Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

উন্নয়নের ‘মুখেও’ সিন্ডিকেটের কামড়

রাজারহাটের কনভেনশন সেন্টার। উদ্যোগ বেসরকারি। তবে এটিকে রাজ্যে ‘উন্নয়নের মুখ’ হিসেবে তুলে ধরার মতো প্রকল্প বলেই মনে করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

নিজস্ব প্রতিবেদন:
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০১:০৮
Share: Save:

রাজারহাটের কনভেনশন সেন্টার। উদ্যোগ বেসরকারি। তবে এটিকে রাজ্যে ‘উন্নয়নের মুখ’ হিসেবে তুলে ধরার মতো প্রকল্প বলেই মনে করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

প্রকল্পটি নির্মাণের দায়িত্বে একটি নামী বহুজাতিক সংস্থা। সেখানেও পৌঁছে গিয়েছে সিন্ডিকেটের লম্বা হাত। অভিযোগ, চড়া দামে নিকৃষ্ট মানের ইট দিতে চেয়েছিল সিন্ডিকেট। চড়া দাম দিতে পিছপা নয় সংস্থা, কিন্তু ইটের গুণমানের সঙ্গে আপস করতে রাজি নয় তারা। এ নিয়ে সংস্থার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ টানাপড়েন চলে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অন্যতম কর্তা মাত্র কয়েক মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, নিত্যদিনের এই গণ্ডগোলের চাপ নিতে পারেননি তিনি।

ঘটনাটি প্রমাণ করে, তৃণমূলের বিধায়ক পদপ্রার্থী ও সিন্ডিকেটের প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষক সব্যসাচী দত্ত কেন বলেছেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত পড়লে সরকার উল্টে যাবে।

কারও দাদাগিরি বালি-পাথর নিয়ে, কারও ইট নিয়ে, কারও বা জমি নিয়ে, কারও আবার সিমেন্ট নিয়ে। রাজারহাট-নিউ টাউনের এই সব সিন্ডিকেট দাদাদেরই এ বার বিশেষ নজরে দেখছে নির্বাচন কমিশন। কারণ অভিযোগ, বিগত কয়েক বছর ধরে সিন্ডিকেটের এই দাদারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে ভোটের দিন ভোটকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। অভিযোগ, এরা সবাই বেড়ে উঠেছে এলাকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বড়দা, মেজদাদের ছত্রচ্ছায়ায়। তাদের জুলুমবাজির শিকার রাজারহাট-নিউ টাউনের প্রায় সব নির্মাণ সংস্থাই।

যেমন নিউ টাউনের নারায়ণপুরের তিন মূর্তির কথাই ধরা যাক। এখানেও বড়দা হাত রেখেছেন মেজদার মাথায়। আর মেজদার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছে ওরা তিন জন। যেখানে সাধারণ গৃহস্থ হারিয়ে ফেলছেন নিজস্ব জমিবাড়ি বিক্রির অধিকারটুকুও। পুলিশ জানিয়েছে, রাজু পাল ও তার ওই দলবলকে দিয়ে ভোটের দিন গণ্ডগোল পাকাবে না, এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে মুচলেকা পর্যন্ত লিখিয়ে নিয়েছে তারা।

নারায়ণপুর এলাকায় ১৩ কাঠার জমি ছিল সেখানকার একটি পরিবারের। আট মাস আগে সেই জমিটি তারা বিক্রি করেন কৈখালির এক প্রোমোটারকে। তার পর থেকেই ওই জমিই হয়ে যায় ওই পরিবার ও প্রোমোটারের গলার কাঁটা। নেপথ্যে ওই তিন মূর্তির দাদাগিরি।

নারায়ণপুরের ওই পরিবারটি জানত না লালকুঠি, তেঁতুলতলা, নারায়ণপুর বেড়াবেড়ি-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সিন্ডিকেট দাদাদের নতুন নিয়মের কথা। সেই নিয়ম হল, কারও জমি বা জমি-সহ বাড়ি থাকলে তা তিনি নিজের ইচ্ছে মতো কাউকে বিক্রি করতে পারবেন না। বিক্রি করতে হবে তিন মূর্তির সিন্ডিকেট মারফত। আর তা না হলে সিন্ডিকেটকে ওই জমির বিক্রির একটি লভ্যাংশ দিতে হবে।

ওই পরিবার জানায়, জমিটি এক প্রোমোটারকে তারা দিয়েছিলেন ‘জয়েন্ট ভেঞ্চারে’ প্রোমোটিংয়ের জন্য। কোনও ভাবে সেই খবর পায় রাজুর দলবল। আর তার পরেই আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে পাঁচিল ঘেরা জমির দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয় তারা। তার পরে প্রতি কাঠা তিন লক্ষ টাকা করে মোট ৩৯ লক্ষ টাকা ‘জরিমানা’ চাওয়া হয়।

কী তাদের অপরাধ? নিজেদের জমিতে কেন তালা ঝুলল? এর উত্তরে রাজুর দল পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, তাদের না জানিয়ে কেন প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে?

প্রোমোটিংয়ের লভ্যাংশ পাওয়া তো দূর, কোনও মতে বাজার দরে জমি প্রোমোটারকে বিক্রি করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন তাঁরা। ঝামেলা এড়াতে নারায়ণপুর এলাকা ছেড়ে উত্তর কলকাতায় চলে যায় ওই পরিবার। সিন্ডিকেটকে না জানিয়ে জমিটি কেনার ‘অপরাধে’ ৩৯ লক্ষ টাকা তোলার বোঝা এসে পড়ে ওই প্রোমোটারের উপরে। আজও ওই জমির দরজায় তালা বন্ধ। চাবি রয়েছে সিন্ডিকেটের হাতে।

এ হেন নানা অভিযোগ উঠছে রাজু-বাহিনীর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বিধাননগর পুর-নিগমের ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ এক যুবককে মারধর করার অভিযোগে রাজুর বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় এফআইআর হয়।

এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তিন মূর্তির মাথায় রয়েছে বিধাননগর পুর-নিগমের স্থানীয় চার নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহনওয়াজ আলি মণ্ডল ওরফে ডাম্পির হাত। সেই ডাম্পি অবশ্য রাজুর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে বলেন, ‘‘রাজু অত্যন্ত ভাল সংগঠক। তাঁকে বদনাম করতে ও ফাঁসাতে এ সব অভিযোগ রটানো হচ্ছে।’’ অন্য দিকে রাজুর দাবি, ‘‘আমি এ ধরনের কোনও ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নই।’’

রাজু ও তার দলবলের মতো এ রকম দাদাগিরির বহু উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে রাজারহাট-নিউ টাউনে। নারায়ণপুরে যেমন সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া জমি কেনা-বেচা যায় না, সে রকমই নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া থ্রি-র আকাঙ্ক্ষা মোড় অঞ্চলে বাড়ি তৈরির জন্য সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া একটি ইট পর্যন্ত কেনা যায় না। এমনকী, ফ্ল্যাটে রং পর্যন্ত করা যায় না বলে অভিযোগ।

যেমন কিছুদিন আগে রাজারহাটে উচ্চবিত্তদের আবাসন প্রকল্পের একটি ফ্ল্যাট রং করাতে প্রথম সারির একটি রং সংস্থাকে বেছে নিয়েছিলেন ফ্ল্যাট মালিক। রং শুরুর আগেই বাড়িতে সিন্ডিকেটের লোক এসে জানিয়ে দেয়, রং তাদের লোকদের দিয়েই করাতে হবে। তারা জানিয়ে গিয়েছে, অন্য সংস্থার লোক রং করতে এলে আবাসন চত্বরেই ঢুকতে পারবে না।

শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রং করাতে রাজি হয় ওই পরিবার। কিন্তু দেওয়ালে এক পোচ রং মারতে না মারতেই দেখা যায়, রঙের মান খুব খারাপ। সিন্ডিকেটের দাদারা এ বার পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, নিজেরা রং করতেই পারেন, কিন্তু প্রতি লিটার রঙে তাদের ‘মূল্য’ ধরে দিতে হবে। একই ভাবে কেউ বাইরে থেকে ইট কিনলেও সিন্ডিকেটের ধার্য দাম আলাদা করে গুনে দিতেই হবে তাদের হাতে। সিন্ডিকেটকে চটিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন না বুঝে সে কথাই মেনে নিতে বাধ্য নির্মাণকারীরা। মুখে মুখে এরই নাম ‘দাদাগিরি ট্যাক্স’।

এর খেসারত অবশ্য দিতে হয় শেষে ফ্ল্যাটের ক্রেতাদেরই। ওই নির্মাণকারী সংস্থা জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের সঙ্গে আপস করতে ফ্ল্যাটের দাম বর্গফুট প্রতি ২০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের দাদাদের জুলুমবাজিতে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে হয়
সাধারণ মানুষকে।

আর সব্যসাচী দত্তের মতো সিন্ডিকেট পোষণকারী নেতারা সদর্পে বলতে পারেন তাঁদের ভোটের খরচ সিন্ডিকেটের ভাইয়েরাই দেয়।

তথ্য: গার্গী গুহঠাকুরতা, কাজল গুপ্ত ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 syndicate rajarhat tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE