Advertisement
০২ মে ২০২৪

জিত কার, অগ্নিপরীক্ষায় সিন্ডিকেট পাড়া

এক দিকে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে পুলিশের তৎপরতা। আবার নিরাপত্তায় মোড়া সেই সব এলাকায় ভোট-পর্বে ‘কাজ হাসিল’ করার মরিয়া চেষ্টা সিন্ডিকেট বাহিনীর।

সিন্ডিকেট অফিসে ভোটের তোড়জোড়। রবিবার, নিউ টাউনের নবপুরে। ছবি: শৌভিক দে

সিন্ডিকেট অফিসে ভোটের তোড়জোড়। রবিবার, নিউ টাউনের নবপুরে। ছবি: শৌভিক দে

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৮
Share: Save:

এ যেন চোর-পুলিশ খেলা!

এক দিকে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে পুলিশের তৎপরতা। আবার নিরাপত্তায় মোড়া সেই সব এলাকায় ভোট-পর্বে ‘কাজ হাসিল’ করার মরিয়া চেষ্টা সিন্ডিকেট বাহিনীর। রাজারহাট, নিউ টাউন, বিধাননগর — তিন বিধানসভা কেন্দ্রে সেই খেলাই শুরু হয়ে গিয়েছে শনিবার রাত থেকে।

নির্বাচন কমিশনের গুঁতোয় সে সব অঞ্চলে আদা-জল খেয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিধাননগরে গত পুর-নির্বাচনে কালি লেগে গিয়েছিল পুলিশের ভাবমূর্তিতে। পুলিশের চোখের সামনে সে দিন তৃণমূল নেতাদের মদতে সল্টলেক জুড়ে দাপিয়ে বেরিয়েছিল বহিরাগত যুবকের দল। সে দিন ভোট দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন বিধাননগরের সাধারণ মানুষ। নির্বাচনের খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকেরাও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেই ঘটনাকে ধিক্কার জানানো হয়েছিল। সমালোচনার মুখে পড়েছিল পুলিশের ভূমিকা। এ বার সেই কালি মুছতে মরিয়া পুলিশ। শেষ পর্বে, গত ২১ এপ্রিল উত্তর কলকাতার নির্বাচনের দিন কলকাতা পুলিশের তৎপরতা দেখে বিধাননগরের পুলিশও অনেকটাই সাহস পেয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা। সে দিন কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় লাঠি মেরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যত্রতত্র জটলা করা শাসক দলের সমর্থকদের। সেই পথ বেছে নিচ্ছে বিধাননগর কমিশনারেটও।

শনিবার রাতে কেষ্টপুরের একটি ক্লাবে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়, সেখানে তখন সবে মদের আসর শুরু হয়েছে। জনা ২০ যুবক বসেছেন আসর সাজিয়ে। পুলিশের অনুমান, সোমবার ভোটের ‘কাজ হাসিল’-এর পরিকল্পনা করতেই ওই সমাবেশ। সূত্রের খবর, তাদের কথা বলার বেশি সুযোগ না দিয়েই কার্যত পিটিয়ে মদের আসর বন্ধ করে পুলিশ। মঙ্গলবারের আগে সেই ক্লাবে জমায়েত না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এক পুলিশকর্তার দাবি, শুধু কেষ্টপুর নয়, রাজারহাট জুড়ে এমন যত ক্লাবে শনি ও রবিবার জমায়েত হয়েছিল, সিন্ডিকেটের যে সব ছোটখাটো ডেরায় রাতে আসর বসেছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে সেই সব এলাকা ফাঁকা করে দিয়েছে পুলিশ। নিউ টাউনে এমন ১৮টি ক্লাবের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। আসর সাজিয়ে বসা এমন ৪৪ জনকে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে শনিবার রাতে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩৫ জন গ্রেফতারও হয়েছে।

রাজারহাট, নিউ টাউন, সল্টলেক এলাকায় সব নির্মীয়মাণ বাড়িতেও হানা দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগ, নির্বাচনের সময়ে এই সব বাড়িতে অনেক বাইরের লোক শ্রমিক সেজে থাকেন। নির্বাচনের দিন সকালে নিজেদের কাজ সেরে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যান। বিধাননগরের গত পুর-নির্বাচনেও এই ভাবে নির্মীয়মাণ বাড়িতে যুবকদের জড়ো করে রাতে চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই সব বাড়িতে গিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, শুধু যে শ্রমিকদের ওই এলাকায় বাড়ি, তাঁরা এবং বাড়ির দারোয়ান ছাড়া অন্য কেউ ওই বাড়িতে থাকতে পারবেন না।

রবিবার দুপুরে নিউ টাউনের চাঁদপুরে সিন্ডিকেটের চাঁই গফ্‌ফর মোল্লা ওরফে মাটি গফ্‌ফরের বাড়িতে ধাওয়া করে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। গফ্‌ফরের বিরুদ্ধে এমনিতেই খুনের অভিযোগ ঝুলছে। তার উপরে অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের এই নেতা তৃণমূলের হয়ে ভোট করানোর পরিকল্পনা করে রেখেছেন। গফ্‌ফর শনিবার সকাল থেকেই বাড়িতে নেই বলে জানান তাঁর স্ত্রী আকলিমা বিবি।

গফ্‌ফরের মতো সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত যত চাঁই, যাঁরা এই ভোটে ‘সক্রিয়’ হতে পারে বলে আগাম খবর, তাদের এলাকাতেও হানা দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে। যেখানেই একসঙ্গে পাঁচ জন যুবকের জটলা দেখা গিয়েছে, সেখানেই তাড়া করা হয়েছে তাঁদের। তল্লাশির হাত থেকে বাদ যায়নি এলাকার হোটেল, গেস্ট হাউস, মেস। পুলিশ সূত্রের খবর, বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউসে এমন সব অতিথি পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা সেখানে থাকার যথেষ্ট কারণ দেখাতে পারেননি। তাঁদের পত্রপাঠ সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ওই সব গেস্ট হাউসের মালিক ও ম্যানেজারদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই সব গেস্ট হাউস ও হোটেলে আবার হানা দেওয়ার কথাও জানিয়েছে পুলিশ। বলা হয়েছে, এই তিন বিধানসভা এলাকায় ক্রমাগত টহল দিচ্ছে পুলিশের গাড়ি। তারাই মাঝেমধ্যে ওই হোটেল, গেস্ট হাউসে গিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছে।

এই মারাত্মক চাপের মুখে পাল্টা ঘুঁটি সাজানোর মরিয়া চেষ্টাও চলছে। সেই কাজে শাসক শিবির অনেকটাই এগিয়ে। শোনা গিয়েছিল, কলকাতার বেশ কয়েক জন তৃণমূল কাউন্সিলর এ বার বিধাননগরে গিয়ে ভোট করাবেন। যেমনটি তাঁরা গত পুর-নির্বাচনে করিয়েছেন। কিন্তু শাসক দলের একাংশই বলছে, পুলিশের এই তৎপরতায় রীতিমতো কাঁপুনি ধরেছে শাসক শিবিরেও। ফলে রাস্তায় নেমে ভোট ‘করানোর’ খেলায় অনেকেই এখন ওয়াকওভার দিয়ে দিচ্ছেন। বিধাননগরে যেতে চাইছেন না অনেকেই। আশপাশের দুই জেলা থেকে যাঁরা বুকে সাহস নিয়ে রাস্তায় নামার পরিকল্পনা করেছেন, তাঁদেরও আড়ালে থেকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশঙ্কা, কোনও কারণে এঁদের কেউ ধরা পড়ে গেলে পরে নিজেদের এলাকায় এঁরা ভোট করাতে পারবেন না। তাতে আরও বিপদে পড়ে যাবে শাসক দল।

এত পুলিশি কড়াকড়ি সত্ত্বেও রবিবার বিকেলের পর থেকেই রাজারহাটের দশদ্রোণ, ইউনিটেকের কাছে বিভিন্ন বাড়িতে বহিরাগতদের এনে জড়ো করার অভিযোগ উঠেছে মূলত শাসক দলের বিরুদ্ধেই। বেশ কিছু জায়গা থেকে সংঘর্ষের খবরও আসতে শুরু করেছে। রাতের দিকে কিছু এলাকা থেকে বুথ দখলের চেষ্টা-সহ নানা ধরনের অভিযোগ আসতে থাকে। যেমন ভারতীয় বিদ্যাভবন স্কুলের বুথের ভোটারদের বাড়ি থেকে না বেরোনোর হুমকি দেওয়া অভিযোগ ওঠে এলাকার তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে। যদিও তৃণমূলের তরফে অভিযোগ নস্যাৎ করতে সময় লাগেনি। তবে নিরাপত্তার এই কড়াকড়ির মধ্যে বুথ দখল যে করা যাবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত শাসক দল। তাই প্রক্সি ভোট যথাসম্ভব নিশ্চিত করার কথা ভাবা হয়েছে। কিছু এলাকায় প্রকৃত ভোটারের ভোটার কার্ড তৃণমূলের নেতারা হস্তগত করে রেখেছেন বলে অভিযোগ। সঙ্গে চলছে পাড়ায় পাড়ায় হুমকি। এ সব অভিযোগও অস্বীকার করেছে তৃণমূল। দলের এক নেতা অবশ্য জানিয়েছেন, বিধাননগর কেন্দ্রের সল্টলেকে তাঁদের ভরাডুবি হবে বলে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। ফলে বিধাননগর কেন্দ্রে জিততে হলে লেকটাউন ও দক্ষিণদাঁড়িতে বড় ব্যবধানে জিততে হবে। সেই কারণে ‘যা করার’ ওই দু’টি এলাকায় করতে হবে। কী করবেন? নেতার কথায়, ‘‘দেখুন না, সোমবার কী হয়।’’

সূত্রের খবর, আজ, সোমবার যে সব গাড়িতে কমিশনের আধিকারিকদের দাপিয়ে বেড়ানোর কথা, সেই গাড়ির চালকদেরও ‘বুঝিয়ে’ রাখা হয়েছে বলে নেতাদের দাবি। কোথাও কোনও ঘটনার অভিযোগ পেলে কমিশনের লোকজন ঘটনাস্থলে যাতে দেরি করে পৌঁছোন, তার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে ওই চালকদের হাতে।

তথ্য: আর্যভট্ট খান, কাজল গুপ্ত ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 security
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE