Advertisement
০৫ মে ২০২৪
দুর্গাপুরের সভায় বললেন মমতা

মেয়রকে চড় মারুন, কিন্তু ভোট দিন

ক’দিন আগেই পাশের জেলা বাঁকুড়ায় গিয়ে দলের জেলা সভাপতির কেন্দ্র ওন্দার সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘অরূপ চোর নয়। ওকেই কিন্তু ভোট নয়।’’ এ বার দুর্গাপুরের মেয়রের হয়ে ভোট চাইতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কেউ কি বলতে পারবেন অপু চোর? অভিমান হলে অপুকে দু’চড় মারুন। তবু দয়া করে জেতান!’’

গাঁধী মোড় ময়দানের সভামঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। ছবি: বিকাশ মশান।

গাঁধী মোড় ময়দানের সভামঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। ছবি: বিকাশ মশান।

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৭
Share: Save:

ক’দিন আগেই পাশের জেলা বাঁকুড়ায় গিয়ে দলের জেলা সভাপতির কেন্দ্র ওন্দার সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘অরূপ চোর নয়। ওকেই কিন্তু ভোট নয়।’’ এ বার দুর্গাপুরের মেয়রের হয়ে ভোট চাইতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কেউ কি বলতে পারবেন অপু চোর? অভিমান হলে অপুকে দু’চড় মারুন। তবু দয়া করে জেতান!’’

‘দয়া’?

দুর্গাপুরের দাপুটে মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায়কে কি তা হলে জনতার ‘দয়া’র উপরে নির্ভর করে ভোটে জিততে হবে!—প্রশ্নটা তাই উঠেই গিয়েছে শহরে। মেয়রের হয়ে ভোট চাইতে এসে মমতার এমন মন্তব্য শুনে বিরোধীরা তো বটেই, চমকে গিয়েছেন তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরাও। দলেই গুঞ্জন শুরু হয়েছে, ‘তবে কি অপুদার ব্যথা আছে!’ ঘটনাও হল, গত লোকসভা ভোটের ফল বলছে, দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রে তৃণমূল বাম-কংগ্রেস জোটের থেকে খুব বেশি এগিয়ে নেই। তার উপরে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে জোট। তারও উপরে এই কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক অপূর্ববাবুর বিরুদ্ধে এ বার জোটের প্রার্থী হয়েছেন এক সময়ে মেয়রেরই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, তৃণমূল ছেড়ে ভোটের ঠিক আগে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া বিশ্বনাথ পাড়িয়াল।

সব মিলিয়ে এই কেন্দ্র নিয়ে যে দলে উদ্বেগ রয়েছে, তা বুধবার গাঁধী মোড় ময়দানের নির্বাচনী সভায় তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। দলীয় প্রার্থীর হয়ে কখনও তাঁকে বলতে হয়েছে, ‘‘অপু ভালো ছেলে। দয়া করে ওকে জেতান।’’ আবার কখনও বিশ্বনাথবাবুর উদ্দেশে জনতাকে বলেছেন, ‘‘খাল কেটে কুমির আনবেন না।’’

যা শুনে হাসছেন বিশ্বনাথবাবু। কিন্তু, নিজের প্রাক্তন দলনেত্রীর বিরুদ্ধে একটা কথাও বলছেন না। ‘‘এ নিয়ে আর কী বলব’’—সংক্ষিপ্ত মন্তব্য তাঁর।

বস্তুত, গত মাসেই সাংবাদিক সম্মেলন করে অপূর্ববাবুর প্রতি তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়ে দল ছাড়ার কথা ঘোষণা করেন দুর্গাপুরের দেড় দশকের তৃণমূল কাউন্সিলর বিশ্বনাথ পাড়িয়াল। ১৯৯৭ সালে তিনি কংগ্রেসের টিকিটে জেতেন। ২০০১ থেকে তৃণমূলে। এর পরে ২০০২, ২০০৭ ও ২০১২ সালের পুর নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে লড়ে জয়ী হন। এ বার সিপিএম এবং কংগ্রেস একযোগে বিশ্বনাথবাবুর সমর্থনে প্রচার শুরু করেছে। প্রচারে ভাল সাড়া পাওয়ায় আসনটি তৃণমূলের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার স্বপ্নও দেখতে শুরু করে জোট। জোটের নেতাদের ধারণা, বিশ্বনাথবাবু বিদায়ী বিধায়ক অপূর্ববাবুকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন।

সিপিএমের ভোট ছাড়াও বিশ্বনাথবাবুর অনুগামী ও সমর্থকদের ভোট রয়েছে, যা আসলে তৃণমূলের পাওয়ার কথা ছিল। তৃণমূলের জন্য যা আদতে অস্বস্তির। প্রচারে বিশ্বনাথবাবু ও তাঁর অনুগামীরা অপূর্ববাবুর ‘দুপুরের ঘুম’ নিয়ে লাগাতার কটাক্ষ করছেন। বলছেন, ‘আমরা পার্ট টাইম মেয়র চাই না। দুর্গাপুরের উন্নয়নের স্বার্থে ফুল টাইম মেয়র চাই।’ এমনকী বিশ্বনাথবাবুর নিজের ওয়ার্ডে প্রচারে গিয়ে কার্যত বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল অপূর্ববাবুকে। সেখানে বাসিন্দাদের কেউ কেউ সরাসরি বলে দেন, ‘‘ভোট এসেছে বলেই আমাদের মনে পড়েছে? আমাদের জন্য আপনি কিছুই করেননি।’’

তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, এই কেন্দ্রে সভা করতে আসার আগে এ সব তথ্য বিলক্ষণ জানা ছিল দলনেত্রীর। তাই এ দিন বক্তৃতার সময় অপূর্ববাবুর বিরুদ্ধে ওঠা সেই সব অভিযোগ কার্যত স্বীকারও করে নিয়েছেন মমতা। তবে সব কিছুর পরেও অপূর্ববাবুকেই ভোট দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘অপুর নামে অনেকে অনেক কিছু বলে বেড়াচ্ছে। আপনারা কেউ বলবেন, ও চোর? নয় তো। সব সময় হয়তো ওর দেখা পাওয়া যায় না। ওকে বলব এমন না করতে। অভিমান হলে অপুকে দুই চড় মেরে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘কেন দেখা করনি?’ অপু ভাল ছেলে। ওকে দয়া করে জেতান।’’

এর পরেই বিশ্বনাথবাবুর নাম না করে মমতা বলেন, ‘‘এদের আমি ভালো চিনি। ২০০৭ সালে সুব্রত বক্সীকে কী করেছিল, জানি না? অপুর তো ওর (বিশ্বনাথের) সঙ্গে খুব ভাব তখন। আমি বলেছিলাম, ব্যবস্থা নিতে। অপু শোনোনি। এখন বোঝো! সিপিএমের কাছে এরা দলের পতাকা বিক্রি করে দেয়। এরা মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতক!’’ ২০০৭ সালে সুব্রতবাবুর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল বিশ্বনাথবাবুর। তাঁর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘ওই গোলমালে আমি মোটেও ছিলাম না। অপূর্ববাবুর বাড়ি থেকেই গোটাটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।’’

দলনেত্রীর মুখে ‘ওকে চড় মারুন’ শুনে বেজায় অস্বস্তিতে পড়লেও তা মুখে বলার অবশ্য উপায় নেই শহরের মেয়র অপূর্ববাবুর। বরং বলছেন, ‘‘দিদি যে ভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি খুশি।’’

একই ভাবে এ দিন ঘুরিয়ে দুর্গাপুর পূর্বে ‘বহিরাগত’ প্রদীপ মজুমদারকে কেন প্রার্থী করা হয়েছে, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘নিখিলদা’র (বিদায়ী বিধায়ক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়) জায়গায় স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলাম। অপুকে বলেছিলাম, প্রার্থী ঠিক করতে। তিন দিন সময় নিয়েও একটা নাম পাঠাতে পারিনি। তখন আমি প্রদীপবাবুকে বেছে নিই।’’

দুর্গাপুর পশ্চিমের মতোই পূর্বেও অস্বস্তি রয়েছে তৃণমূলের। প্রার্থী হিসাবে প্রদীপবাবুর নাম ঘোষণার পরে পরেই নিখিলবাবুর সমর্থনে কাঁকসার একাধিক জায়গায় ‘নো নিখিল, নো ভোট’ লেখা পোস্টার পড়ে। পরে অবশ্য নিখিলবাবুকে প্রচারে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেই ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করেছেন প্রদীপবাবু। তবু কোথাও যেন প্রচারে স্থানীয় কর্মীদের ‘আন্তরিকতা’র অভাব নজরে এসেছে দলের নেতৃত্বের একাংশের। এ দিন তাই নিজেই প্রদীপবাবুর প্রার্থিপদের সমর্থনে নিজের বক্তব্য জানালেন মমতা— এমনটাই মনে করছেন দলের স্থানীয় নেতারা।

আরও পড়ুন...
ভুল করলেও আপনাদের আশীর্বাদ চাই, আকুল মমতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 tmc mamata MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE