Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সিপিএম-তৃণমূল নেতাকে থামাল প্রশাসন

পর্যবেক্ষকের সামনেই জোর ঝগড়া

গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বৈঠক পর্যবসিত হল শাসক ও বিরোধী দলের পরস্পরের প্রতি বেনজির কাদা ছোড়াছুড়িতে! সোমবার বাঁকুড়া সার্কিট হাউসে এমনই কাণ্ডের সাক্ষী রইলেন নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক নরেন্দ্র চৌহান। নির্বাচনের আগে প্রশাসনের কাজ নিয়ে কোনও অভিযোগ রয়েছে কিনা, তা জানতেই এ দিন বিশেষ পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে সার্কিট হাউসে ডাকা হয়েছিল সর্বদল বৈঠক।

বাঁকুড়ায় বৈঠক শেষ। বেরিয়ে আসছেন পর্যবেক্ষক নরেন্দ্র চৌহান। (ডান দিকে), পুরুলিয়ায় চলছে নির্বাচনী বৈঠক। —নিজস্ব চিত্র

বাঁকুড়ায় বৈঠক শেষ। বেরিয়ে আসছেন পর্যবেক্ষক নরেন্দ্র চৌহান। (ডান দিকে), পুরুলিয়ায় চলছে নির্বাচনী বৈঠক। —নিজস্ব চিত্র

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বৈঠক পর্যবসিত হল শাসক ও বিরোধী দলের পরস্পরের প্রতি বেনজির কাদা ছোড়াছুড়িতে!

সোমবার বাঁকুড়া সার্কিট হাউসে এমনই কাণ্ডের সাক্ষী রইলেন নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক নরেন্দ্র চৌহান। নির্বাচনের আগে প্রশাসনের কাজ নিয়ে কোনও অভিযোগ রয়েছে কিনা, তা জানতেই এ দিন বিশেষ পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে সার্কিট হাউসে ডাকা হয়েছিল সর্বদল বৈঠক। বৈঠকের শুরুতেই তুমুল বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল এবং সিপিএম নেতারা। শাসক দল সন্ত্রাস চালাচ্ছে, টাকা দিয়ে ভোট কিনতে নেমে পড়েছে— বৈঠকে সিপিএমের প্রতিনিধির এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে পাল্টা খুনের অভিযোগ, এমনকী কঙ্কাল-কাণ্ড পর্যন্ত তুলে আনলেন তৃণমূলের প্রতিনিধি! শেষে প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যস্থতায় থামল বচসা।

এ দিন দুপুরে বীরভূম থেকে বাঁকুড়া সার্কিট হাউসে আসেন নরেন্দ্র চৌহান। উপস্থিত ছিলেন জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু, অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি সংস্কার) পার্থ ঘোষ-সহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। আর ছিলেন বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে সিপিএমের প্রতিনিধি, তালড্যাংরার বিদায়ী বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্র ভোটে শাসক দলের একাধিক প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে সরব হন। তিনি দাবি করেন, বিদায়ী মন্ত্রী তথা বিষ্ণুপুরের তৃণমূল প্রার্থী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাস ভাড়া করে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে আসছেন বিষ্ণুপুরে। তারপর সবাইকে ঢালাও খাওয়াদাওয়া করিয়ে ভোটের কাজে লাগাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ক্লাবকে এবং গাঁ-গঞ্জের অনেক ভোটারকে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে চাইছেন তিনি বলে অভিযোগ করে সিপিএম। ঘটনাচক্রে রবিবারই বিষ্ণুপুরে একটি গাড়ি আটক করে লক্ষাধিক টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। মনোরঞ্জনবাবুর দাবি, ওই টাকাও ভোট কেনার কাজেই ব্যবহার করতে চলেছিল তৃণমূল।

সূত্রের খবর, এর পরেই মনরঞ্জনবাবুর অভিযোগের তির ঘুরে যায় সোনামুখীর বিদায়ী বিধায়ক, এ বারের তৃণমূল প্রার্থী দীপালি সাহার দিকে। গত লোকসভা নির্বাচনে দীপালিদেবীর বিরুদ্ধে সোনামুখীর সাহাপুর বুথে ঢুকে বুথকর্মীদের পিটিয়ে ছাপ্পা ভোট করানোর অভিযোগে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়েছিল। সে কথাও এ দিনের বৈঠকে পর্যবেক্ষকের কাছে তুলে ধরে মনোরঞ্জনবাবু অভিযোগ করেন, জামিনে মুক্ত থাকা দীপালিদেবী এ বারের ভোটেও নানা জায়গায় সন্ত্রাস চালাচ্ছেন। পাশাপাশি, তালড্যাংরায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে তৃণমূলের দেওয়াল লিখন করানো হচ্ছে-সহ আরও কিছু অভিযোগ জানান। তিনি বলেন, “রাজ্যে পালাবদলের পরে পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে মানুষ ঠিক ভাবে নিজের ভোটাধিকারই প্রয়োগ করতে পারেননি।’’

দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে নাগাড়ে এ সব অভিযোগ শুনেই ফুঁসছিলেন বৈঠকে তৃণমূলের প্রতিনিধি তথা দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বলার সুযোগ আসতেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সরাসরি মনোরঞ্জনবাবুকে আক্রমণ করেন তিনি। আঙুল উঁচিয়ে বলেন, “যিনি আমাদের দলের বিরুদ্ধে এই সব অভিযোগ তুলছেন, আপনারা জেনে রাখুন, তিনি নিজেই একটি খুনের আসামি। এখানে চোরের মায়ের বড় গলা হচ্ছে দেখছি।’’ ঘটনা হল, এক তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত মনোরঞ্জনবাবুকে জেল হাজতে থাকতে হয়েছে। তিনি বর্তমানে জামিনে মুক্ত।

জয়দীপবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই হাঁ হাঁ করে ওঠেন বৈঠকে উপস্থিত ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক অনাথ মল্ল, আরএসপি-র জেলা সম্পাদক গঙ্গা গোস্বামী এবং কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর সিংহরা। জোট ঐক্য দেখা যায় এখানেও। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, “এখানে কেন এসব কথা হবে?’’ যদিও কোনও কথায় কান না দিয়ে জয়দীপবাবু বলে চলেন, “ওদের (সিপিএমের) তালড্যাংরার যিনি প্রার্থী হয়েছেন, তিনি বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন। তালড্যাংরার বহু জায়গায় মাটি খুঁড়লে এখনও কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে!’’ এর পরেই প্রশাসনের আধিকারিকদের অনেকেই জয়দীপবাবুর উদ্দেশে বলেন ‘থামুন, থামুন’। বৈঠক সূত্রের খবর, এর পরই জয়দীপবাবু খানিক থেমে বিশেষ পর্যবেক্ষকের উদ্দেশে বলেন, “যত খুশি কেন্দ্রীয় বাহিনী আসে আসুক। আমাদের আপত্তি নেই। ওদের কর্মী নেই বলে ওরা প্রচার করতে পারছেন না। এতে আমাদের দোষ কী।’’

বৈঠকের পরে একের পর এক বিরোধী নেতারা বাইরে বেরিয়ে এসেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। দীপঙ্করবাবু বলেন, “তৃণমূলের বাইক-বাহিনী জেলার সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছে।’’ মনোরঞ্জনবাবুর কটাক্ষ, “বিষ্ণুপুর ও সোনামুখীর বাস্তব চিত্রটাই তুলে ধরেছি বিশেষ পর্যবেক্ষকের সামনে। তাতেই তৃণমূলের প্রতিনিধির এত রাগ হয়েছে।’’ অনাথবাবু, গঙ্গাবাবুরা বলেন, “প্রশাসনের কাজে আমরা খুশি নই। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গ্রামের ভিতরে টহল দিতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু রাজপথে হেঁটেই ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছেন জওয়ানেরা।’’ পাত্রসায়রের মতো সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই বলেও বিরোধীদের অভিযোগ। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলেন বিজেপি-র প্রতিনিধি দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায়ও।

বিরোধীদের অভিযোগ শুনে বৈঠকের ভিতরেই জেলাশাসককে বিশেষ পর্যবেক্ষক কমিশনের নির্দেশ ভাল করে দেখে তা মেনে চলার নির্দেশ দেন। পরে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, “জেলা প্রশাসনের কাজে আমি সন্তুষ্ট। যে-সব এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে, ভোটের আগে নিশ্চই সেই এলাকাগুলিতেও বাহিনী যাবে। জেলাশাসক সব দিক খতিয়ে দেখছেন।’’

বাঁকুড়ার পরে পুরুলিয়ায় যান বিশেষ পর্যবেক্ষক। পুরুলিয়ার সার্কিট হাউসের মিটিং হলে সর্বদল বৈঠক সারেন তিনি। ওই বৈঠকে ফরওয়ার্ড ব্লকের তরফে জেলার ঝাড়খণ্ড সীমানা সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ ভাবে মদ এনে ভোটারদের প্রভাবিত করার বলে অভিযোগ করা হয়।

সিপিএমের এ-ও অভিযোগ, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর সভার জন্য একটি মাঠের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু, অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। উল্টে সেই মাঠে একই দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী পরে বলেন, “বৈঠকে বিশেষ পর্যবেক্ষক কিছু ব্যবস্থা আমাদের নিতে বলে গিয়েছেন। দ্রুত সেই ব্যবস্থা নেব।’’

(সহ প্রতিবেদন: প্রশান্ত পাল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE