Advertisement
০৬ মে ২০২৪

প্রতীক্ষার প্রহর শেষ

উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ও শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে দেখলে মনে হবে দুজনেই খোসমেজাজে রয়েছেন। পরীক্ষার ফল যেন বুঝেই গিয়েছেন। মার্কশিট পাওয়াটা সময়ের অপেক্ষা।

কার্টুন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

কার্টুন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০১:৫৬
Share: Save:

উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ও শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে দেখলে মনে হবে দুজনেই খোসমেজাজে রয়েছেন। পরীক্ষার ফল যেন বুঝেই গিয়েছেন। মার্কশিট পাওয়াটা সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, শাসক ও বিরোধী শিবিরের অন্দরের খবর, দুই সেনাপতিরই ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না। কারণ, দুজনেই জানেন, তাঁদের শুধু নিজেদেরই জিতলে হবে না, উত্তরের ৭ জেলার ৫৪ আসনে সার্বিক ফলাফলের উপরে নির্ভর করছে দুই সেনাপতির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

কারণ, রাজ্য রাজনীতিতে ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এর অলিখিত কারিগর হিসেবে পরিচিত অশোকবাবু জানেন, উত্তরবঙ্গে আগের আসন ধরে রাখা শুধু নয়, তার চেয়ে বেশি না মিললেই ঘরে-বাইরে প্রশ্ন তোলার লোকের অভাব নেই। এমনকী, বামেদের অন্দরমহলের সূত্র বলছে, বিপর্যয় হলে দার্জিলিং শুধু নয়, উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় নেতৃত্ব বদলের দাবিও ক্রমশ জোরাল হতে পারে।

যদিও অশোক-শিবির এ ধরনের প্রশ্নকে বায়বীয় বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। বুধবার দুপুরে খোদ অশোকবাবুও বলছেন, ‘‘বেশি হিসেব করে লাভ নেই। আমাদের হারানোর কিছু নেই। আমরা তো বিরোধী দল হিসেবে লড়েছি। বেশি মানুষের আশীর্বাদ পেলে সব হিসেবই উল্টে যেতে পারে। অনেক কিছুই প্রাপ্তি হতে পারে। না হলে হারানোর কিছু নেই।’’ এর পরেই তাঁর সংযোজন, ‘যাই হোক না কেন, উত্তরবঙ্গে কোনও গোলমাল হবে না। এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মারপিট, হাঙ্গামার জায়গা নেই।’’

পক্ষান্তরে, গৌতম-শিবিরেও চলছে নানা আলোচনা। তাতে মূলত যে বিষয়গুলি প্রাধান্য পাচ্ছে তা হল, শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যা, সাফারি পার্ক, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, সেতু সহ নানা প্রকল্পে দেদার বরাদ্দের পরেও উত্তরে আগের চেয়ে ভাল ফল না হলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের ভূমিকা নিয়েও ময়নাতদন্তের দাবি উঠে যাবে দলের মধ্যেই। বারবার মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গে যাতায়াত, ক্লাবগুলিকে দেদার অনুদান, সাইকেল বিলি, কন্যাশ্রী, চা বাগানে সস্তায় চাল দেওয়ার রাজনৈতিক ফায়দা ঘরে তুলতে না পারলে সমালোচনার ঝড় তুলবে গৌতম বিরোধী শিবির। তবে গৌতমবাবু মনে করেন, ‘‘সব কিছু ঠিক থাকলে আগের চেয়ে অনেক ভাল ফল হওয়ার কথা।’’

তৃণমূল জমানায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বারেবারে উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর পরেও উত্তরের চা বলয়ের রাজনীতির হাল-হকিকত খুব একটা বদলায়নি। চা বাগানে সে ভাবে সংগঠনই গড়ে তুলতে পারেনি শাসক দল। তার উপরে মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, দার্জিলিঙে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল সামাল দিতে জেরবার হয়েছেন প্রদেশ নেতৃত্ব। সব মিলিয়ে উত্তরের জেলাগুলিতে ভোটের ফল নিয়ে আশা-আশঙ্কার ছবিটা একনজরে দেখে নেওয়া যাক ২০১১ সালের হিসেবে মোট আসন ৫৪। বাম-কংগ্রেস জোট হলে পেত ৩৩। তৃণমূল ১৬। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ৩। নির্দল ২।

দার্জিলিং

৬ বিধানসভা বিশিষ্ট দার্জিলিঙের পাহাড়ের ৩টি আসনে মোর্চাকে রোখা যে সহজ কাজ হবে না তা মানছেন অনেকেই। তবুও কালিম্পংয়ে হরকাবাহাদুর, কার্সিয়াঙে শান্তা ছেত্রী যদি লোকসভার তুলনায় বেশি ভোট আদায় করতে পারেন তা হলে পাহাড়ের আগামী পুরভোট কিংবা তার পরে জিটিএ ভোটে বাড়তি সুবিধা মেলার আশায় শাসক শিবির। জেলার সমতলের ৩টি আসনের মধ্যে ফাঁসিদেওয়া, মাটিগাড়া-নকশালবাড়িতে জোটই এগিয়ে বলে শাসক শিবিরের অনেকেই মানছেন। শিলিগুড়িতে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর মুখ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা অশোকবাবুকে ভাইচুং ভুটিয়া হারালে তা হবে অসাধ্য সাধন। খেলার মাঠে যত স্বচ্ছন্দই হন না কেন, ভাইচুং ভোটের ময়দানে যে পিছিয়ে গিয়েছিলেন সেটা দলের লোকেরাও বোঝেন।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

জলপাইগুড়ি

জেলা ভাগের পরে বিধানসভা আসন সংখ্যা ১১ থেকে কমে ৭ হয়েছে। রাজ্যে একমাত্র জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদেই বামেরা ক্ষমতা ধরে রেখেছে। পঞ্চায়েত ভোটের পরে তিন বছরে একাধিকবার দাবি করলেও, জেলা পরিষদের ক্ষমতা এখনও তৃণমূলের কাছে অধরা। তবে গত লোকসভা ভোটে জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে অবশ্য তৃণমূল জেতে। কংগ্রেসের জোট সঙ্গী ছাড়া লোকসভা আসন জেতাকে সাফল্য বলে দাবি করে থাকেন তৃণমূল নেতারা। জেলার তিন পুরসভাই বর্তমানে তৃণমূলের দখলে। তবে বিদায়ী শাসক দলের নেতারাও জানেন, বিধানসভা ভোটই ফাইনাল লড়াই। এ সড়াই না জিতলে আগের লোকসভা জেতা অথবা পুরসভা দখল করা ফিকে হয়ে যাবে। জলপাইগুড়ি যে বামেদের দুর্গ সেই ‘মিথ’কে ভেঙে দেওয়াও তৃণমূল নেতাদের কাছে এ বারের চ্যালেঞ্জ। পাল্টা চ্যালেঞ্জ বামেদেরও।

আলিপুরদুয়ার

শুধু পৃথক জেলা গঠনের কৃতিত্ব দাবি করেই হেলায় পকেটে জেলার বেশির ভাগ বিধানসভা আসন চলে আসবে বলেই তৃণমূল নেতাদের অনেকের ধারণা ছিল। যদিও ভোটের প্রচার যত জমেছে, ততই দুশ্চিন্তা ঘনিয়েছে নেতাদের কপালে। গত লোকসভা ভোটের পরে আলিপুরদুয়ার পৃথক জেলার স্বীকৃতি পায়। সদস্য সংখ্যার নিরিখে নতুন জেলা পরিষদের ক্ষমতা যায় তৃণমূলের হাতে। কাউন্সিলরদের দল বদলে আলিপুরদুয়ার পুরসভাও তৃণমূলের দখলে আসে। বিরোধীদের দাবি, সে সবই দল ভাঙিয়ে আদায় করা। এবারের ভোটেই তৃণমূল জিতে দেখানোর লড়াইয়ের মুখোমুখি। এই দাবিকে অস্বীকারও করছেন না তৃণমূল নেতারা। সে কারণেই মরিয়া তৃণমূল। জেলায় বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৫। দলের জেলা সভাপতি নিজেই আলিপুরদুয়ার আসনে প্রার্থী হয়েছেন, জেলার পুলিশ কর্তাকে ইস্তফা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিধানসভা ভোটের টিকিট দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে কম বির্তক হয়নি। বিরোধীরা কমিশনের দ্বারস্থ হলেও, প্রার্থী বদল করেনি তৃণমূল। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি প্রবীন নেতা বিশ্বরঞ্জন সরকার দীর্ঘদিন পরে ফের ভোটের ময়দানে। আলিপুরদুয়ার আসন থেকে তিনি লড়ছেন। প্রতিদ্বন্দী একদা তার-ই শিষ্য তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী। জেলা রাজনীতিতে এখন প্রশ্ন, শেষমেষ মান বাঁচবে কার? গুরু না শিষ্যের?

কোচবিহার

লড়াই শুধু বাইরে নয়, ঘরেও। গত বিধানসভা এবং লোকসভায় উত্তরবঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর অন্যতম ভরসা ছিল কোচবিহার। তারপরে তোর্সা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে, নদী খাতে জমেছে পলিও। এবারে কোচবিহার বিধানসভা ভোটের আগে জেলায় এসে ৬টি সভা করেছেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভোটের দিন লাগোয়া চালসায় ছিলেন তিনি। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল কোচবিহার দখল করতেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। তবে তৃণমূল নেতাদের দাবি, লড়াই তো চলছে ঘরেও। তৃণমূল সূত্রের খবর, কমলগুহ পুত্র উদয়নবাবু দলে আসবেন তা দলের দাপুটে জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ চাননি। আবার এমন অনেকে টিকিট পেয়েছেন যাঁদের রবিবাবু চাননি, দলের প্রার্থীদের অনেকেই নাকি রবিবাবু তথা দলের জেলা সংগঠনের সাহায্য পাননি। তাই দলে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। তাই নাকি ভোটের দিন দুপুরে মেজাজ হারিয়েছেন রবিবাবু। চড় কষিয়েছিলেন নিজেরই অনুগামীর গালে।

মালদহ

জেলায় এসে গনিখানের নামে ভোট চাইতে হয় তৃণমূল নেত্রীকেও। তবে গনি পরিবারে ভাঙন ধরিয়েও লোকসভা ভোটে রান তুলতে পারেনি তৃণমূল। এ বারেও তৃণমূলের লক্ষ্য পিচ আকড়ে রেখে যত সম্ভব রান তোলা। যদিও, পিচ যে গর্তে ভরা। গত লোকসভা ভোটে প্রচার সেরে হেলিকপ্টারে ওঠার আগে তৃণমূল নেত্রী প্রকাশ্যেই জেলা নেতাদের গোষ্ঠী বিবাদ না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপরেও বারবার প্রকাশ্যে এসেছে দলের বিরোধ। সরকারি মঞ্চে দুই মন্ত্রীর কাজিয়া দেখেছে মালদহের বাসিন্দারা। তার প্রভাব ভোটে কতটা পড়বে তা নিয়ে চিন্তায় দলের কর্মী-সমর্থকরা। সেইসঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোটের মিছিলে ভিড়ও অনেককে চমকে দিয়েছে।

উত্তর দিনাজপুর

বৌদি লড়তে গিয়েছেন দিদির ডেরায়। জেলা সামলাচ্ছে বৌদির অনুগামীরা। জেলার লড়াই তাই বৌদির কাছেও ‘প্রেস্টিজ’ লড়াই। জেলায় এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল না হওয়া নিয়ে লাগাতার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিঁধেছেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্ত্রী কংগ্রেস কর্মীদের কাছে ‘বৌদি’ নামে পরিচিত দীপাদেবী। এ বারে বিধানসভায় দীপাদেবী ভবানীপুর আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন। তবে জেলাতেও প্রচার চালিয়েছেন। ভবানীপুরের ফল যাই হোক না কেন, নিজের ভিটে দখলে রাখাই কংগ্রেসিদের চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে তৃণমূলের লড়াই আসন বাড়ানো। তৃণমূল নেতাদের দাবি, গত বিধানসভার দু’টি থেকে আসন বাড়াতে না পারলে তৃণমূল নেতাদেরও জবাবদিহি করতে হবে দলনেত্রীর কাছে।

দক্ষিণ দিনাজপুর

ভোটের আগে তৃণমূল প্রার্থীর ওপরে গুলি বোমা নিয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছিল জেলায়। অভিযোগের তিরও ছিল তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধেই। জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘আমাদের বিরোধীদের বাইরে থেকে আনতে হয় না।’’ ভোটের কিছু দিন আগে দলের জেলা সভাপতি বদল করেছিল তৃণমূল। তাতেও যে কোনও ফল মেলেনি তার প্রমাণ ভোটের কয়েকদিন আগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে গুলি-বোমা। ভোটের পর থেকে শুরু হয়েছে, কে, কোথায় কাকে হারাতে কী করেছেন তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে অভিযোগের অন্ত নেই। গতবার বিধানসভায় একটি আসন না পেলেও, জোটের আবহে এবারে উজ্জীবিত কংগ্রেস শিবির। তাতে বল পেয়েছে বামেরা। ফের শঙ্কর চক্রবর্তী না বিশ্বনাথ চৌধুরী কার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা সফল হবে তার উপরেই নির্ভর করছে অনেক কিছুই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Vote result
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE