Advertisement
০৭ মে ২০২৪
জোট বেঁধেই বিধি বাম

এ ভাবেও জয় আসে, প্রমাণ করলেন মহুয়া

তিনি এলেন। দেখলেন। এবং জয় করলেন। দুপুর একটা নাগাদ গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথম ফোনটাই করলেন মাকে, ‘‘মা, জিতে গিয়েছি।’’

জয়ের খবর এসে গিয়েছে। গণনাকেন্দ্রে মহুয়া। — নিজস্ব চিত্র

জয়ের খবর এসে গিয়েছে। গণনাকেন্দ্রে মহুয়া। — নিজস্ব চিত্র

কল্লোল প্রামাণিক
শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০১:৩৮
Share: Save:

তিনি এলেন। দেখলেন। এবং জয় করলেন।

দুপুর একটা নাগাদ গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথম ফোনটাই করলেন মাকে, ‘‘মা, জিতে গিয়েছি।’’

ততক্ষণে কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে ছেঁকে ধরেছেন। ভিড় করেছেন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও। তিনি হাসছেন। পরনে মেরুন পাড়ের শাড়ি। পায়ে স্নিকার্স। হাসতে হাসতেই তিনি বলে চলেছেন, ‘‘এ জয় করিমপুরের কর্মীদের। এ জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এ জয় তৃণমূল কংগ্রেসের।’’

তেহট্ট হাই স্কুলের গণনাকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে করিমপুরের জয়ী তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া মৈত্র কি কিছু ভুল বললেন? যিনি উড়ে এসে জিতে বসলেন!

নাহ্, ভুল বলবেন কেন? খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো মহুয়ার সমর্থনে এসে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘মহুয়াকে জেতান। করিমপুরের উন্নয়ন আমি দেখব।’’ মহুয়াও বলছেন, ‘‘দিদিকে কথা দিয়েছিলাম, জিতব। জিতেছি। ভাল লাগছে। করিমপুরের জন্য অনেক কিছু করার আছে। সেগুলি এ বার করতে হবে।’’

জয় বলে জয়! ১৯৭৭ থেকে সীমান্তের এই কেন্দ্রে টানা জিতে এসেছে সিপিএম। পরিবর্তনের বাজারে কংগ্রেসকে সঙ্গী করে তৃণমূল যাও বা লড়াই দিয়েছিল, পরের ভোটেই কুপোকাত। ২০১৩ সালে এই বিধানসভা এলাকার ১৪টি পঞ্চায়েতের মধ্যে একটিতেও তৃণমূল জিততে পারেনি। সিপিএম একাই ৯টি দখল করে। কংগ্রেস পায় ৩টি, আর একটি বিজেপি-কংগ্রেস যৌথ ভাবে দখল করে। করিমপুর-১ ও ২ পঞ্চায়েত সমিতি সিপিএমের দখলে। জেলা পরিষদে ৫টি আসনেই জয়ী হয় সিপিএম। পরে অবশ্য এক সদস্য তৃণমূলে যোগ দেন। কংগ্রেস ভাঙিয়ে একটি পঞ্চায়েতও দখল করে তৃণমূল। ওই পর্যন্তই!

কিন্তু এ বারের ভোট-যুদ্ধের খোলনলচেটাই বদলে দিলেন মহুয়া মৈত্র! ২০১১ সালে করিমপুর কেন্দ্রে প্রায় পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ। আর এ বার? সেই সমরবাবুকেই পরাজিত করলেন মহুয়া মৈত্র। জয়ের ব্যবধান প্রায় ১৬ হাজার! তবে এ লড়াইটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। সে কথা মানছেন মহুয়া। করিমপুরও কবুল করছে— চল্লিশটা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে মহুয়া সেটাই করে দেখালেন।

সিপিএমের এমন শক্ত ঘাঁটিতে মহুয়ার এই জয়ের রহস্য কী?

ভোটের আগের চল্লিশটা দিন মহুয়ার ছায়াসঙ্গী তৃণমূলের এক কর্মী বলছেন, ‘‘এর নাম মহুয়া-ম্যাজিক! ওঁর পরিশ্রম, কর্মীদের সংগঠিত করা ও মানুষকে সহজেই আপন করে নেওয়ার ক্ষমতার ফল এটা।’’ কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়। ভোটের আগে করিমপুরের ২৫৯টি বুথের প্রতিটি অলিগলিতে তিনি প্রচার করেছেন। প্রান্তিক এই জনপদে রোদচশমা-শাড়ি-স্নিকার্স পরা মহুয়ার দৌড় দেখে বিরোধীরাও কবুল করেছেন, ‘‘বাপের বাপ, খাটতেও পারে মেয়েটা।’’ এটা তাহলে সেই খাটনির ফল?

‘‘একশো বার। তবে আরও আছে। ভোট করেন কর্মীরা। নেতারা নয়। আর বাঘ মারতে হলে জঙ্গলে যেতে হয়। ঘরে বসে মোবাইলের নম্বর টিপে সেটা হয় না। মহুয়া দিদি এই সার কথাটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। এবং করে দেখালেন।’’ সিপিএম নেতাদের একাংশও এ দিন কবুল করেছেন, ‘‘মহুয়া যে ভাবে, যে কায়দায় প্রচার করেছেন, সেটা আমরা করে উঠতে পারিনি। এটা তো একটা বড় খামতি বটেই।’’

সেই খামতিটা এ দিন গণনার শেষ পর্যায় পর্যন্তও থেকে গিয়েছে। গণনার প্রায় প্রতি পর্যায়েই মহুয়া তাঁর জয়ের ব্যবধান সমানে বাড়িয়ে গিয়েছেন। তবে গণনার শেষে রহস্যজনক ভাবে দেখা মেলেনি সিপিএম প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষকে। দুপুরের পর থেকে তাঁর মোবাইলের স্যুইচও বন্ধ ছিল। তবে সিপিএমের নেতাদের একাংশ এ দিন বলেছেন, ‘‘নদিয়ার মধ্যে সবথেকে নিরাপদ আসন এই করিমপুর। অথচ সেখানে তৃণমূলের এই জয় বড় ধাক্কা তো বটেই।’’

করিমপুর ১ ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি তারক সরখেল বলছেন, ‘‘কংগ্রেস ও সিপিএমের এই জোটকে মানুষ ঠিক ভাবে মেনে নেননি। তাছাড়া করিমপুরও হয়তো মহুয়াকে দেখে একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। আর সেই কারণেই সব হিসেব ওলটপালট হয়ে গেল।’’ সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলির সেই আটপৌড়ে মানুষগুলো কিন্তু বলছে, ‘‘এমনটাই তো হওয়ার ছিল। ও তো আমাদের ঘরের মেয়ে গো। এই দুয়ারে বসে আমাদের সঙ্গে কত কথা বলেছিল। আশীর্বাদ চেয়েছিল। আমরাও দিয়েছি উজাড় করে।’’ মহুয়ারও মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সীমান্তের সেই তেলচিটে হলুদ মাখা আঁচলটার কথা। মহুয়ার ঘামে ভেজা কপালটা মুছিয়ে দিয়ে যে বৃদ্ধা বলেছিলেন, ‘‘জিতবি রে মা, জিতবি।’’

সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল। আর আরও একটা কঠিন লড়াই শুরু হল মহুয়ার। স্বপ্নপূরণের লড়াই। যে স্বপ্নটা করিমপুরকে দেখিয়েছেন তিনিই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE