তারার মেলা। খেলা শুরুর আগে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রয়েছেন ওয়াকার ইউনিস, ওয়াসিম আক্রম, ইমরান খান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গাওস্কর, সচিন তেন্ডুলকর, বীরেন্দ্র সহবাগ ও অমিতাভ বচ্চন। শনিবার ইডেন গার্ডেন্সে উৎপল সরকারের তোলা ছবি।
নিজের কথা শেষ করেও মাইকটা কিন্তু ছাড়েননি। শক্ত হাতে ধরে রেখে ফুট দুয়েক এগিয়ে এলেন। শ্বাস নেওয়ার বিরতিটুকু পর্যন্ত না নিয়ে বললেন, ‘‘অমিতাভজি, আপ আইয়ে। দো চার বাত কহিয়ে!’’ হর্ষ ভোগলে নয়, সঞ্চালক যেন তিনিই! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! ঠিক যে ভাবে তৃণমূলের দলীয় কর্মসূচি থেকে টেলি সম্মান বা মাটি উৎসব মঞ্চ— সবেরই ‘কন্ট্রোল’ নিজের হাতে তুলে নেন, হুবহু সেই ভঙ্গি!
নবান্নে বসে বারবারই খোঁজ নিচ্ছিলেন, ‘‘দেখুন বৃষ্টি থামল কি! এই অরূপ খোঁজ নে, মাঠের কী অবস্থা! ঠিক সাতটায় পৌঁছব বলেছি।’’ ইডেনের সবুজ গালিচায় যখন পা রাখলেন, ফ্লাড লাইটের চড়া আলোয় সাদা শাড়িটা যেন আরও খুলেছে! মেঘ কেটে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার স্বস্তি চোখে মুখে! দ্রুত পৌঁছে গেলেন বাউন্ডারি লাগোয়া পোডিয়ামে। হর্ষ শুরুতে ডেকে নিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকরকে। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে মাইক পৌঁছল তার পর। সময় কম। গ্যালারির দিকে চোখ তুলে বললেন, ‘‘ভাল আছেন সব্বাই! সবাইকে অভিনন্দন। ইমরান, ওয়াসিম, ওয়াকার, সচিন আপনাদের ধন্যবাদ। এই ম্যাচ কলকাতায় নিয়ে আসার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। দয়া করে ফাইনালটাও এখানে করুন। প্রতি বার এখানে আসুন। কলকাতায়। আমরা সব রকম ব্যবস্থা করব।’’
প্রথম দফার ভোট গ্রহণ শুরু হতে হিসেব কষে পনেরো দিন বাকি। তার আগে ষাট হাজার দর্শকে ঠাসা গ্যালারির সামনে এই মঞ্চ পেয়ে যাওয়া প্রতিপক্ষের মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তোলার মতোই। শুধু কি গ্যালারি! বাংলার ঘরে ঘরে অসংখ্য চোখ তখন এই ছবিতেই নিবদ্ধ। রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন মানুষেরও বুঝে নিতে অসুবিধা হল না, পড়ে পাওয়া সুযোগের তলানিটুকু পর্যন্ত শুষে নিতে চাইলেন তৃণমূলনেত্রী!
পড়ে পাওয়াই! কারণ বাস্তবটা হল, এক রকম মমতার সামনে এই বলটা তুলে দিয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহ। আইসিসি গোড়ায় ম্যাচটা ধর্মশালায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে বাদ সাধেন বীরভদ্র। যদিও আসল কারণটা অন্য। দিল্লি এবং হিমাচলের রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, বিজেপি নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রেমকুমার ধুমলের ছেলে তথা হিমাচল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মাথা অনুরাগ ঠাকুরকে ‘সবক’ শেখাতেই এই গোঁ ধরেন বীরভদ্র। আর বীরভদ্র আপত্তি করতেই ত্বরিতে সুযোগটা নিতে নেমে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা বিসিসিআইয়ের অন্যতম কর্তা অরুণ জেটলির কাছে সরাসরি অনুরোধ জানান, ম্যাচটা যাতে কলকাতায় আসে। সংসদের সেন্ট্রাল হলে বসে সকলের সামনে সে কথা নিজেই জানিয়েছেন অরুণ। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, হতে পারে মমতার অনুরোধ আইসিসি-র কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন জেটলি। আবার এ-ও হতে পারে, ধর্মশালায় ম্যাচ বাতিল হওয়ার পরে এই ম্যাচের যে দু’টি নিশ্চিত গন্তব্য ছিল, তার একটি ইডেন। অন্যটি মোহালি। কারণ যা-ই হোক, ভোটের আগে ভারত-পাক ম্যাচ এলো কলকাতায়।
প্রশ্ন হল, কলকাতায় ভারত-পাক ম্যাচ আনার জন্য তৃণমূলনেত্রীর এত আগ্রহের কারণ কী?
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, এক তো কলকাতায় এই ম্যাচটা নিয়ে আসাকেই মমতার একক কৃতিত্ব হিসেবে ভোটে তুলে ধরবে তৃণমূল। নেপথ্যে তার থেকেও বড় কৌশল হল, কলকাতায় এই ম্যাচ নিয়ে এসে ভোটের আগে রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষকে খুশি করা। সেই কারণে আজ মমতার মুখে বারবার উঠেছে ইমরান, ওয়াকার, ওয়াসিম আক্রমের নাম।
তৃণমূলনেত্রীর এই রাজনৈতিক কৌশলের সাম্প্রতিক আরও একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে। মুম্বইয়ে পাক সঙ্গীত শিল্পী গুলাম আলির অনুষ্ঠানে বাগড়া দিয়ে শিবসেনা যখন সর্বত্র তুমুল হইচই ফেলেছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের মন পেতে তখন সেই সুযোগটাও কাজে লাগাতে ছাড়েননি মমতা। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সরকারি খরচে গুলাম আলির অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল নবান্ন। সে দিনও মঞ্চের ‘কন্ট্রোল’ ছিল নেত্রীর হাতেই! প্রায় গোটা মন্ত্রিসভা উঠে গিয়েছিল নেতাজি ইন্ডোরে। আর তার সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল বেশ কিছু চ্যানেলে। ঠিক আজকের মতো!
যদিও মমতার এই কৌশল প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আজ বলেন, ‘‘কলকাতায় ভারত-পাক ম্যাচ হচ্ছে, খুবই ভাল কথা। কিন্তু এতে মমতার কোনও কৃতিত্ব নেই। তা ছাড়া মাঠে উপস্থিত থেকেই মুখ্যমন্ত্রী যদি ভেবে থাকেন, তিনি সংখ্যালঘুদের মন কেড়ে নিলেন, তা হলে ভুল ভাবছেন। কেন না বাংলার সংখ্যালঘু ভাই-বোনেদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। তা ছাড়া বাংলার সংখ্যালঘুরা এও বুঝে গেছেন, তাঁদের রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে মমতা নজর দেননি। শুধু লোক দেখানো ঘোষণা আর কিছু ইমাম ভাতা দিয়ে তাঁদের কিনে নিতে চেয়েছেন!’’ মমতাকে টিপ্পনি কেটে অধীরের মন্তব্য, ‘‘চোখে নেই পানি, কাঁদছে আমার নানি!’’
মুখে এ সব কথা বললেও কংগ্রেস নেতাদের কি একটুও ঈর্ষা হচ্ছে না মনে মনে? বিভীষণ বলে গালমন্দ করছেন না বীরভদ্রকে? কারণ, তাঁর জন্যই তো এমন হল! পিচে বল পড়ার আগেই তৃণমূল নেতারা বলতে শুরু করে দিলেন, খেলা জমে গেছে! যদিও তৃণমূলেরই অনেক নেতার আবার প্রশ্ন, এ ভাবে মাঠে যাওয়া আবার নির্বাচনবিধি ভঙ্গের আওতায় পড়ে যাবে না তো? এক নেতার কথায়, ‘‘ভোটের সময় বিয়েবাড়ি যাওয়াও বিধিভঙ্গের আওতায় পড়ে। আর এ ভাবে, এত লোকের সামনে! কে জানে!’’
তবে বিরোধীদের স্বস্তি দিতেও যেন তোলা ছিল কিছু! শুরুতে হর্ষ ভোগলে যখন সচিনকে ডেকে নিলেন, গর্জনে ফেটে পড়ল ষাট হাজারি ইডেন। তার পর হর্ষ বললেন,‘‘আরও একটা গর্জন শোনা যাবে এ বার।’’ কিন্তু ততটা গর্জন হল কি? ডেসিবল একটু কম মনে হল না? আবার অমিতাভ হাতে মাইক নিতেই ফের সেই গগন কাঁপানো উল্লাস গ্যালারি থেকে! যা দেখে এক বাম নেতার কটাক্ষ, ‘‘দিদি ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন ঠিকই। কিন্তু রান উঠল কি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy