Advertisement
E-Paper

প্রহর গোনার পালা শেষ

পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার আকাশে শুধুই সবুজ আবির উড়বে, না কি লাল-সবুজ, জানা যাবে আজই। তার ২৪ ঘণ্টা আগে দুই জেলার বিভিন্ন দলের পার্টি অফিস ঘুরে দেখা গেল একেক রকম ছবি। প্রার্থীদের মেজাজও হরেক রকম।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০১:৪৪
গণননার আগের দিনও বেলায় বিষ্ণুপুরে বিজেপির অফিস বন্ধ। কিন্তু পুরুলিয়ায় (ডানদিকে উপরে) তৃণমূলের জেলা অফিস ও (নীচে) বাঁকুড়ায় সিপিএমের জেলা অফিস ছিল আলোচনায় জমজমাট।

গণননার আগের দিনও বেলায় বিষ্ণুপুরে বিজেপির অফিস বন্ধ। কিন্তু পুরুলিয়ায় (ডানদিকে উপরে) তৃণমূলের জেলা অফিস ও (নীচে) বাঁকুড়ায় সিপিএমের জেলা অফিস ছিল আলোচনায় জমজমাট।

আসব আসব করে এসেই গেল দিনটা।

পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার আকাশে শুধুই সবুজ আবির উড়বে, না কি লাল-সবুজ, জানা যাবে আজই। তার ২৪ ঘণ্টা আগে দুই জেলার বিভিন্ন দলের পার্টি অফিস ঘুরে দেখা গেল একেক রকম ছবি। প্রার্থীদের মেজাজও হরেক রকম। গত লোকসভা ভোটের ফলের পুনরাবৃত্তি কিংবা আরও ভাল ফল করায় আত্মবিশ্বাসী শাসক শিবির যেমন আগাম অর্ডার দিয়েছে সবুজ আবির বা সবুজ রসগোল্লা-জিলিপির। ভাল রেজাল্টের প্রত্যয়ে পিছিয়ে নেই বাম-কংগ্রেস জোটও। বেশ কিছু আসনে তারা অঘটন ঘটাবে ধরে নিয়ে নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি শুরু করেছেন দু’দলের নেতা-কর্মীরাও।

কিন্তু সে সব ছাপিয়ে বুধবার দিনভর শাসক বা বিরোধী, দুই শিবিরেই কিন্তু চাপা উৎকণ্ঠা। প্রকাশ্যে টেনশনের কথা যদিও মুখে আনছেন না কেউই। বরং সবার গলায় ‘আমরাই জিতছি’ গোছের আত্মবিশ্বাস।

যেমন সিপিএমের বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সদস্য অশোক রায়। টেবিলের উপর ঝুঁকে রয়েছে মাথা। স্কুলডাঙায় দলের জেলা পার্টি অফিসে বসে এ দিন ডান হাতে কলম গোঁজা আঙুলেই ক্যালকুলেটরে এক মনে প্লাস-মাইনাস করে চলেছিলেন এই সিপিএম নেতা। শেষ মুহুর্তে বুথ ভিত্তিক লিড গোনা হচ্ছে? অশোকবাবু মৃদু হেসে বললেন, “না, কোন বুথে কত ভোট পড়েছে তার হিসেব করছি।” অশোকবাবুর উল্টো দিকে বসে বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায়। হাতের মোবাইলে কিছু লিখছিলেন। পাশে বসতেই মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন। স্ক্রিনে লেখা একটি ছড়া। যার সারমর্ম কোনও সমীক্ষাই মিলবে না।

সমীক্ষা দেখে টেনশন হচ্ছে কি না, প্রশ্ন শুনেই দলীয় অফিসে উপস্থিত বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সদস্য উজ্বল সরকারকে দেখিয়ে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুবিকাশ চৌধুরীর রসিকতা, “এ বার ভোটে জিতে ‘উজ্বল সরকার’ আমরাই গড়ব।” কথা শেষ হতেই হেসে উঠলেন অফিসে উপস্থিত জোনাল সদস্য শ্যামল মিদ্যা, বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা বিশ্বনাথ পালিতরা। আড্ডার বিষয় বস্তু যে ভোটের রেজাল্ট তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতীপবাবু অবশ্য বলছেন, “সমীক্ষা যাই বলুক, ভোটের মুখে একের পর এক ইস্যুতে তৃণমূল কোণঠাসা হয়েই ছিল। আর সেটাই এ বার রাজ্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।” তবে কোনও যুক্তিই যে দলের কর্মীদের মনের ভিতরের চাপা টেনশন কমাতে পারছে না, তা তাঁদের দেহের ভাষাই জানান দিচ্ছে।

এ দিকে তৃণমূল শিবিরের ছবিটাও কার্যত এক। পথে ঘাটে, চা দোকানে যেখানেই তৃণমূল প্রার্থীদের ডান হাত, বাঁ হাতেদের চোখে পড়েছে চোখে মুখে চিন্তার ছাপ দেখা গিয়েছে। আড়ালে সকলের একটাই প্রশ্ন ‘‘কী হবে বলুন তো?’’ যদিও প্রকাশ্যে টেনশনের কথা মানতে নারাজ কেউই। এ দিন নিয়ম মাফিক সঠিক সময়েই বাঁকুড়া পুরসভায় এসেছিলেন পুরপ্রধান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত। অন্যান্য দিনের তুলনায় এ দিন পুরসভার কর্মীদের সঙ্গে একটু বেশিই হাসিখুশি মেজাজে কথাবার্তা বলেছেন তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোট প্রসঙ্গ নিয়েই কথাবার্তা বলেছেন। একটা কথাই বারবার আওড়ে যাচ্ছিলেন, “জেলায় সবচেয়ে বেশি লিড পেয়ে জিতবেন বৌদি (তৃণমূল প্রার্থী মিনতি মিশ্র)।” কথা বলতে বলতে কেমন যেন আনমনাও হয়ে যাচ্ছিলেন। টেনশন হচ্ছে? প্রশ্ন শুনেই ভারি গলায় মহাপ্রসাদবাবু বলেন, “একদম না। বললাম তো সবচেয়ে বেশি লিড পাবেন বৌদি।” সবুজ আবির কিনেছেন নাকি? তিনি বলেন, “আমি কিনিনি। তবে কর্মীরা নিশ্চই কিনেছেন।” জেলা তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী এ দিন গাড়ি নিয়ে দক্ষিণ বাঁকুড়ার কেন্দ্রগুলি চষে বেড়িয়েছেন। তাঁর কথায়, “১২-০ হবেই। কেউ রুখতে পারছে না।”

এ বারের ভোটে কোন পক্ষ জিতবে তা নিয়ে ধন্দের শেষ নেই। বহু তৃণমূল ও জোট কর্মীই আড়ালে মানছেন, “শেষ হাসি কে হাসবে তা নিয়ে ভিতরে ভিতরে সব পক্ষই টেনশনে।” আর এ কারণেই মাথায় হাত পড়েছে মিষ্টি ব্যবসায়ীদেরও। ভৈরবস্থান মোড়ের মিষ্টি ব্যবসায়ী গিরিধারী বরাট নিজের দোকানে বড় বড় ডেগচিতে সাত টাকা দামের সবুজ, লাল-সাদা, গেরুয়া রঙেরও রসগোল্লা সাজিয়ে বসে রয়েছেন। এ ছাড়াও শুকনো মিষ্টির মধ্যে রয়েছে সবুজ ম্যাঙ্গো সন্দেশ, লাল-সাদা স্ট্রবেরি সন্দেশও! দোকানে ভোট স্পেশাল মিষ্টির সম্ভার মজুত থাকলেও বুধবার বিকেল পর্যন্ত কোনও দলের তরফেই বরাত মেলেনি! গিরিধারীবাবু বলেন, “অন্যান্য বার এমনটা হয় না। অনেক আগে থেকেই মিষ্টির বরাত পেয়ে যাই। এবারেই উল্টো!’’

আবার অর্ডার দিয়েও আবির না পেয়ে এ দিন বেশ দুর্ভাবনায় পড়তে হয়েছে কাশীপুর ব্লক তৃণমূলের কর্মীদের। তাঁরা ‘দাদা’র (স্বপন বেলথরিয়া) জয় নিয়ে কোনও সংশয়ে নেই। ভোট গণনার আগের দিন বুধবার তাঁদের মাথাব্যথার কারণ শুধু হয়ে থাকলেন রানিগঞ্জের এক ব্যবসায়ী। ব্যাপারটা কী? এক কর্মী বিড় বিড় করে বললেন, ‘‘রানিগঞ্জে ২০ বস্তা সবুজ আবিরের অর্ডার দিয়ে এসেছিলাম। পই পই করে বলেছিলাম, বুধবার সকালের মধ্যেই যেন পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু দেখুন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল আবিরের দেখাই নেই।’’ চিন্তামগ্ন ভাইদের একজন কী করবেন জানতে গিয়েছিলেন স্বপনবাবুর ছেলে সৌমেন বেলথরিয়ার (তিনি কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও বটে) কাছে। তিনি উল্টে শুনিয়ে দিলেন, ‘‘আবির নিয়ে ভাবতে হবে না। বরং ভোট গণনার জন্য প্রয়োজনীয় নথি পত্র সব ঠিক রয়েছে কি না দেখে রাখুন।’’ কাশীপুর কেন্দ্রে এ বারও তাঁর জয় নিশ্চিত ধরে দিনভর দলীয় কার্যালয়ে খোস মেজাজে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী স্বপনবাবু।

ভোটের রঙে সেজেছে জিলিপিও। বাঁকুড়ায় জয়পুরের হাটতলায়।—শুভ্র মিত্র

তবে তাঁর মতো এতটা নিশ্চিতে দিন কাটাতে পারেননি শাসকদলের বহু প্রার্থীই। গণনার আগের দিনে টেনশন কাটাতে অনেকেই একা না থেকে দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে কর্মীদের সঙ্গে থমথমে মুখে নির্বাচনের ফল নিয়ে আলোচনা করে সময় কাটিয়েছেন। রঘুনাথপুরের তৃণমূল প্রার্থী পূর্ণচন্দ্র বাউরি আবার গ্রামের হরিমন্দিরের সামনে একটি অনুষ্ঠানের তদারকি করে দিনের বেশ কিছুটা সময় পার করেছেন। কিন্তু কর্মীরা তো হাত গুঁটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। তাঁরা দলে দলে এসেছেন দাদার কাছে। তাঁদের সঙ্গে গণনা নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা সেরেছেন পূর্ণচন্দ্রবাবু।

অন্যদিকে পাড়ার তৃণমূল প্রার্থী উমাপদ বাউরি মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ডের ছিন্নমস্তা মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছেন। কিন্তু টেনশন তো কমার নয়। চাপ কিছুটা কমাতে এ দিন সকাল থেকেই দলীয় কার্যালয়ে বসে কর্মীদের সঙ্গে গণনা নিয়ে আলোচনা করে সময় কাটিয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের দীননাথ বাউরিও সকাল থেকেই সময় কাটিয়েছেন আনাড়ার দলীয় কার্যালয়েই। লুকোছাপা না করে দুই প্রার্থীর স্বীকারোক্তি, ‘‘বাড়িতে একা থাকলে টেনশন হবেই। তাই কর্মীদের সাথে থাকাটাই ভাল। এতে একদিকে যেমন টেনশন চেপে ধরতে পারে না, তেমনই গণনা নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনাও সেরে নেওয়া যাচ্ছে।’’

বস্তুত নির্বাচনের আগের দিন বুধবার রাজনৈতিক দলগুলির দলীয় কার্যালয় ঘুরে চোখে পড়েছে সর্বত্রই বৃহস্পতিবারের গণনার নথি ঠিকঠাক করার ব্যস্ততা। পুরুলিয়া শহরের বিটি সরকার রোডে তৃণমূলের জেলা কার্যালয়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখে কর্মীদের গণনা নিয়ে অনবরত নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোকে। বলরামপুরের প্রার্থী তথা জেলা সভাপতি শান্তিরামবাবু অবশ্য পুরুলিয়ায় তৃণমূলের জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। দাবি করেন, ‘‘আমরা পাঁচ বছর মানুষের সাথে ছিলাম আর বিরোধীরা নির্বাচনের আগে মাঠে নেমেছে। জয় তো আমাদেরই হবে।”

অন্যদিকে সাউথ লেক রোডের কংগ্রেসের জেলা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গিয়েছে গণনার জন্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাতেই কর্মীরা আসবে কার্যালয়ে। তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত কর্মীরা। পাশাপাশি জেলায় ভোট পরবর্তী পরিস্থিতি যাতে গণ্ডগোলে না গড়ায় সে ব্যাপারে কর্মীদের সতর্ক করতে শোনা গিয়েছে শান্তিরামবাবু ও জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতোকে।

তবে এগজিট পোল দেখে ব্যবসায়ী আবির নিয়ে চলে এসেছেন। সবুজ, লাল আবির থাকলেও গেরুয়া রঙের আবির অনেকে তোলেননি। পুরুলিয়া শহরের চকবাজারের আবির ব্যবসায়ী প্রবীর সেন বললেন, ‘‘ইতিমধ্যেই মানবাজার, বাঘমুণ্ডি-সহ সবর্ত্রই সবুজ আবিরের চাহিদা বেশি। অর্ডার মোতাবেক মানবাজারে যতটা পরিমাণে লাল আবির পাঠিয়েছি, তার চারগুণ অর্ডার রয়েছে সবুজ আবিরের। বাঘমুণ্ডি থেকেও লাল আবিরের চাইতে সবুজ আবিরের চাহিদা তিনগুণ।’’ এ দিনই বাঘমুণ্ডি থেকে শহরে আবির নিতে এসেছিলেন মোতিলাল ভগত নামে এক ব্যবসায়ী। কিছুটা লাল ও বেশি পরিমাণে সবুজ আবির নিয়ে ফেরার পথে বললেন, ‘‘কংগ্রেস বা তৃণমূল যেই জিতুক সবুজ আবির তো বিক্রি হবেই। সঙ্গে লাল আবিরও থাকছে।’’

assembly election 2016 Votes result Sweets
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy