Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

নজর কাড়লেন নজরবন্দিরাই

এক জন সকালে গর্জালেন, দুপুরে পালালেন এবং বিকেলে পুলিশের জালে ধরা পড়লেন। অন্য জন সকাল থেকেই নজরবন্দি রইলেন ফ্ল্যাটের ভিতরে। সারা দিনে এক বারও দলীয় ক্যাম্পে পর্যন্ত হাজির হলেন না।

তখনও পুলিশ ধরেনি। বাড়ির সামনে আনোয়ার খান।ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

তখনও পুলিশ ধরেনি। বাড়ির সামনে আনোয়ার খান।ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৩৩
Share: Save:

এক জন সকালে গর্জালেন, দুপুরে পালালেন এবং বিকেলে পুলিশের জালে ধরা পড়লেন।

অন্য জন সকাল থেকেই নজরবন্দি রইলেন ফ্ল্যাটের ভিতরে। সারা দিনে এক বারও দলীয় ক্যাম্পে পর্যন্ত হাজির হলেন না।

অথচ কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভার ভোট কার্যত হল এই দু’জনেরই অঙ্গুলিহেলনে!

প্রথম জন কাশীপুরের তৃণমূল নেতা আনোয়ার খান। অন্য জন কাশীপুরেরই আর এক দাপুটে শাসক নেতা স্বপন চক্রবর্তী। আনোয়ারের নির্দেশ ছিল, নিজেদের ‘তরিকা’য় ভোট করাতে হবে। স্বপন অবশ্য নিজের ছক খোলসা করেননি। তবে তাঁর অনুচরদের বক্তব্য, বিরোধীদের চমকে দেওয়ার কাজ হয়ে গিয়েছিল বুধবার রাতেই। বৃহস্পতিবার শুধু ‘ফিনিশিং টাচ’ দেওয়া হয়েছে। সে সব বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে ফোনেই সেরে ফেলেছেন স্বপন। একই অভিযোগ জোট প্রার্থী কণীনিকা ঘোষেরও। এ দিন সকালে তিনি বলেন, ‘‘এখন নজরে রেখে কী হবে? যা করার তা কাল রাতেই করে দিয়েছে।’’

পুলিশ অবশ্য বৃহস্পতিবার সকালে জানিয়েছিল, নিরপেক্ষ ভোটের জন্য স্বপন এবং আনোয়ার দু’জনকেই নজরবন্দি করা হয়েছে। কিন্তু সেই নজরদারির বাস্তব চিত্র, স্বপনের আবাসনের মূল ফটকের বাইরে দু’জন নিরস্ত্র পুলিশ মোতায়েন। আর নজরদারি কতটা ঠুনকো তা এ দিন হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন আনোয়ার। সকাল থেকে দুই পুলিশকে নিয়ে রাস্তায় বসে ভোট নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। সে সময়ই ফোনে শাগরেদদের উদ্দেশে তাঁর নির্দেশ, ‘‘কাশীপুরমে বেশি ভোট হোনা চাইয়ে। কমিশনকে মুহ মে জুতা মারো। কমিশনকে মুহ মে কালি-চুনা লাগা দো।’’ যদিও লালবাজারের দাবি, আনোয়ারকে নজরবন্দি করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে তাকে সাধারণ নজরদারির মধ্যেই রাখা হয়েছিল। তাঁর বাড়ির ১০০ মিটার দূরে পুলিশ পিকেট ছিল। ভোট দিতে বেরিয়ে তার পরে তিনি আর বাড়ি ফেরেননি।

এই আনোয়ার-বাণী ছড়িয়ে পড়ার পরেই বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ কমিশনের পক্ষ থেকে কড়া পদক্ষেপ করতে বলা হয় লালবাজারকে। কিন্তু কোথায় আনোয়ার? পুলিশি নজরদারি এড়িয়ে তত ক্ষণে তিনি উধাও। নজরদারির ভিতর থেকে কী ভাবে তিনি উধাও হয়ে গেলেন? সদুত্তর দিতে পারেননি ডিসি (নর্থ) শুভঙ্কর সিংহ সরকার। বিকেল সাড়ে তিনটেয় পুলিশ জানায়, দমদমের সেভেন ট্যাঙ্কস এলাকা থেকে আনোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

উপনির্বাচন কমিশনার সন্দীপ সাক্সেনা বলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি যা বলেছেন সেই সম্পর্কে কমিশন অবহিত। আনোয়ারকে আগে থেকেই নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আজ কমিশন বিষয়টি জানতে পারার পরেই তাঁকে গ্রেফতার করে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।’’

যদিও পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, মোটরবাইকে চেপে কাশীপুর এলাকা থেকে চম্পট দিয়ে আনোয়ার হেদুয়া এলাকায় এক মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশ চাপ দিয়ে তাঁকে কার্যত আত্মসমর্পণ করিয়েছে। এ দিন লালবাজারে যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা করে তার পরে আনোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ কিন্তু আনোয়ারের অনুচরদের আটকানো গিয়েছে কী?

কাশীপুর এলাকা বলছে, ‘দাদা’ যতই গারদে থাকুন না কেন, দিনভর উদ্যানবাটী থেকে বিবিবাজার, বুথে বুথে ‘ভাইয়েরা’ নিশ্চিন্তেই কাজ সেরেছে। যে ভাইদের কর্মকুশলতার উপরে নির্ভর করে আনোয়ার সকালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘এ বার পাঁচ হাজার ভোট বাড়বে।’’

আর স্বপনের ‘ফিনিশিং টাচ’ কেমন?

কাশীপুরের হরিশঙ্কর বাণীপীঠে বিরোধী এজেন্টদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের ভিতরে অনাগতদের জড়ো হতে দেখা গিয়েছে। পুলিশ হাউজিং এস্টেটের স্কুলে আশপাশে সন্দেহজনকদের জড়ো হতে দেখা গিয়েছে। পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী তাদের সরায়নি। ভোটার না থাকলেও মাঝেমধ্যে দোতলা থেকে ইভিএম টেপার আওয়াজ এসেছে। শেষ বেলায় চা-সিগারেট দেওয়ার নাম করেও আকছার লোক বুথে ঢুকেছে। যদিও এ দিন নিজের ফ্ল্যাটে বসে স্বপনের দাবি, ‘‘আমি বাঘ-ভল্লুক নই। ভোট শান্তিতেই হবে।’’ এবং তাঁর সংযোজন, ‘‘এ বার একটা সূচ পড়ারও শব্দ হবে না।’’

বিরোধীরা বলছেন, সিঁথি, পাইকপাড়াতেও দিনভর দাপিয়েছে শাসক দলের গুন্ডা বাহিনী। বিকেলে সাউথ সিঁথিতে শাসক দল ঘনিষ্ঠ দুষ্কৃতী খোকন শীট এবং বাপি গুহ-র নেতৃত্বে বাইকবাহিনী সিপিএম ক্যাম্পে এসে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখায় বলে অভিযোগ। টহলদারি পুলিশ তাদের সরিয়ে দিলেও গ্রেফতার করেনি। কাঠগোলাতেও বিরোধীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। কালীমাঠেও শাসক দলের ক্যাম্প থেকে ভোটারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

বিরোধীরা বলছেন, ৩ নম্বর ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে সকাল থেকেই দাপিয়ে বেড়িয়েছে তৃণমূল কাউন্সিলর গৌতম হালদারের দলবল। ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই দমদমের কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউশন (ব্রাঞ্চ) এবং গভর্নমেন্ট স্কুল ফর গার্লস-এ গোলমালের অভিযোগ পেয়ে হাজির হয় পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনী। অভিযোগ, কোথাও কোথাও তিনি নিজেও লোকজন নিয়ে ভোটারদের হুমকি দিয়েছেন। এই অভিযোগকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে গৌতমবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমি কেমন তা স্থানীয়েরা জানেন। আমি কোনও বুথের কাছে গিয়েছি, এটা দেখাতে পারবেন?’’ রিগিং-সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী মালা সাহা বলেন, ‘‘ঠান্ডা ঘরে বসে অসত্য অভিযোগ করাই যায়। একটাও প্রমাণ দেখাতে পারবেন?’’

দিনের শেষে অবশ্য হাল ছাড়ছেন না জোটপ্রার্থী। তাঁর কথায়,‘‘কাশীপুরে ভোট লুঠের পরেও মানুষ যতটা ভোট দিয়েছেন তার বেশিটা আমরাই পাব।’’ আর তৃণমূল প্রার্থীর মালা সাহার কথায়,‘‘আমরা পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছি। তাই ভাল ফল করার ব্যাপারে আশাবাদী।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC election commission
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE