কাছে, তবু কাছে নন। —ফাইল চিত্র।
এমন আঠা গায়ে লেগেছে যে, রেজ্জাক মোল্লা জেরবার!
চটচট করছে, চিড়বিড় করছে, আর যত ঘষছেন জায়গাটা তত কালো হয়ে যাচ্ছে!
গলার গামছাটা পটাং করে শূন্যে ঝে়ড়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছেন ‘চাষার ব্যাটা’— ‘‘আরাবুল আর আমার মধ্যে এখন খুব আঠা! তবে এটা ফেভিকলের ‘মজবুত জোড়’ নয়।’’
তা হলে? কী রকম সেটা?
স্পষ্ট করেন রেজ্জাক মোল্লা, ‘‘এ হল কাঁঠালের আঠা! লাগলে বড্ড চিটচিট করে, কিন্তু চট করে সে জোড় ভেঙেও যায়।’’
বলেন কী! আরাবুল ইসলাম আপনার নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর উপর আপনাকে জিতিয়ে আনার ভার দিয়েছেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গ চটচটে লাগলে বা জোড় ভেঙে গেলে চলে? আরাবুল তো সকাল-সন্ধে আপনার হয়ে প্রচার করছেন, আপনাকে নাকি ভিডিও গেমস খেলতেও শেখাচ্ছেন!
এ বার পিকনিক গার্ডেন্সের সরকারি আবাসনের ফ্ল্যাটের তক্তপোষে বাবু হয়ে বসলেন রেজ্জাক। মুখ থমথমে। কয়েক সেকেন্ড চুপ, তার পরই মোক্ষম মন্তব্য হাঁকালেন সেই ‘ঠোঁটকাটা’, ‘‘ঠিকই। আমার পাশে বসছে। শরীরের খবরাখবর নিচ্ছে। প্রকাশ্যে সভায় চিল্লিয়ে-মিল্লিয়ে বলছে, রেজ্জাকদাকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন। মিছিলে আমি চলেছি গাড়িতে, আর ও ‘তাজা-নেতা’— এই গরমে ঘামতে-ঘামতে হাঁটছে। আর পর মিছিল-মিটিং শেষ হলেই সবাইকে আড়ালে বলছে, বজ্জাত বুড়োটাকে এক দম ভোট দিবি না। সবই আমি জানি!’’
এমন একটা বোমা বর্ষণের পর গোটা ঘরে নৈঃশব্দ। প্রথম কথাটা ফের বললেন সেই রেজ্জাকই, ‘‘আরাবুল যতটা পারবে আমার ড্যামেজ করবে। ওটা আমার হিসেবের মধ্যেই আছে। ওর মাস্তান বাহিনীর হাজার দেড়েক ভোট হয়তো আমি পাব না। তবে ও তো আর ‘মাস লিডার’ নয়। মানুষের ভোটটা আমি পাব। তাই আমি চাই কেন্দ্রীয় বাহিনী খুব কড়া থাকুক। অন্য কারও ভরসায় নয়, নিজের ভরসাতেই আমি দাঁড়িয়েছি।’’
গুজগুজ-ফুসফুস অনেক দিন থেকেই চলছিল। সাপ আর নেউল যখন একসঙ্গে, তখন এমন যে হতে পারে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কেউ-কেউ। কিন্তু রাখঢাকের বালাই না-রেখে একেবারে সটান ঝুলি থেকে বেড়াল বার করে যেন সামনে রেখে দিলেন রেজ্জাক মোল্লা। খুল্লমখুল্লা। ভাঙড়ের তৃণমূল প্রার্থী নিজে মুখে বলছেন, তাঁর নিজের নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান আরাবুল ইসলামই তাঁর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের পাণ্ডা!
রেজ্জাকের যুক্তি, ‘‘করবে না তো কি? ওর কী করুণ অবস্থা এক বার ভাবুন! সারা জীবন দলের হয়ে কাজ করল। দলের হয়ে দু’-দু’বার জেল খাটল। তার পরেও দল ওকে প্রার্থী করল না। উল্টে এমন এক জনের হয়ে কাজ করতে বাধ্য করা হল, যাকে দু’চক্ষে সহ্য করতেই পারে না ও। কতটা অপমান!’’ অনায়াসে বলে চলেন বাম শিবির বদলে শাসক দলে ভেড়া এই প্রবীণ নাগরিক— ‘‘এই জন্য মমতাকে বলেছিলাম, ওকেই দাঁড় করাও না! কিন্তু অনুব্রত, আরাবুলরা হল নটোরিয়াস। এদের দিয়ে মমতা ভোটের কাজ করাবে, ভোটে দাঁড় করাবে না কখনও।’’
কথার মধ্যেই একটা ফোন এল। দাপুটে নেতার কপাল কুঁচকে গেল ফোনের ওপারের কোনও কথা শুনে। প্রায় হুঙ্কার দেওয়ার মতো নির্দেশ দিলেন, ‘‘ভোট হয়ে যাক, তার পর কে কার হাত ভাঙবে দেখা যাবে! তোমরা ভয় পেও না। কাজ করে যাও।’’ ফোন রেখে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। ‘‘আমার যাঁরা জেনুইন ভোটার, আরাবুলের লোকেরা তাঁদের হুমকি দিয়ে বলছে, হাত ভেঙে দেবে।’’ তার পর একটু যেন নরম হলেন। মুচকি হাসি এল ঠোঁটে, ‘‘আসলে প্রচারে আমি বলছি, জিতে এলেই এই এলাকায় তোলাবাজি বন্ধ করব। তাতে আরাবুলদের বুকে ধক করে লাগছে। ওরা বুঝতে পারছে, আমাকে জেতালে ওদের কারবারটাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ভিতরে-ভিতরে ছুরি চালাচ্ছে। আমি তো এখন স্লিপিং উইথ দ্য এনিমি!’’ এর পরই চোখ যেন জ্বলে উঠল রেজ্জাকের। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘‘তবে মাখনের ভেতর কী ভাবে ছুরি চালাতে হয়, আমারও জানা আছে। ছুরি চলবে অথচ রক্ত পড়বে না। কেউ টের পাবে না।’’
বোঝা গেল, লড়াই সেয়ানে সেয়ানে।
তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক নেতা মাথা ঝাঁকিয়ে আফশোস করলেন, আদা আর কাঁচকলাকে মেশানোর ঝুঁকি নিয়েছিলেন মমতা। যে রেজ্জাককে মেরে আরাবুল ‘তাজা নেতা’ হলেন, তিনিই কিনা রেজ্জাককে জেতানোর দায়িত্বে! এটা কখনও হয়? যে নানু গাজি গত বার নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে ভোট কেটে আরাবুলকে হারিয়েছিলেন, তাঁকে এখন সর্বত্র সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন রেজ্জাক। বদহজম তো হবেই! সেই নেতার মন্তব্য, ‘‘তার ওপর রেজ্জাক মোল্লার হুটহাট বেফাঁস কথা বলার অভ্যাস। দলবদল করে এমনিতেই ব্যাকফুটে ছিলেন। এখন আরাবুলের কাণ্ডকারখানায় জমি হারাচ্ছেন বুঝে মাথা গরম করে সব ফাঁস করে দিচ্ছেন।’’
যা শুনে রেজ্জাক বললেন, ‘‘আসলে আরাবুলের সঙ্গে আমার লড়াইটা খুল্লমখুল্লা হলেই ভাল হত। আরাবুলকে সঙ্গে নিয়ে আমার অবস্থা এখন হয়েছে অনেকটা ‘গরজে গোয়ালা ঢেলা বয়’ এর মতো। গোয়ালা কাঁধে করে ছানা নিয়ে যাচ্ছে। এক দিকটা কাত হয়ে যাচ্ছে। বোঝা কমাতে সে দিকের ছানা তো ফেলে দিতে পারে না। তাই অন্য দিকটায় ঢেলা বেঁধে বাঁকটা সোজা করে
নিচ্ছে। ওকেও আমাকে এই ভাবেই বইতে হচ্ছে।’’
এই ভার তো আপনার পতনের কারণও হতে পারে?
আবার জ্বলে উঠলেন নেতা, ‘‘আরাবুল সাপ খেলাতে চাইছে। তবে ওর পড়াশোনা তো ক্লাস থ্রি! ব্রেনের সেলগুলো অ্যাক্টিভ নয়। ভাল সাপুড়ে আর খেলুড়ে হতে গেলে বিদ্যেবুদ্ধি দরকার। ও আমাকে কী খেলা শেখাবে? ও যাতে বিষ ঢালতে না পারে, তার জন্য বিষদাঁত আমি ভেঙে দেব। এমনি-এমনি এত দিন রোদে তেতে বুথে বুথে ঘুরে বেড়াইনি।’’
কিন্তু সবাই যে বলছে, আপনি পাঁকে পড়ে গিয়েছেন? ‘‘রামকৃষ্ণদেব কী বলেছিলেন মনে আছে? পাঁকাল মাছ ধরতে হলে পাঁকেই থাকতে হবে। আমি সেই পাঁকের মধ্যে রয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy