প্রতিবাদের স্বর ক্রমশ জোরালো হতেই রাজা তা হলে ভয় পাচ্ছেন!
হালিশহরের উপ-পুরপ্রধান রাজা দত্তের বিরুদ্ধে বুধবারই মুখ খুলেছিলেন তার নিহত অনুচর, বান্টির বাবা শক্তিপদ ঘোষ। ওই রাতেই আগুন লাগানো হল তাঁদের একটি ঘরে। শক্তিপদবাবু এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভয় ধরাতেই রাজার অনুগামীরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
হীরক-রাজের ‘যন্তর-মন্তর ঘর’ ছিল। সেখানে প্রতিবাদীদের মগজ-ধোলাই হতো। হালিশহরের রাজার তেমন ঘর নেই। তাই মগজ-ধোলাইয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু ‘পেয়াদা’রা তো আছে! প্রতিবাদের স্বর দমাতে তারা কসুর করবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা তুলে ধরছেন দেবশ্রী ঘোষের স্বামী শ্যামলবাবুকে দিয়ে মুচলেকা লেখানোর কথা।
হালিশহরে ভোটের (২৫ এপ্রিল) আগের রাতে বারেন্দ্র গলির সমাজপতি পরিবারের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল রাজা দত্তের অনুচরদের বিরুদ্ধে। ভোটের দিন যাতে সে বাড়ির কেউ বুথে না যান, তা নিশ্চিত করতে ওই হামলা হয় বলে অভিযোগ। প্রহৃত হন গৃহকর্তা টিটু সমাজপতি ও তাঁর মেয়ে দেবশ্রী ঘোষ। হামলাকারীরা দেবশ্রীর তিন বছরের মেয়ে সায়ন্তিকাকেও রেয়াত করেনি। তা সত্ত্বেও ভোট দিতে গিয়েছিলেন দেবশ্রী। ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন পাড়ার লোকেদেরও। তার পরেই দেবশ্রীর স্বামী শ্যামল ঘোষকে শুনতে হয়েছিল ঠান্ডা গলার ‘হুমকি’। চাপে পড়ে শ্যামলবাবু রাজাকে মুচলেকায় লিখে দেন, ‘আমাদের বাড়িতে তৃণমূলের কেউ হামলা করেনি...’। পড়শিদের অনেকেই মনে করেন, রাজাকে যাতে পুলিশ ছুঁতে না পারে, তাই ভয় দেখিয়ে ওই মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, রাজার মনেও ভয় ধরেছিল।
দেবশ্রীদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই জারি রাখার সাহস জুগিয়ে এসেছিলেন বান্টির বাবা শক্তিপদবাবু এবং মা সাধনাদেবী। তার পর থেকেই তাঁদের নজরে রাখা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। বুধবার শক্তিপদবাবু প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘‘সবাই জানে আমার বছর চব্বিশের জলজ্যান্ত ছেলেটা কী ভাবে খুন হল। আমরা চাই, এ বার রাজার মুখোশ খুলুক। এর শেষ দেখব।’’ দলে গোলমালের জেরেই বছর দুয়েক আগে রাজার অঙ্গুলি-হেলনে তার অনুচররা বান্টিকে খুন করে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। আর ওই রাতেই তাঁর বাড়িতে আগুন!
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ শক্তিপদবাবু ও তাঁর স্ত্রী বাড়ির বাইরের দিকের একটি ঘরে ছিলেন। সেই সময় শক্তিপদবাবু দেখতে পান, পিছন দিকের একটি ঘর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। গিয়ে দেখেন, বিছানা, বালিশ, মশারি-সহ তক্তপোষ জ্বলছে। পড়শিদের সাহায্যে তাঁরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। সেই সময় শক্তিপদবাবুর নজরে আসে, দলা পাকানো একটি কাপড়ের গোলা। ততক্ষণে সেটি অবশ্য ছাই হয়ে গিয়েছে। পরে সেখানে পুলিশ আসে। শক্তিপদবাবু বীজপুর থানায় গিয়ে বাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ জানায়, অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত
শুরু হয়েছে।
শক্তিপদবাবু বলেন, ‘‘মুখ খোলার জন্যই জ্বলন্ত কাপড়ের পুঁটলি ছুড়ে রাজার ছেলেরা ঘরে আগুন লাগাল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা পিছু হটব না। আগেই বলেছি, আর মরতে ভয় পাই না। এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’ বান্টির স্ত্রী পায়েলের অভিযোগ, তাঁকে নিয়মিত হুমকি দিচ্ছে রাজার অনুচররা। ভোটের বিকেলে রাজার অনুচর পাপনকে (বান্টি খুনে অভিযুক্ত) খুনের চেষ্টা হয়েছিল। পরের দিন রাতে পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে থানায় যেতে বলে। মহিলা-পুলিশ না থাকায় তিনি যেতে রাজি হননি। সেই সময় কিছু যুবকও ঘরে ঢুকে তাঁকে তখনই থানায় যাওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। তারা রাজারই লোক বলে দাবি পায়েলের। পুলিশ অবশ্য ওই যুবকদের কথা জানে না বলে
দাবি করেছে। একই সঙ্গে পুলিশ জানিয়েছে, পায়েলকে ওই রাতে নয়, পরে যে কোনও সময় থানায় দেখা করতে বলা হয়েছিল।
এলাকার বাসিন্দারা মনে করছেন, ভোটের পরে নিজে এলাকাছাড়া হলেও এ ভাবে ভয়ের পরিবেশ জারি রাখতে মরিয়া রাজা। না হলে পুকুর ভরাট থেকে বালি-খাদান চালানো, জোর করে পুরনো বাড়ি দখল করে নেওয়া— মানুষের ভয় কেটে গেলে এই সব ‘অবৈধ কারবার’ ধরে রাখা রাজার পক্ষে দুষ্কর হবে। তাই নিজের এলাকার ‘পেয়াদা’দের সরিয়ে রাজা বাইরে থেকে ‘পেয়াদা’ আনছে বলে অভিযোগ। কেউ কেউ দাবি করেছেন, বাইরে থেকে আসা যুবকেরা মোটরবাইক নিয়ে মাঝেমধ্যেই রাস্তায় চক্কর কাটছে। রাস্তার কোথাও বাসিন্দারা জড়ো হলেই তাঁদের ওই বাইক-বাহিনীর ঠান্ডা দৃষ্টির সামনে পড়তে হচ্ছে। পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, ওই এলাকায় রাতে টহল জারি রয়েছে।
হালিশহরের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা রঞ্জিত এবং অসীম। তাঁরা বলেন, ‘‘বান্টি খুনের ঘটনায় যে রাজার হাত রয়েছে, তা অনেকেই জানেন। কিন্তু, রাজা এবং তার দলবলের ভয়ে কেউই মুখ খোলেননি। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না। আর রাজার বিরুদ্ধে গেলে কাউকেই পাশে পাওয়া যাবে না, সেটাও সবাই জানতেন। কিন্তু এ বার কেউ কেউ মুখ খুলছেন, এটাই আশার আলো।’’
সেই আলোতে আরও স্পষ্ট হচ্ছে রাজ-কাহিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy