আলিপুরদুয়ারে রোডশো অধীরের, সঙ্গে সিপি জোশী।—নিজস্ব চিত্র
সরকারি-বেসরকারি যে কোনও বৈঠকেই একজন অবধারিত ভাবে পৃথক জেলা গঠনের দাবি তুলতেন। তা নিয়ে কম রসিকতা শুনতে হয়নি তাঁকে। অন্যজন আবার জেলার দাবিকে সমর্থন করতে দলের লাইনও ভেঙেছেন বারবার। আর তৃতীয় জন বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী জেলা গড়ে দিয়েছেন, এবার বাকি পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য আমাকে জিততে পাঠিয়েছেন।’’
দীর্ঘদিন ধরেই জেলার দাবিতে ভর করে আলিপুরদুয়ারে ভোট এসেছে, ভোট পার হয়েছে। পৃথক জেলার স্বীকৃতি পাওয়ার বছর দেড়েক বাদেও বিধানসভা ভোটে প্রচার চলছে সেই ছায়ায়। আলিপুরদুয়ারের প্যারেড গ্রাউন্ডের সরকারি ভাবে জেলা ঘোষণার দিন মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশেই ছিলেন সৌরভ চক্রবর্তী। প্রচারে বেরিয়ে সেই ছবিটাই ফের বাসিন্দাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবে সেই ছবিতেও জোট সমীকরণের ছায়া রয়েছে।
এই কেন্দ্রে আরএসপি প্রার্থী প্রাক্তন বিধায়ক নির্মল দাস। টানা পাঁচবার আলিপুরদুয়ার বিধানসভায় জিতেছেন নির্মলবাবু। জেলার দাবি নিয়ে মহাকরণ থেকে অবিভক্ত জলপাইগুড়ির জেলা প্রশাসনের দফতরে তাঁর ছুটোছুটির কথা এখনও লোকমুখে ফেরে। এমনকী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাতেও ঘুরিয়ে আলিপুরদুয়ারকে পৃথক জেলার ঘোষণা করার দাবি তুলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। প্রশাসনিক অফিসারদের কাছে ‘জেলা পাগল এমএলএ’ নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন নির্মলবাবু। আরএসপির এক নেতাকে তাই সভায় বলতে শোনা গেল, ‘‘হতে পারে তৃণমূলের আমলে জেলা ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু জেলার ভিত্তিতো আমাদের নির্মল দা-ই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন।’’
এই ভিত্তি প্রস্তুতির কৃতিত্বের দাবি নিয়ে ছুটছেন নির্মলবাবুও। তবে চৈত্রের দুপুরে খানিকটা ধরা-ধরা শোনা গেল নির্মলবাবুর গলা। গত বিধানসভায় দল তাঁকে টিকিট দেয়নি। তার জায়গায় দলের ‘হেভিওয়েট’ ক্ষিতি গোস্বামীকে প্রার্থী করেছিল বামেরা। যদিও, কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন ক্ষিতিবাবু। এবারের বিধানসভায় নির্মলবাবুই বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী বলে আলিপুরদুয়ারে এসে দাবি করে গিয়েছিলেন ক্ষিতিবাবুই। যদিও, কংগ্রেস তা মানেনি। জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিশ্বরঞ্জন সরকার প্রার্থী হয়েছেন। আরএসপি-র সিদ্ধান্ত মানেনি শরিক সিপিএমও।
আলিপুরদুয়ারের সিপিএম নেতারা প্রকাশ্যে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করেই প্রচার চালাচ্ছেন। দুপুর বেলায় দলের পার্টি অফিসেই দেখা মিলল নির্মলবাবুর। পার্টি অফিসে ঢুকে দেখা গেল জনাকয়েক যুবক পার্টি অফিসের সামনে। ভিতরের ঘরে একা বসে রয়েছেন নির্মলবাবু। একা ঘরে বসে তিনি বলে যান, ‘‘বিমানদা (বিমান বসু) আমাকে বামফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এখানকার সিপিএম সে সব মানছে না। খুব কষ্ট হয়। এতদিন কিন্তু বাম ঐক্যের জন্যই কাজ করেছি।’’
মনে কষ্ট নিয়েই সিপিএমকে বিধঁছেন নির্মলবাবু। টেনে আনছেন অতীত। দাবি করছেন। ‘‘আজকে ওঁরা তাঁর (কংগ্রেস প্রার্থীর) সঙ্গে রয়েছে, অথচ অতীত সকলেই জানেন।’’ কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বরঞ্জনবাবুর দিকে ইঙ্গিত করে তাঁর অভিযোগ, ‘‘একসময় জ্যোতি বসু, কমল গুহকে এখানে মিটিং করতে দেওয়া হয়নি। তাঁর পিছনে কে ছিলেন সবাই জানেন।’’ নির্মলবাবুর যুক্তি অবশ্য নস্যাৎ করে দিচ্ছেন ফ্রন্ট শরিকরাই। সিপিএমের আলিপুরদুয়ার জোনাল কমিটির সদস্য সুধাংশু বিশ্বাস বলেন, “ও সব তো বাবর-আকবরের আমলের কথা। এখন তৃণমূলের হাত থেকে সাধারণ মানুষদের বাঁচাতে হবে।’’
বিশ্বরঞ্জনবাবুকে দেখা গেল নিজের পার্টি অফিসে সিপিএম নেতাদের সাদরে ডেকে আনছেন। বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথাতেও জেলার প্রসঙ্গ। একসময়ে আলিপুরদুয়ারে জেলার দাবিকে সমর্থন করে নিজের দলের একাংশের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। সে সব অবশ্য খুব একটা তোয়াক্কা করেননি তিনি। বিশ্বরঞ্জনবাবু বললেন, “আলিপুরদুয়ারে কে কতটুকু উন্নয়ন করেছেন সবাই জানেন। আলিপুরদুয়ার জেলা হয়েছে। এই দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে তা হয়েছে তা অস্বীকার করি না। কিন্তু তারপরে। পরিকাঠামোর কিছুই নেই। বাকিটা ক্ষমতায় এসে আমাদের করতে হবে।’’
জেলা গঠন হলেও, সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট যে অঙ্ক ঘুরিয়ে দিতে পারে তা বিলক্ষণ বোঝেন তৃণমূলের ভোট ম্যানেজাররা। তায় আবার কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বরঞ্জনবাবু। যিনি নাকি সৌরভবাবুর রাজনৈতিক গুরু বলেই পরিচিত। জেলার আবেগের নিরিখে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা নিজেদের এগিয়ে রাখলেও, সিপিএম-কংগ্রেস জোট যে সহজ অঙ্কেও জল ঢালতে পারে, তা বোঝেন রাজ্য রাজনীতিতে অভিজ্ঞ সৌরভবাবু।
তাই সাত সকালেই পদযাত্রায় বেরিয়ে পড়ছেন তিনি। কারও পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন। কাউকে জড়িয়ে ধরছেন। কারও সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ী থেকে রিকশাচালক, দিনমজুর বাছবিচার করছেন না। বলছেন, “দাদা এবার কিন্তু আমাকে ভোট দিতেই হবে।” পরিচিত কংগ্রেসিদের দেখলে দাবি করছেন, “আলিপুরদুয়ারে আমার থেকে বড় কংগ্রেস কে আছে।” আবার বামেদের চেনা মুখ দেখলে, মিছিল থেকে টেনে সামনে আনছেন তৃণমূলে যোগ দেওয়া পুরোনো বামপন্থীদের। তাঁদের দেখিয়ে বলছেন, ‘‘এই যে দেখুন না, ওঁরা সব আমাদের সঙ্গেই আছেন।” জেলার হাওয়ায় ভর করেও পাল্টা জোটের অঙ্ক কষছেন সৌরভবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy