পূর্বস্থলীর কার্যালয়ে ভোটের তদারকিতে ব্যস্ত স্বপন দেবনাথ। ছবি: মধুমিতা মজুমদার।
দলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তিনি। বিদায়ী মন্ত্রীও। তিনি-ই আবার জেলায় শাসকদলের ভোটের প্রধান কারিগর। সেই তিনি-ই কি না দিনভর ব্যস্ত রইলেন ফোনে পুলিশ কর্তাদের নালিশ করতে। কখনও পুলিশ কেন বিরোধী ভোটারদের নিরাপত্তা দিচ্ছে তো কখনও দলের কাউন্সিলরকে ভোট করতে দেওয়া হচ্ছে না— এ ভাবেই বারবার ফোনে জেলা পুলিশের কর্তাদের কাছে নালিশ জানাতে দেখা গেল স্বপন দেবনাথকে!
গত লোকসভা ভোটের ফলে যে এলাকায় শাসকদলের ফল ছিল ১৫-১, সেখানকার সেনাপতির এমন হাল কেন? বিরোধীদের দাবি, বিধানসভার ফল নিয়ে যথেষ্টই চাপে রয়েছেন স্বপনবাবু। বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফার ভোটে স্বপনবাবুর সারা দিনের শরীরি ভাষাই তার প্রমাণ। শাসকদলের ওই দাপুটে নেতা মুখে যদিও তা মানতে নারাজ। ‘১৬টি আসনেই জেতার আশা রাখছি’ বলে দাবিও ঢুকেছেন।
যদিও তা নিয়ে শাসকদলের অন্দরেই সংশয়। যা দেখে শুনে দিনের শেষে স্বপনবাবুর অনুগামীরাই বলছেন, ‘‘এ দাদা আর সে দাদা নন!’’
এ দিন সকাল ৭টা নাগাদ স্বপনবাবু নিজের বুথ বিদ্যানগরে ভোট দিয়ে সোজা চলে আসেন পূর্বস্থলী ১ ব্লকের হেমায়েতপুর মোড়ের দলীয় কার্যালয়ে। পরনে ছিল দুধ সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। বুকে আটকানো পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থীর পরিচয়পত্র। তাঁর সঙ্গেই কার্যালয়ে আসেন পূর্বস্থলী ১ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি নবকুমার কর এবং তৃণমূল নেতা (জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান) দেবাশিস নাগ। দলীয় কার্যালয়ে নিজের চেয়ারে বসেই দু’টি ফোন ঘুরিয়ে শুরু হয় একের পর এক নির্দেশ। আবার নেতারাও ফোনে বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সাহায্য চান। স্বপনবাবু সরাসরি নজর রাখেন কালনা ও কাটোয়া মহকুমার বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে। বর্ধমানে দলীয় কার্যালয় থেকে বাকি বিধানসভাগুলির নজরদারিতে ছিলেন উত্তম সেনগুপ্তরা। দলীয় কর্মীদের নানা সমস্যা জেলা কার্যালয় থেকে ভায়া হয়ে আসে স্বপনবাবুর কাছে। কী করতে হবে, কাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে হবে, কোথায় কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে টেলিফোনেই তিনি জানিয়ে দেন। তবে ফোনে অনর্গল কথা বলার সময়ে দৃশ্যতই ক্লান্ত ও অসুস্থ দেখায় স্বপনবাবুকে।
চাপ বাড়তে থাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে নালিশ ফোন আসতে শুরু করায়। প্রথমেই স্বপনবাবুকে দলীয় কর্মীরা ক্ষোভের সুরে জানান, কেন্দ্রীয় বাহিনী বুথে বুথে ‘চাপ’ দিচ্ছে। রাস্তায় ঘন ঘন গাড়ি নিয়ে টহলও দিচ্ছে। এমনকী, তারা মন্তেশ্বর ও পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থীকে বুথের ভিতর ঢুকতে বাধা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লোকসভা, পঞ্চায়েত ভোটের মতো ভোট ‘করানো’ যাচ্ছে না বলে স্বপনবাবুর কাছে দলীয় কর্মীদের নালিশও আসতে শুরু করে। বেগতিক দেখে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে জেলার যে পুলিশ কর্তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁদের শরণাপন্ন হলেন স্বপনবাবু। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ফোনে এক নেতা জানালেন, গলসি থানার পুলিশ বেশ কিছু সিপিএম সমর্থককে নিরাপত্তা দিয়ে বুথে নিয়ে আসছে। শুনেই যেন ক্ষেপে উঠলেন। আইসি-কে লক্ষ্য করে উল্টো প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বললেন, ‘‘উনি তো সিপিএমের ব্যাজ পরে কাজ করতে পারেন। আইসি ভেবেছেটা কি?’’
এর কিছু পরেই পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসারকে ফোন ঘোরালেন স্বপনবাবু। বহু জায়গায় দলীয় প্রার্থী, এজেন্টদের বুথে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ জানালেন। আবার ‘বিষয়টি দেখুন’ বলে সুর বদলে আবেদনও জানালেন। ঘণ্টাখানেক পরে খবর এল, কাটোয়াতেও দলের নেতা-কর্মীদের ‘সমস্যা’য় ফেলেছে পুলিশের সক্রিয়তা। বেলা ১টা নাগাদ পাশে থাকা দেহরক্ষীকে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে ফোনে ধরার নির্দেশ দিলেন স্বপনবাবু। পুলিশের কর্তা ফোন ধরতেই স্বপনবাবু একনাগাড়ে বলে গেলেন, ‘‘ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের কাছে গেলেই পুলিশ লাঠি হাতে তেড়ে আসছে কেন? কাটোয়ার কাউন্সিলার এলাকার বুথগুলোতে কেন যেতে পারবে না? আপনি দেখুন!’’ শুধু পুলিশ-প্রশাসনই নয়, শাসকদলের ভোট-সেনাপতিকে চাপে রাখলেন ঘরের লোকেরাও। নিজের বিধানসভা এলাকার এক কর্মী বাম জোটের পক্ষে সকাল থেকে প্রচার করছে শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। উত্তেজিত হয়ে কাউকে ফোনে বললেন, ‘‘ইন্দিরা আবাস যোজনায় ঘর নিয়েছে। এর পরেও এ সব করছে। ভোট মিটলে আমি ওকে দেখে নেবো।’’ একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করল খণ্ডঘোষ, রায়না, জামালপুর, ভাতার, রায়না-সহ বিভিন্ন ব্লক থেকেও।
ভোট চলাকালীন দিনভর ফোনে ধরে পুলিশ কর্তাদের কি এলাকার রাশ নিজের হাতে রাখতে চাইছিলেন বিদায়ী মন্ত্রী? মন্ত্রীর ফোনের মাধ্যমে ‘চাপ’ দেওয়াকে যদিও গুরুত্ব দিতে নারাজ জেলা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘উনি তো ওঁর মতো চেষ্টা করবেনই।’’ তবে, স্বপনবাবুর এ দিনের ভূমিকার বিরোধিতায় সরব হয়েছেন পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের জোট প্রার্থী কংগ্রেসের অভিজিৎ ভট্টাচার্য। তাঁর দাবি, ‘‘এই জেলার পুলিশের সঙ্গে তৃণমূল নেতার বিশেষ সম্পর্কের দিকটা নারদ-কাণ্ডেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। যেখানে প্রাক্তন এসপি খোলাখুলিই জানিয়ে দিয়েছেন, স্বপনবাবু কীভাবে মন্ত্রী হয়েছেন। হার নিশ্চিত বুঝে সেই তাঁবেদার পুলিশকে ধরেই এ দিন উনি ওঁর ডুবন্ত নৌকো বাঁচানোর চেষ্টা করলেন।’’
বিরোধীদের এমন ব্যাখ্যাকে যদিও খণ্ডন করেছেন স্বপনবাবু। তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।’’ দলীয় কার্যালয়ের চেয়ার থেকে উঠে অন্য ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘‘ভোট ভাল হয়েছে। ১৬টি আসনেই জেতার আশা রাখছি।’’ তবে, যাওয়ার আগে তাঁর শরীরী ভাষাই যেন বলে দিল, তিনি নিশ্চিন্ত নন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy