Advertisement
E-Paper

সর্ষেতেই ভূত দেখছে শাসকদল

পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ, এলাকায় বিরোধীদের নামগন্ধ নেই। রাত থেকে বাছাই করা কিছু বাড়িতে গিয়ে ‘অপারেশনে’ নেমে পড়েছিল বাইক বাহিনীও। বুথমুখী বিরোধীদের রুখতে বোমা হাতে শুরু হল ‘অ্যাকশন’ও।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৫২
মঙ্গলকোটের ভোটে নজর, নজরবন্দি অনুব্রতর। নিজস্ব চিত্র।

মঙ্গলকোটের ভোটে নজর, নজরবন্দি অনুব্রতর। নিজস্ব চিত্র।

পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ, এলাকায় বিরোধীদের নামগন্ধ নেই। রাত থেকে বাছাই করা কিছু বাড়িতে গিয়ে ‘অপারেশনে’ নেমে পড়েছিল বাইক বাহিনীও। বুথমুখী বিরোধীদের রুখতে বোমা হাতে শুরু হল ‘অ্যাকশন’ও। কিন্তু সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা পাল্টা মার দিতেই পিছু হঠতে বাধ্য হল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।

আর ওই ঘটনার পরেই কেতুগ্রামে সিঁদুরে মেঘ দেখছে শাসকদল। দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে উঠছে সিপিএমকে ‘মদত’ দেওয়ার নালিশ। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, ওই কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থীর নাম শেখ সাহানেওয়াজ। লাগোয়া নানুরের বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা কাজল শেখের দাদা। যে কাজল শেখের ‘দাপটে’ তৃণমূল নানুরের প্রায় ৫০টিরও বেশি বুথে দীর্ঘ ক্ষণ কোনও এজেন্টই বসাতে পারেনি। অভিযোগ, তাঁরই মদতে হারিয়ে যাওয়া সিপিএমকে নানুরে ফের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সেই কাজলই কেতুগ্রামে দাদাকে ফের জেতাতে উঠে পড়ে লেগেছেন।

বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফার ভোটে সেখানেই দেখা গেল উল্টো ছবি। সিপিএম এই কেন্দ্রের প্রায় ৫০টি বুথে এজেন্ট দিতে পারল না ঠিকই। তবে, বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূলকে পাল্টা মারও দিল সিপিএম। যা দেখে ওই কেন্দ্রে ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেতুগ্রাম ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহের শেখ বলেই দিলেন, ‘‘এখানে আমরাই সব জায়গায় ক্ষমতায় রয়েছি। তা সত্ত্বেও সিপিএম যে ভাবে আমাদের কর্মীদের উপরে হামলা চালানোর সাহস পেয়েছে, তার পিছনে দলের কারও না কারও মদত তো রয়েইছে।’’ কার মদত? তিনি নিশানা করেছেন সাহানেওয়াজের বিরোধী বলে পরিচিত তৃণমূল নেতা সাউদ মিঁয়াকে। যিনি আবার এলাকার রাজনীতিতে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী বলেই পরিচিত। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, এই সাউদকেই অনুব্রত (যিনি দলের তরফে বর্ধমানের কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট ও আউশগ্রাম কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক) কেতুগ্রাম ১ ব্লক সভাপতি করেছিলেন। যদিও কেষ্টর সিদ্ধান্ত উড়িয়ে দিয়েই সাহানেওয়াজ তাঁর ঘনিষ্ঠ তরুণ মুখোপাধ্যায়কে ব্লক সভাপতির দায়িত্ব দেন। কাজল-সাহানেজওয়াজ অনুগামীদের দাবি, নানুরের ‘পাল্টা’ দিতেই এ দিন সিপিএমকে মদত জোগানোর চেষ্টা করেছে নিজেকে ‘অনুব্রতর লোক’ বলে দাবি করা সাউদ।

বিরোধীদের অভিযোগ, বুধবার রাতেই উমরপুর-মুরগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে বহিরাগত মোটরবাইক বাহিনী এসে হুমকি দিয়ে যায়, যারা সিপিএম করে তাদের বুথে যাওয়ার দরকার নেই। ওই নির্দেশ উপেক্ষা করেই বুথমুখী হন হাটমুড় গ্রামের সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা। সেই অপরাধে এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা বুথের কাছেই তাদের উপরে বোমাবাজি করে বলে অভিযোগ। স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, তৃণমূলের লোকেরা বোমাবাজি করে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের হঠিয়ে বুথ দখলের চেষ্টা করে। পরে আরও লোকজন জড়ো করে ওই এলাকায় ফের বোমাবাজি করে তৃণমূলের লোকেরা বাম কর্মী-সমর্থকদের ভোট কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ। ঘটনায় লাল চৌধুরী এবং সেন্টু শেখ নামে দুই সিপিএম কর্মী জখম হয়ে কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি। লালের কান ফেটে গিয়েছে, বোমা লেগেছে সেন্টুর পায়ে। একই ঘটনায় মজুর শেখ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।

এ দিন বুথের কাছে ওই সংঘর্ষের জেরে অনেকেই ভোট দিতে পারেননি। নিজেদের সিপিএম সমর্থক হিসাবে দাবি করে ওই গ্রামেরই সত্তর বছরের হারিফান বিবি, হারাধন শেখরা বলেন, ‘‘বুধবার রাতেই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা শাসিয়ে গিয়েছিল, আমরা যেন ভোট দিতে না যাই। তা অগ্রাহ্য করে লাল যখন ওর মাকে নিয়ে ভোট দিয়ে ফিরছিল। তখনই ওরা আচমকা চড়াও হয়ে বোমাবাজি শুরু করে। আমরা কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে বুথ থেকে পালিয়ে আসি।’’ ঘটনার খবর পেয়ে বেলা ১২টা নাগাদ ওই বুথে যান কেতুগ্রাম কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক এমজু পাঞ্জার। তিনি দীর্ঘ ক্ষণ ওই বুথ চত্বরেই পুলিশ-প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করেন। ঘটনা হল, ওই এলাকায় পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েত এমনকী ওই গ্রামের পঞ্চায়েতের তিনটি আসনও তৃণমূলের দখলে। তার পরেও কী করে সিপিএম তৃণমূলের সঙ্গে সমানে টক্কর দেওয়ার অবস্থায় পৌঁছল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে শাসকদলের অন্দরেই। নানুরের মতোই এ ক্ষেত্রে দলেরই গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বকে নিশানা করছে অনেক তৃণমূল নেতাই। এক সময়ে কেতুগ্রামের প্রার্থী পদের প্রত্যাশী ছিলেন অনুব্রত অনুগামী তথা তৃণমূলের নানুর ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য। কিন্তু দলনেত্রীর বিশেষ স্নেহধন্য হওয়ায় টিকিট পান শেখ সাহানেওয়াজ। কাজলের সঙ্গে ‘তিক্ততা’র সুবাদে অনুব্রতও চাননি এ বার সাহানেওয়াজ প্রার্থী হোক। কিন্তু, গতবারের বিজয়ী হিসাবে ফের সাহানেওয়াজকেই প্রার্থী করা হয়। তাই নানুরের বদলা নিতেই কেতুগ্রামে সাহানেওয়াজের বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ উঠছে অনুব্রত-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

সাউদের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। তবে, অনুব্রত অনুগামী নানুরের এক শীর্ষ স্তরের নেতা নামপ্রকাশ না করার শর্তে খোলাখুলিই বলছেন, ‘‘দল পাপুড়ির বহু জায়গায় এজেন্ট দিতে পারেনি। তার জন্য সাহানেওয়াজই পরোক্ষে দায়ী। তারই বদলা নিতে কেষ্টদার কেতুগ্রামের অনুগামীরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে সিপিএমকে মদত দিয়েছে।’’ তাঁর দাবি, দলের অন্দরেই সাহানেওয়াজকে হারাতে এ দিন কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা হয়েছে বলে দাবি করছেন কাজলের এক ঘনিষ্ঠ অনুগামীও।

এ দিকে, ‘অন্তর্ঘাতে’র তত্ত্ব পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি সাহানেওয়াজ নিজেও। তবে, তাঁর বক্তব্য, ‘‘মানুষ উন্নয়ন দেখেই ভোট দিয়েছে। এখানে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের ব্যাপার নেই। তবে কেউ কেউ বিরুদ্ধে ভোট করলেও করতে পারে। আমরা দলীয় স্তরে তা পর্যালোচনা করে দেখব।’’

যদিও নানুর-কেতুগ্রাম, কোথাও-ই দলের মধ্যে কোন্দল নেই বলে এ দিন দাবি করেছেন অনুব্রত। তাঁর সাফ জবাব, ‘‘নানুর, কেতুগ্রাম-সহ আমার দায়িত্বে থাকা ১৬টি কেন্দ্রেই জিতব। কেতুগ্রামে ২০ হাজার ভোটে জিতব।’’

TMC assembly election 2016 Anubrata Mondal Ketugram
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy