Advertisement
০২ মে ২০২৪

ভূত তাড়াতে ভরসা জোটই, বার্তা সভার

এসেছি, বেশ করেছি! নিয়ামতপুরের ভিড়ে-ঠাসা মাঠে জোর গলায় বললেন বংশগোপাল চৌধুরী। আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদের যুক্তি, ‘‘আমাদের প্রবীণ নেতা বামাপদ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে অর্পণকে খুন করা হয়েছিল। তার মা এক মাসের মধ্যে মারা গেলেন।

এক মঞ্চে। সিপিএম নেতা বংশগোপাল চৌধুরীর সঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। শনিবার কুলটিতে। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।

এক মঞ্চে। সিপিএম নেতা বংশগোপাল চৌধুরীর সঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। শনিবার কুলটিতে। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।

সন্দীপন চক্রবর্তী
আসানসোল শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪০
Share: Save:

এসেছি, বেশ করেছি!

নিয়ামতপুরের ভিড়ে-ঠাসা মাঠে জোর গলায় বললেন বংশগোপাল চৌধুরী। আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদের যুক্তি, ‘‘আমাদের প্রবীণ নেতা বামাপদ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে অর্পণকে খুন করা হয়েছিল। তার মা এক মাসের মধ্যে মারা গেলেন। এই সব মৃত্যুর বিচার পেতে হবে না? নিজেদের মধ্যে বিরোধ পরে। সবাই মিলে আগে এই সরকারকে হটাতে হবে। তাই এখানে এসেছি, বেশ করেছি!’’ তাঁর ঝাঁঝালো ভাষণের মানে বুঝলেন কি না, জানা নেই। কিন্তু বংশগোপালের দিকে তখন সপ্রশংস দৃষ্টি রাহুল গাঁধীর।

সেই বংশগোপাল! কয়েক মাস আগে আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে যাঁকে দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে সংশয় তুলিয়েছিল বর্ধমান জেলা সিপিএম। রাহুলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে শনিবার সেই বংশগোপাল বললেন, ‘‘সে সব পুরনো কথা। এখন তো পার্টির সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। আর রাহুল এখানে যা বলে গেলেন, এর পরে জোটের কাজে কোথাও কোনও বাধাই থাকবে না!’’

এ কি নেহাতই সমাপতন? নাকি সূর্যকান্ত মিশ্র-অধীর চৌধুরীদের পাকা চাল! রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রচারে এসে কংগ্রেস সহ-সভাপতির দৌড় শুরু করানো হল বর্ধমান জেলা থেকে। সিপিএমের অন্দরে জোট-বিরোধী বলে পরিচিত জেলার নেতাদের রাহুলের মঞ্চে উপস্থিত করানো হল। আর লাল ঝান্ডা নিয়ে মাঠ ভরিয়ে রাহুলের নামে স্লোগানে গলা মেলালেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। জোটের জন্য এর চেয়ে জোরালো বাতাবরণ আর কিছু ভাবা সম্ভব নাকি!

জোট-বার্তাকে জোরালো করতে এ দিন কোনও খামতিই রাখেননি রাহুল। কংগ্রেস কর্মীদের সরাসরিই বলেছেন, ‘‘আপনারা এই কয়েক বছরে অনেক মার খেয়েছেন, সহ্যও করেছেন। এখন বামফ্রন্ট নেতা-কর্মীদের নিয়ে হাত ধরে এলাকায় এলাকায় যান। বলুন, এই একনায়কের সরকার সরিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে তুলব।’’ আসানসোলের নিয়ামতপুর, বাঁকুড়়ার তামলিবাঁধ বা দুর্গাপুরের কল্পতরু মাঠ— যেখানে যখনই জোটের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন রাহুল, গর্জন করেছে তেরঙা ও লাল ঝান্ডাধারী জনতা। চৈত্রের তাপ তো নয়, যেন তরল রোদ্দুর পড়ে পুড়ে যাচ্ছে গা! তবু জনতা দাঁড়িয়ে! দু’দলের ঝান্ডা একই সঙ্গে লাগিয়ে গাড়ি এসেছে। মাঠের বাইরে একই চাটাইয়ে কার্ল মার্ক্স, লেনিন, জ্যোতি বসুর সঙ্গে ইন্দিরা ও রাজীব গাঁধীর ছবি পাশাপাশি বিক্রি হয়েছে! বঙ্গ রাজনীতিতে এ দিনটা বিরল কত দৃশ্যের জন্মদিন!

প্রকাশ্যে বার্তা তো দিয়েছেনই। স্বল্প সময়েই এ দিন নিজের মতো করে জোটের অগ্রগতির খবরও নিয়েছেন রাহুল। তিন জায়গাতেই আশেপাশের এলাকার বাম প্রার্থীদের প্রত্যেকের নাম করে সম্ভাষণ করেছেন। মঞ্চে তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে কথাও বলেছেন। জামুড়িয়ার সিপিএম প্রার্থী জাহানারা খান যেমন বলছিলেন, ‘‘এলাকায় কেমন ভাবে দু’পক্ষের কর্মীরা কাজ করছেন, জানতে চাইছিলেন। আমি বর্তমান বিধায়ক শুনে বললেন, তা হলে তো আপনি আরও ভাল জানবেন!’’ একই ভাবে পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও এলাকার পরিস্থিতি খোঁজ নিয়েছেন। কথা বলেছেন কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ আচার্য, ইন্দ্রাণী মিশ্র বা বিশ্বনাথ পাড়িয়ালদের সঙ্গেও। বারেবারেই বলেছেন, তৃণমূল যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে জোটই পারবে অপশাসনের ভূত তাড়াতে!

রাহুলের কথায়, ‘‘এলাকায় থেকে মার খেয়েছেন কংগ্রেস কর্মীরা। আমি তাই ভোটের আগে তাঁদের মতামতই জানতে চেয়েছিলাম। রাহুল গাঁধী কী বলল, সেটা বড় কথা নয়! কর্মীরাই বলেছেন, তাঁরা একনায়কতন্ত্রের অবসান চান আর বামেদের সঙ্গে বোঝাপড়া চান। সেটাই হয়েছে।’’ ভোটে জিতলে তাঁরা যে জোট সরকার চান এবং সেই সরকারের হাতে তৃণমূলের দুর্নীতির বিচার ও রাজ্যের স্বার্থে শিল্পায়ন, উন্নয়ন চান— তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাহুল।

বস্তুত, কংগ্রেসের প্রার্থীরা দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধা বাম প্রার্থীদের প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন, এমন ঘোষণার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হল এ দিনই। রাহুলের পাশাপাশি এআইসিসি-র তরফে এ রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সি পি জোশী, পরেশ ধনানি, রামচন্দ্র কুন্তিয়ারাও জোটের সমর্থনে মুখ খুলেছেন। যার ফলে নিচু তলায় এগিয়ে যাওয়া জোটে উপর মহলের সিলমোহর দৃঢ় হয়ে বসেছে এ দিন। পিডিএসের সমীর পুততুণ্ড এ দিনই আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে যে বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রার্থী শক্তিশালী, তাঁকেই ভোট দেওয়ার।

তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় যদিও বলছেন, ‘‘সিপিএমের হাতে তামাক খাওয়ার ব্যবস্থা করে গেলেন রাহুল! সাঁইবাড়িতে গিয়ে কংগ্রেস কর্মীদের সিপিএমকে ভোট দেওয়ার কথা বলতে পারতেন!’’ কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী তৃপ্ত— ‘‘জোটে এখন মানুষের ঢল নেমেছে। কত সন্ত্রাস করবে তৃণমূল?’’

জন্মদিনে মসৃণ জোটের উপহারের চেয়ে বেশি তৃপ্তি আর কী-ই বা হতে পারতো প্রদেশ সভাপতির জন্য!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE