Advertisement
E-Paper

টিকি বাঁধা সিন্ডিকেটে, কবুল সব্যসাচীর

সারদা-নারদের জোড়া ধাক্কা এবং মাথার উপরে উড়ালপুল ভেঙে পড়েও নিস্তার নেই। ভোট বাজারে তৃণমূলের ঝুলি থেকে দুর্নীতির আরও বেড়াল বেরোচ্ছে। বেড়ালও ঠিক নয়, ক্যামেরার সামনে এ বার একেবারে বাঘই বের করে ছেড়েছেন বিধাননগরের মেয়র তথা দলীয় বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৮
ব্যঙ্গচিত্র: অনুপ রায়

ব্যঙ্গচিত্র: অনুপ রায়

সারদা-নারদের জোড়া ধাক্কা এবং মাথার উপরে উড়ালপুল ভেঙে পড়েও নিস্তার নেই। ভোট বাজারে তৃণমূলের ঝুলি থেকে দুর্নীতির আরও বেড়াল বেরোচ্ছে।

বেড়ালও ঠিক নয়, ক্যামেরার সামনে এ বার একেবারে বাঘই বের করে ছেড়েছেন বিধাননগরের মেয়র তথা দলীয় বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। সিন্ডিকেট-দুর্নীতির যে কেঁদো বাঘ এত দিন তৃণমূলের ঝোলা থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারত, আভাস পেলেও যার নাগাল পাওয়া কঠিন হতো, এ বার তাকেই রাজপথে এনে ফেলেছেন তিনি। সিন্ডিকেট ব্যবসার অন্যতম চাঁই বলে পরিচিত সব্যসাচী ক্যামেরার সামনে বলেই দিয়েছেন, সিন্ডিকেটের ছেলেদের মদতেই তিনি ভোট করেন। তারাই তাঁর হয়ে পোস্টার, ব্যানারের ব্যবস্থা করে। দেওয়াল লিখে দেয়। এবং এই ব্যবসায় হাত দিতে গেলে সরকার উল্টে যাবে।

অর্থাৎ? সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে আগে থেকেই জেরবার ছিল শাসক দল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নারদের হুল। সেখানে গোপন ক্যামেরার সামনে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের মুখে। ভাঙা উড়ালপুলের চাঙড়েও লম্বা হচ্ছে সিন্ডিকেটের ছায়া। তার মধ্যেই সোমবার টাইমস নাওয়ের ক্যামেরায় সিন্ডিকেট-রাজের কাহিনি বেআব্রু করে দিলেন সব্যসাচী। তবে নারদ নিউজের ফুটেজের মতো টাইমস নাওয়ের এই ফুটেজও আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

রাজারহাট-নিউটাউনে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সিন্ডিকেটের রমরমা নতুন কোনও খবর নয়। সিন্ডিকেটের ব্যবসা এখন সাবেক সল্টলেকেও ঢুকে পড়েছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সব্যসাচী ও তাঁর দলীয় সতীর্থদের হাত ধরে এই ব্যবসা বটগাছের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সিন্ডিকেট-রাজ ডালপালা মেলেছে জেলাতেও। কোথাও বালি খাদান, কোথাও কয়লা খাদান, কোথাও গরু, এমনকী সীমান্তে চোরাচালানেও সিন্ডিকেট-রাজ এখন চেনা নাম। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল, তৃণমূল করলে সিন্ডিকেট করা চলবে না। কিন্তু তাঁর এই অবস্থানের সঙ্গে বাস্তবের যে আকাশপাতাল তফাৎ, সেটা সকলেরই জানা।

বস্তুত, সব্যসাচী নিজেও এ দিন এই ভিডিওর সত্যতা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, মাঝখান থেকে কেটেকুটে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরাতেই বিতর্ক হচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সব্যসাচী কী বলেছেন, কী বলতে চেয়েছিলেন, সে সব জানি না। তবে দল বিব্রত হয়, এমন কাজ কারওরই করা উচিত নয়। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশিকা দলের সকলের জন্যই প্রযোজ্য। দলনেত্রী আগেই বলেছিলেন, যাঁরা সিন্ডিকেট করতে চান, তাঁরা যেন দলটা না করেন!’’

শাসক দলের সঙ্গে সিন্ডিকেটের যোগসাজশ।
টাইমস নাও-এর ক্যামেরায় হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন রাজারহাট-নিউ টাউনের
বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। ভিডিওর সত্যতা অবশ্য যাচাই করেনি আনন্দবাজার।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

কেমন চলে সব্যসাচীদের এই সিন্ডিকেট?

বাম আমলে এক সময়ে রাজারহাট-নিউটাউন মেগাসিটি প্রকল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সিন্ডিকেট। স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থানের স্বার্থে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের জন্য তৈরি হয়েছিল কো-অপারেটিভ। অসংখ্য যুবক ভিড় করেন সেই সমবায়ে। শুরু হয় ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহ। উড়তে থাকে কাঁচা টাকা। কিন্তু ‘দাদা’দের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় তখন তেমন গোলমাল টের পাননি এলাকার মানুষ।

মহাকরণে ক্ষমতার হাত বদল হতেই ছবিটা বদলে যায় রাতারাতি। পুরনো ‘দাদা’রা ছড়িয়ে গিয়ে শাসক দলের এক-এক জন নেতার দলে নাম লেখায়। পাশাপাশি, গজিয়ে ওঠে আরও অনেক ‘দাদা’। ক্রমশ তাদের দাপট বাড়তে থাকে। শুরু হয় এলাকার ভাগাভাগি নিয়ে গোলমাল।

বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তার কথায়, ‘‘এলাকায় দখল রাখতে শুরু হয় খুন, জখম। কারণ, জোরজবরদস্তির উপরেই নির্ভর করে সিন্ডিকেটের সাফল্য। সিন্ডিকেটের কাজের এলাকার মানচিত্র অনুসারে ভাগাভাগিতে নেমে পড়েন শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা।’’ সব্যসাচীর নাম যেমন এই তালিকায় জড়িয়েছে। তেমনই সুজিত বসু, কাকলি ঘোষদস্তিদার, ফিরহাদ হাকিম, পূর্ণেন্দু বসু, জাভেদ খানদের নামেও উঠেছে একাধিক অভিযোগ।

এক সময় ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সিন্ডিকেট। সে সব এখনও আছে। এখন তার সঙ্গে সরাসরি নির্মাণ পরিচালনার কাজেও হাত পাকিয়েছে সিন্ডিকেটের দাদারা। তাতে এক দিকে প্রোমোটারদের কাছ থেকে এককালীন মোটা টাকা যেমন মেলে, তেমনই ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহও তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে। পোশাকি ভাষায় এই পদ্ধতির নাম, ‘লক অ্যান্ড কি’ বা ‘তালাচাবি’ ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে জমি এবং বহুতলের নকশা এবং প্রয়োজনীয় টাকা সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেবেন প্রোমোটার। বাড়ি তৈরির সব কাজটাই করবে সিন্ডিকেটের দাদারা। এতে সিন্ডিকেটের লাভও নাকি বেশি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দখলদারি ঘিরে আত্মঘাতী সংঘর্ষ।
যার শিকার হচ্ছেন বাগুইহাটির জগৎপুরের তৃণমূল কর্মী সঞ্জয় রায়ের মতো লোকেরা।

পুলিশ বলছে, রাজারহাট-নিউটাউনের কোথাও নির্মাণ শুরুর খবর পেলেই হাজির হচ্ছে বাইকবাহিনী। তাদের হাতে বালা, কানে দুল। হুমকির সুরে বলে আসছে, ‘‘দাদাকে বলবেন, মালটা আমাদের কাছ থেকে নিতে।’’ অমোঘ নির্দেশ। সেই নির্দেশ না-মানলে বন্ধ করে দেওয়া হবে নির্মাণ। প্রোমোটারের কপালে চড়-থাপ্পড়ও জুটতে পারে। ফলে, দ্বিগুণেরও বেশি দাম পড়ছে বালি-পাথর-ইট-সিমেন্টের।

সিন্ডিকেট সদস্যরাই বলছেন, তাঁদের কাজে বিশেষ কায়িক পরিশ্রম নেই। শুধু মহাজনের কাছ থেকে মাল নিয়ে প্রোমোটারের কাছে পৌঁছে দিলেই কাঁচা টাকা। সেই টাকায় মোটরবাইক, নেশাতুর রাত, দামি পোশাক, মোবাইল— সবই হাতের মুঠোয়। এঁদেরই কেউ কাউন্সিলর, কেউ পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে যাচ্ছেন।

এই সিন্ডিকেট সম্পর্কেই টাইমস নাওয়ের ক্যামেরায় বিধাননগরের মেয়র বলেছেন, ‘‘এরা জানে, বিধায়কের জন্য এক দিন কাজ করলে পরের সাড়ে চার বছর বিধায়ক আমাদের জন্য থাকবে।’’ একই সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘এরা না খেয়ে মরলে সরকার পড়ে যাবে।’ তিনি সিন্ডিকেটকে সাহায্য করছেন কি না, সেই প্রশ্নেও কোনও রাখঢাক না করেই বলেছেন, ‘‘হ্যাঁ, এটা খোলাখুলিই।’’ সব্যসাচীর কথায় স্পষ্ট, সিন্ডিকেটের সঙ্গে এই সরকার আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সিন্ডিকেট এখন এমন এক বাঘ, যার পিঠে উঠে পড়েছে শাসক দল। নামার উপায় নেই।

সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, ‘‘উড়ালপুল থেকে বাড়ি তৈরি, সবেতেই সিন্ডিকেটের সিলমোহর! দুর্বৃত্ত, মাফিয়া এবং সিন্ডিকেটের মাথাদের প্রশ্রয় দিয়ে প্রায় একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত গড়ে ফেলেছে তৃণমূল।’’ তাঁর মতে, এ রাজ্যে সিন্ডিকেটের বাস্তব ছবিটাই টিভির পর্দায় আর এক বার সামনে এসেছে মাত্র।সব্যসাচীর প্রার্থিপদ বাতিলের দাবিতে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে স্মারকলিপি এবং ভিডিওর কপি জমা দিয়েছে বিজেপি। অতিরিক্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসার দিব্যেন্দু সরকার বলেন, ‘‘আইনি দিক খতিয়ে দেখে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’’ পরে বিজেপির সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘‘এ সব প্রকাশ্যে আসার পরে ভারতীয় নির্বাচনীবিধি মেনে সব্যসাচীবাবুর আর ভোটে লড়ার অধিকার থাকে না।’’ ফুটেজে অবশ্য সব্যসাচীবাবু এ-ও বলেছেন, সিন্ডিকেটের কারবারে শুধু
তৃণমূল নয়, সিপিএম-বিজেপিও আছে। সব দল মিলেই কাজ করে। তবে জয়প্রকাশের দাবি, ‘‘বিজেপির সিন্ডিকেট যোগ নেই। আসলে সিন্ডিকেটের লোভে বিজেপি, সিপিএম
— সকলেই ওঁর পায়ের তলায় থাকে, এটা বোঝাতে সব্যসাচীবাবু ওই কথা বলেছেন।’’ আর সেলিমের দাবি, ‘‘তৃণমূলে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্ত একাকার হয়ে গিয়েছে! এর সঙ্গে সিপিএমের নাম জড়িয়ে লাভ নেই!’’

assembly election 2016 sabyasachi dutta syndicate raj
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy