Advertisement
০২ মে ২০২৪

ঘাসফুলের গড়ে হুঙ্কার সেলিমের

কোথাও পাঁচ, কোথাও ছয় ! হড়কা বানের মতো সিপিএমের মিছিলে, সভায় লোক ঢুকছে। ঘাসফুলের গড়ে কোথা থেকে এত লোক ভিড়ছে লাল পতাকার মিছিলে?

নানুরে কর্মী-সমর্থকদের ভরা মাঠে বক্তব্য রাখছেন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম। (ইনসেটে) লাভপুরে সমর্থকদের মাঝে।— সোমনাথ মুস্তাফি।

নানুরে কর্মী-সমর্থকদের ভরা মাঠে বক্তব্য রাখছেন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম। (ইনসেটে) লাভপুরে সমর্থকদের মাঝে।— সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৫৫
Share: Save:

কোথাও পাঁচ, কোথাও ছয়!

হড়কা বানের মতো সিপিএমের মিছিলে, সভায় লোক ঢুকছে। ঘাসফুলের গড়ে কোথা থেকে এত লোক ভিড়ছে লাল পতাকার মিছিলে? বৃহস্পতিবার বিরোধী জোটের সিপিএম প্রার্থী মাহফুজুল করিম ও শ্যামলী প্রধানের সমর্থনে লাভপুরে ও নানুরে মহম্মদ সেলিমের জনসভার পর এমন প্রশ্নই ঘুরছে জেলা তৃণমূলের অন্দরে অন্দরে।

ভিড়ের জোয়ার দেখে সেলিম বলেন, ‘‘আমি সূর্য মিশ্র নই, যে বলব ‘বদলা নেব না’। যত শহিদ হয়েছেন আমাদের, প্রত্যেকের রক্তের হিসাব বুঝে নেব। ১৯ মে সব বেরিয়ে পড়বে। দেখা যাবে সব ভেজাল দিয়ে তৈরি। সারদা চিটফান্ডের টাকাতে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের বাড়বাড়ন্ত। গরিব মানুষের সেই সব টাকারও হিসেব নেব আমরা!’’— দৃশ্যত ভোটের মুখে সেলিমের এমন হুঙ্কার শুনেই এ দিন লাভপুর-নানুরে হাততালি পড়েছে। শাসকদলের ভয়, হুমকি উপেক্ষা করে মানুষ যে বিরোধী মিছিলে হেঁটে এ দিনের সভা ভরিয়েছিলেন, তাঁরা মেতেছেন এই সব কথাতেই।

এ দিন লাভপুর হাটতলা ঢোকার মুখেই তারই প্রতিধ্বনি চোখে পড়ল। সিপিএম নেতার কথায় জনতার হাততালি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে দেখে, তৃণমূলেরই স্থানীয় এক পঞ্চায়েত প্রধানের মন্তব্য, ‘‘মনিরুলের রাতের ঘুম ছুটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট এই হাততালির শব্দ!’’

লাভপুরে সভার মাঠে ঢোকার দু’দিকের দোকানদারদের মুখে রব উঠেছে, ‘এইবার নিল রে।’ সে রব ক্রমে গোটা মাঠ, বিরোধী জোটের সিপিএম প্রার্থী মাহফুজুল করিমের সমর্থনে মহম্মদ সেলিমের জনসভার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মিছিল সাড়ে দশটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই এলাকার মানুষ ভিড় করতে শুরু করে। লাভপুর হাটতলা মাঠে একসময় এমনও রব ওঠে, ‘এইবার মনিরুলকে নিল রে’ জাতীয় কথা। সেলিম নিজেও হুমকির সুরে বলেন, ‘‘পুলিশ তৃণমূলের হয়ে তাঁবেদারি করছে। তাঁবেদারি করবেন না। রাজ্যে পাঁচ জন পুলিশ তৃণমূলের হাতে খুন হয়েছে। বীরভূমেও খুন হয়েছে। পুলিশকে টেবিলের নীচে লুকোতে হয়েছে। এই লাভপুর খুনি মনিরুলের নয়, এই লাভপুর মানুষের লাভপুর। তাই খুনিদের তাঁবেদারি করবেন না। মানুষ ছেড়ে কথা বলবে না।’’ মনিরুল অবশ্য এ দিন এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

স্থানীয় মানুষ বলছেন, ২০১১ সালের পর বিরোধীদের এতবড়ো সমাবেশ দেখেনি এই মাঠ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই মাঠেই শেষ বড় সভা করেছিল শাসকদল। সেবার লোক হয়েছিল হাজার দশেক। এ দিন সমাবেশে পুলিশেরই হিসাব বলছে, লোক ছিল হাজার পাঁচেক!

দাপুটে তৃণমূল নেতা মনিরুল ইসলামের গড় লাভপুরে কীভাবে সেলিমের সভায় এই ভিড় হল?

জেলার রাজনৈতিকমহল মনে করছে, লাভপুরে ভিড়ের পিছনে শুধু বাম কিংবা কংগ্রেসই নয়, রয়েছে বিক্ষুদ্ধ তৃণমূলের ভূমিকাও। প্রার্থীপদ নিয়ে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই মনিরুল ইসলামের সঙ্গে তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক দেবাশিস ওঝা বিরোধ সর্বজন বিদিত। দলের দুর্দিনের সময় যখন কেউ প্রার্থী হতেই রাজি হত না সেই সময় দেবাশিসবাবু শুধু বিধানসভায় প্রতিন্দ্বন্দ্বিতাই করেননি, সংগঠনও ধরে রেখেছেন। অথচ তাঁকে বাদ দিয়ে যখন তৃণমূলের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে সেই সময় ফব থেকে দলে ঢোকা মনিরুলকে প্রার্থী করে তৃণমূল। ভোটে জিতে মনিরুল দলে ঢোকান তার রাজনৈতিক গুরু আর এক ফব নেতা আব্দুল মান্নানকে। তারই সৌজন্যে লাল তৃণমুলের দাপটে ব্রাত্য হয়ে পড়েন আদি তৃণমূলীরা। এবং বিভিন্ন সময় তাঁদের নানাভাবে দেখে নেওয়ারও অভিযোগ উঠে গুরু-শিষ্যের বিরুদ্ধে। এতদিন ওইসব বিক্ষুদ্ধ তৃণমূলকর্মী-সমর্থকরা ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। এ দিন মিছিলে তাঁদেরও নেতৃত্ব দিতে দেখা গেল। তাঁদেরই অনেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিএমে যোগ দেন।

তৃণমূলের দুঃসময়ের ব্লক সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ খানের হাতে লাল পতাকা তুলে দেন সেলিমসাহেব। একসময় পতাকা নেওয়ার জন্য দেবাশিস ওঝার নামও ঘোষণা হয়। কিন্তু তাঁকে মঞ্চে দেখা যায়নি। তবে এ দিন দলবদল না করলেও দুঃসময়ের অনেক তৃণমূল নেতা-কর্মীকে সমাবেশে দেখা গিয়েছে। তাঁদেরই অন্যতম তৃণমূলের ঠিবা অঞ্চল কমিটির প্রাক্তন সভাপতি রামকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ফিরোজ খানরা জানান, ‘‘একদিন সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করে দলকে টিকিয়ে রেখেছিলাম। সিপিএমের হাতেও অত্যাচারিত হয়েছি। কিন্তু এদের অত্যাচার আর নেওয়া যাচ্ছে না।’’

দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘আমি কোথাও সিপিএমে ঢোকার কথা বলিনি, কেন আমার নাম ঘোষণা হল বুঝতে পারছি না। তবে আমার অনেক অনুগামী গত পাঁচ বছর ধরে মনিরুল এবং মান্নানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েআমার কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছিল। আমি বিভিন্ন সময় সে কথা জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছি, কিন্তু কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। তাই এ দিন তাঁরা দলবদল করে সিপিএমে যোগ দিয়েছে বলে খবর পেয়েছি।’’ দলবদল করে বিজেপি থেকেও ৪০০ কর্মী-সমর্থক এ দিন বিকেলে সিপিএমে যোগ দেন নানুরে সেলিমের দ্বিতীয় সভায়।

আরও পড়ুন...
মওত, মানি অউর ধোঁকা, সিন্ডিকেটরাজ চলছে বাংলায়, কটাক্ষ মোদীর

নানুরে বিজেপির যুব মোর্চার সভাপতি সুরজিৎ পাল বলেন, ‘‘রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এলাকার উন্নয়ন করার জন্য আমরা দলবদল করলাম।’’

বিকেলে নানুর হাইস্কুলের মাঠেও জোটের সমর্থনে ভিড় দেখে এলাকার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে জল্পনা ছড়ায়। অথচ মাস খানেকও হয়নি, প্রার্থী পদ ঘোষণার পর খুজুটিপাড়ায় বছর পাঁচেক ধরে ভগ্নস্তুপ হয়ে পড়ে থাকা লোকাল কমিটির অফিস চত্বর থেকে শ’খানেক কর্মী-সমর্থক নিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন বিরোধী জোটের প্রার্থী শ্যামলী প্রধান। তবে কিছুদিন আগেই তাঁর প্রচার মিছিলে আড়াই হাজারেরও বেশি লোক হয়েছিল। তা দেখে, তখনই জল্পনা শুরু হয়েছিল বোলপুরে তৃণমূল পার্টি অফিসে। আর এ দিন তৃণমূলের কপালের ভাঁজ আরও চওড়া করে দিল সেলিমের জনসভা। নানুর হাইস্কুলের মাঠের ওই সভায় পুলিশের হিসাবেই হাজার ছয়েক লোক হয়েছিল। ২০১১ সালের পর বিরোধীদের ওই জমায়েত দেখেনি নানুর!

জোটসঙ্গী কংগ্রেসের কাঁধে ভর করেই কি সিপিএমের এই প্রত্যাবর্তন?

কংগ্রেসেরই একাংশ ওই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, নানুরে কংগ্রেসের যা অবস্থা তাতে জোট প্রার্থীর কিছু ভোট হয়তো বাড়তে পারে। কিন্তু সিপিএমের মনোবল বাড়ানোর ক্ষমতা তাদের নেই বললেই চলে। তা হলে? জেলার রাজনৈতিকমহলের অভিমত, একসময় এলাকার যুবনেতা কাজল সেখ এবং এবারের তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরার দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেয়েছে তো বটেই, বহু ক্ষেত্রে ঘোল খেতে হয়েছে খোদ জেলা অনুব্রত মণ্ডলকেও। পরে অবশ্য পঞ্চায়েত, বালির ঘাট তথা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কয়েমকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘাত চরমে ওঠে। কাজলও তাই নিজের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রমাণ করতে অনুগামীদের গোপনে জোটের দিকে ভিড়িয়ে দিচ্ছেন। সম্প্রতি তারই প্রমাণ মিলেছে নানুরের খুজুটিপাড়া কলেজে। কাজলের নেতৃত্বে দখল করা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ওই কলেজ ইউনিটটি দু’দিন আগেই রীতিমতো ঘোষণা করে এসএফআইয়ে যোগ দেয়।

এ দিন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেন, ‘‘এক থেকে দেড় হাজার লোক হয়েছে। সংবাদমাধ্যম বাড়িয়ে দেখায় ওদেরটা। ওই সংখ্যক ভিড় আমাদের যে কোনও বুথের সভায় হয়। আর ১৭ তারিখের পরেই সেলিম জবাব পেয়ে যাবেন। তখন ওর মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM Mohammad Salim TMC Assembly Election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE