ্চিত হলে ব্যাপারটা হয়তো অন্য দিকে গড়াতো।’
উপরন্তু, প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক ফজলে হক নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেও জোটের বাজারে তা উদয়নবাবুর পথেই কাঁটা ফেলবে বলে বামেরা হিসেব কষছেন। উদয়নবাবু মনে করেন, তৃণমূল সরকারের উন্নয়নের কাজ দিয়েই বাকি সব কাঁটা ঢেকে ফেলা যাবে। উদয়নবাবুর হয়ে শেষ বেলায় মঙ্গলবার বিকেলে দিনহাটায় জনতার কাছে আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাও।
বরাবরের সিংহের সঙ্গ ছেড়ে তৃণমূলের উন্নয়নের গান কমল-পুত্রকে গাইতে হচ্ছে, ফব-র জন্য সব চেয়ে বড় রসদ এটাই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy