Advertisement
০৪ জুন ২০২৪

পোস্তার ভাঙা পুলে পৌষ মাস রাহুলের, সমস্যায় স্মিতা

একটুর জন্য উড়ালপুল দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন রাহুল সিংহ! আর একটুর জন্যই সেই উড়ালপুল যেন ভেঙে পড়েছে স্মিতা বক্সীর মাথায়! কপাল খুলে গিয়েছে রাহুলবাবুর!

রোশনী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৫
Share: Save:

একটুর জন্য কত কিছু হয়নি!

একটুর জন্য উড়ালপুল দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন রাহুল সিংহ! আর একটুর জন্যই সেই উড়ালপুল যেন ভেঙে পড়েছে স্মিতা বক্সীর মাথায়!
কপাল খুলে গিয়েছে রাহুলবাবুর!

গত ৩১ মার্চ বিবেকানন্দ উড়ালপুল যখন ভেঙে পড়ে, সেই কালক্ষণে সেখান দিয়েই গাড়ি চড়ে নিজের নির্বাচনী কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী রাহুলবাবুর। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাঁর মিনিট দশেক দেরি হয়। গণেশ টকিজে পৌঁছে আচমকাই সদ্য ধ্বংসের স্তূপের সামনে পড়েন তিনি। বিদ্যুৎ চমক খেলে যায় তাঁর মাথায়, ১০ মিনিট আগে এলে কী হতো!

সেই যে মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে রাহুলবাবু বেঁচে গেলেন, ব্যস!
একটা পেনাল্টি পেয়ে গেলেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে জোড়াসাঁকোয় বেআইনি নির্মাণ, সিন্ডিকেটের দাপট এবং দুষ্কৃতী-রাজ বেড়েছে। গত বছর পুরভোটের দিনই সেখানে দুষ্কৃতী-তাণ্ডবের বলি হয়েছেন এক পুলিশ কর্মী। অভিযোগ, এই সবের পিছনে স্মিতাদেবীর স্বামী সঞ্জয় বক্সীর মদত রয়েছে। বস্তুত, পুলিশ কর্মী খুনের ঘটনায় এফআইআরে সঞ্জয়বাবুর নাম ছিল। কিন্তু পরে চার্জশিটে তাঁর নাম বাদ যায়। এ ঘটনাকেও সন্দেহের চোখেই দেখেন স্থানীয় মানুষ।

তৃণমূলের জন্মের আগে থেকে স্মিতাদেবী ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ১৯৮৫ থেকে পরপর দু’বার ওই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর হন সঞ্জয়বাবু। ১৯৯৫ থেকে সেই ক্ষমতা হাতবদল হয়ে স্ত্রীর কাছে এসেছে। স্মিতাদেবী দু’বারের বরো চেয়ারম্যান এবং ২০১১ সাল থেকে বিধায়কও বটে। একটানা এত দিন এত ক্ষমতা একটা পরিবারের হাতে থাকায় স্থানীয় তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও রয়েছে বিস্তর।

এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, এ সব কারণে গোড়া থেকেই স্মিতাদেবীর লড়াই শুরু হয়েছিল ঈষৎ দুর্বল অবস্থান থেকে। বিবেকানন্দ উড়ালপুলের দুর্ঘটনায় তাঁর লড়াই আরও কঠিন হয়েছে। সঞ্জয়বাবুর ভাইপো রজত বক্সীর সংস্থাই ওই উড়ালপুল তৈরির সাব কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছিল, এই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই মানুষের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়েছে। তার ফলেই জমি শক্ত হয়েছে রাহুলবাবুর।

জোড়াসাঁকোর ১১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি তৃণমূলের, ৩টি বিজেপির এবং ১টি বাম এবং ১টি কংগ্রেসের দখলে রয়েছে। অর্থাৎ শক্তিতে তৃণমূল এবং বিরোধীরা প্রায় সমান সমান। লোকসভা ভোটে উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী হিসেবে জোড়াসাঁকোতে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন রাহুলবাবু। ফলে পাটিগণিতের হিসেবে তিনি সুবিধেজনক অবস্থানেই রয়েছেন।

রাহুলবাবুও বলছেন, ‘‘প্রচারে সাড়া পাচ্ছি। বাংলাভাষী ভোটাররাও ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছেন। লোকসভা ভোটের সময় এটাই হয়েছিল। ভোটাররা জানাচ্ছেন, পাঁচ বছর বিধায়ককে দেখেননি। এলাকায় কোনও উন্নয়ন হয়নি। উল্টে গুন্ডাদের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হচ্ছে।’’ রাহুলবাবুর আশা, ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলে ভয়ের জবাব দেবেন ভোটাররা। জিতলে তাঁর প্রথম কাজ কী হবে? রাহুলবাবু বলেন, ‘‘এলাকাকে ভয়মুক্ত করা, বস্তি উন্নয়ন এবং ফুটপাথবাসীদের আবাসনের ব্যবস্থা।’’

স্মিতাদেবী কিন্তু মোটেই স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ এবং রাহুলবাবুর বক্তব্য ঠিক বলে মানছেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাধারণ ভোটারদের আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। তাঁরা জানেন, সারা বছর আমাকে পাশে পাওয়া যায়। আর দলেও কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। অভিযোগগুলো সবই বিরোধীদের অপপ্রচার।’’ উড়ালপুলের সাব কন্ট্র্যাক্ট বিতর্ক নিয়ে স্মিতাদেবীর জবাব, ‘‘আমি তো আগেই বলেছিলাম, আমি, আমার স্বামী আর সন্তানই তো কেবল পরিবার নয়। গোটা রাজ্যই আমার পরিবার। বিরাট পরিবারের কে কোথায় কী কাজ করছে, আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন, আমার দৌলতে কেউ বরাত পেয়েছেন, তা হলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব।’’ কিন্তু লোকসভা ভোটে তো রাহুলবাবু এগিয়েছিলেন? স্মিতাদেবীর প্রত্যয়ী জবাব, ‘‘তখন মোদী হাওয়া ছিল। এখন নেই। আর মানুষ অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন, এলাকায় বিজেপি কী কাজ করেছে!’’ ফলে সব বিরোধিতা উড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উন্নয়ন’-এর স্লোগান সম্বল করে এগিয়ে চলেছেন স্মিতাদেবী।

কিন্তু জোড়াসাঁকোর এই খেলা যে কোনও মুহূর্তে ঘুরে যেতে পারে সুদূর মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে আসা এক জন আলাদিনের হাতযশে। যিনি বিহারের বিধানসভা ভোটে আরজেডি-র হয়ে, দিল্লির ভোটে অরবিন্দ কেজরীবালের হয়ে জাদুর খেলা দেখিয়ে এসেছেন। এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে তিনি জোড়াসাঁকোয় বাম-কংগ্রেস জোট সমর্থিত আরজেডি প্রার্থী অবিনাশ অগ্রবালের হয়ে নেমেছেন। এই আলাদিনের নাম সাগির খান। পেশায় জাদুকর। অবিনাশের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর মহল্লায় মহল্লায় জাদু দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর জাদুতে ৫০০ টাকার নোট হয়ে যাচ্ছে লালুপ্রসাদ যাদবের ছবি সম্বলিত আরজেডি-র পতাকা। জাদু থলি থেকে বেরিয়ে আসছে অবিনাশের ছবি।

অবিনাশ বলছেন, ‘‘বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচার করে বুঝেছি, শাসক দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছে। আমাকে মানুষ পছন্দ করছেন। আর সংখ্যালঘু ভোট অনেকটাই আমি টানতে পারব।’’ কিন্তু অবিনাশের সমস্যা হল— এলাকার বেশির ভাগ কংগ্রেস কর্মী তাঁর জন্য প্রচারে নামেননি। তাঁরা চৌরঙ্গিতে সোমেন মিত্র বা হাওড়া উত্তরে সন্তোষ পাঠকের প্রচারে চলে যাচ্ছেন। আর সিপিএমেরও ১০০ শতাংশ স্থানীয় কর্মীকে অবিনাশের প্রচারে দেখা যাচ্ছে না। বস্তুত, রাহুলবাবুর দাবি, স্থানীয় কংগ্রেস এবং সিপিএম কর্মীদের অনেকেই তৃণমূলকে হারাতে তাঁকেই ভোট দেবেন। তবে অবিনাশ তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস এবং সিপিএমের কর্মীরাই আমার হয়ে প্রচার করছেন।’’

আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের স্পর্শে হাতের লণ্ঠন আশ্চর্য ভাবে জ্বলে ওঠার আশায় বুক বাঁধছেন অবিনাশ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Rahul Sinha Smita Baksi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE