Advertisement
১৮ মে ২০২৪

টাকা ঢেলে তেষ্টা মেটাচ্ছেন সালমারা

জল দেওয়ারই প্রচার চালিয়ে পাঁচ বছর আগে বিধানসভার ভোট হয়েছিল। জল আসেনি। উল্টে গাঁটের কড়ি খসিয়েই বাসিন্দাদের জল কিনতে হচ্ছে। এটাই ওন্দার পুনিশোল এলাকার দস্তুর হয়ে উঠেছে। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন— ‘জল নাও, টাকা দাও’ এটাই পুনিশোলের এখন স্লোগান হয়ে উঠেছে।

কড়ি দিলে তবেই মিলবে জল। তাও দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে অপেক্ষার পরে।  ছবি: অভিজিৎ সিংহ

কড়ি দিলে তবেই মিলবে জল। তাও দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে অপেক্ষার পরে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুনিশোল (ওন্দা) শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০২:১৩
Share: Save:

জল দেওয়ারই প্রচার চালিয়ে পাঁচ বছর আগে বিধানসভার ভোট হয়েছিল। জল আসেনি। উল্টে গাঁটের কড়ি খসিয়েই বাসিন্দাদের জল কিনতে হচ্ছে। এটাই ওন্দার পুনিশোল এলাকার দস্তুর হয়ে উঠেছে। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন— ‘জল নাও, টাকা দাও’ এটাই পুনিশোলের এখন স্লোগান হয়ে উঠেছে।

প্রচণ্ড গরমে খটখটে বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তাতে মাটি কিছুটা রস পেলেও জলের সঙ্কট কাটেনি। বিভিন্ন এলাকায় গেলেই দেখা যায়, নলবাহিত কলের সামনে হাঁড়ি, কলসি, বালতি, ড্রাম— সারি সারি বসানো। কখন জল আসতে তারই প্রতীক্ষায় থাকেন বাসিন্দারা।

পুনিশোলেও পাইপলাইনের জল পৌঁছনোর আশ্বাস দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু সেই জল আসেনি। প্রচণ্ড গরমে কুয়ো শুকিয়ে গিয়েছে। যে ক’টি নলকূপ ছিল, তারও কয়েকটি অকেজো হয়ে পড়েছে অগত্যা অধিকাংশ বাসিন্দার ভরসা পড়শির সাবমার্সিবল পাম্পের তোলা জল।

কিন্তু সেই জলও তো দিনের পর দিন ‘ফ্রি’তে পাওয়া যায় না। অগত্যা জলের জন্য দিতে হচ্ছে টাকাও। পাঠানপাড়ার বাসিন্দা মঞ্জির আলি খানের বাড়ির সামনে জল নেওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়েছিল। মাটিরবাড়ির খড়ের চালার ছায়ার আড়ালে বসেছিলেন মঞ্জির সাহেব। কোনও রাখঢাক না করেই তিনি সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, তাঁকে দিনে দু’টাকা দিলেই দিনভর জল নেওয়ার ছাড় দিচ্ছেন। তবে যখন তখন গেলেই জল মিলবে না। রীতিমতো সময়ও বেঁধে দিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১০টা ও বিকেলে ৩টে থেকে ৫টা পর্যন্ত জল দেওয়া হয়। জল নেওয়ার জন্য পাত্র আগে থেকেই লাইনে রেখে যান বাসিন্দারা। মঞ্জির সাহেবের পড়শি সাহান আলি সর্দারও একই রেটে জল দেন গ্রামবাসীকে।

পাঠানপাড়ার পাশাপাশি পুনিশোলের জিড়রি পাড়া, হঠাৎপাড়ার মতো বিভিন্ন পাড়াতেও একই ভাবে ব্যক্তিগত সাবমার্সিবল পাম্প থেকে জল বিক্রি করা হচ্ছে গ্রামবাসীকে। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, গত ছ’মাস ধরে জলের সমস্যা তীব্র আকার নিয়েছে এলাকায়। আর তখন থেকেই ব্যক্তিগত সাবমার্সিবলে জল বিক্রির ধুম পড়েছে এলাকায়।

কেন এ ভাবে জল বিক্রি? মঞ্জিরের উত্তর, “এই গ্রামে ‘পানি’ মেলে না। মাগনায় জল পেতে গেলে হাঁড়ি, কলসি নিয়ে অনেক দূর যেতে হবে।মাইল-মাইল হেঁটে যাওয়ার থেকে এই ব্যবস্থা তো অনেক ভাল।” তাঁর কথার মাঝেই জল নিতে আসা আলিহোসেন খান, অসগর আলি দালাল, শাহ আলম দালালরা প্রশ্ন তোলেন, “উনি দু’টো টাকার বিনিময়ে পানি দিচ্ছেন বলেই আমরা তেষ্টা মেটাতে পারছি। প্রশাসন কী করেছে আমাদের জন্য?’’ মঞ্জির সাহেবের যুক্তি, “জল বিক্রি করার কোনও ইচ্ছেই আমাদের নেই। কিন্তু কী করব? দিনে অন্তত পাঁচশো মানুষ জল নেন। পাম্প চালানোর বিদ্যুৎ খরচ আছে, মেশিনও প্রায়ই খারাপ হয়ে যায়। সেই খরচ তুলতেই টাকা নিতে হচ্ছে।” তিনি যুক্ত করেন, “পানি কি আর বেচবার জিনিস?’’

কেউ কেউ আবার জলের জন্য টাকা নিচ্ছেন না। যেমন পুনিশোলের কেশবপুরের আবুল হোসেন মল্লিক। তিনি এলাকার ডাক্তার। তৃণমূল নেতা হিসেবেও পরিচিত। বয়স্ক মানুষটির সরল স্বীকারোক্তি, “কোন মুখে টাকা চাইব! এলাকার উন্নয়ন হবে আশ্বাস দিয়ে গত বিধানসভা ভোটে পরিবর্তন এনেছিলাম। কিন্তু গ্রামবাসীরা নন, কিছু ব্যক্তি লাভবান হলেন! মুখ লুকোনোর জায়গা নেই আমাদের। মানুষের কষ্ট দেখে তাই দু’বেলা নিজের সাবমার্সিবল চালিয়ে জল দিচ্ছি।’’

গ্রামবাসী জানাচ্ছেন, পুনিশোলের বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় পর্যাপ্ত নলকূপ নেই। আবার জলস্তর নেমে যাওয়ায় বহু কলে আবার জলই উঠছে না দীর্ঘদিন ধরে। এক একটি নলকূপের উপর হাজার খানেক গ্রামবাসী নির্ভরশীল। ফলে প্রায়ই খারাপও হয়ে যায় কলগুলি। পুনিশোলের পশ্চিম দক্ষিন পাড়ার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এলাকার একটি কলের উপরেই তাঁদের ভরসা। তাও আবার মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। তখন বাসিন্দারাই পকেট থাকে চাঁদা দিয়ে ওই কল সারান।

কেন পঞ্চায়েতে যান না? তাঁদের বক্তব্য, পঞ্চায়েতে গেলে মেরামতি করতে অনেক দেরি হবে। তাই নিজেরাই কাজটা করিয়ে নিচ্ছেন। পুনিশোলের প্রবীণ বাসিন্দা ফতেনুর মণ্ডল বলেন, “এলাকায় অনেক কুয়ো রয়েছে। কিন্তু সেগুলিতে আর জল নেই। তাই আমাদের সমস্যাটা আরও বেড়ে গিয়েছে। এত জলকষ্ট আগে হত না।”

এলাকার বধূ সাহানা বিবি, সালমা বিবি, নুর আইস বিবি পাড়ার আবুল হোসেনের সাবমার্সিবল-এ জল ভরতে এসেছিলেন। তাঁদের কথায়, অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে পাইপ লাইনে করে জল দেওয়া হবে এলাকায়। তাঁদের আক্ষেপ, “আজ আসবে, কাল আসবে করে দু’তিন বছর পার হয়ে গেল। জল এল না।” কবে এই সমস্যা মিটবে তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। এই প্রশ্ন উঠছে পুনিশোলের সব জায়গাতেই।

কথায় আছে পুনিশোলে হালে পানি পেলেই ওন্দা বিধানসভায় ভোট বৈতরণী পার হওয়া যায়। এ বারের ভোটেও বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের পুনিশোলের মন পেতে এলাকায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। কোন পক্ষ পুনিশোলের ভোটে পানি পায়, জানা যাবে আগামী ১৯ মে ভোট গণনার দিনেই। কিন্তু পুনিশোলের মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর পানি কবে মিলবে? তার সদুত্তর মেলেনি প্রশাসনের কাছেও। ওন্দার বিডিও শুভঙ্কর ভট্টাচার্যের আশ্বাস, “পুনিশোলে জলের সমস্যা মেটাতে নতুন নলকূপ তৈরির কাজ শুরু করা হবে। এ ছাড়া দ্বারকেশ্বর নদ থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ওই গ্রামে জল দেওয়াও হবে।” কিন্তু কবে সেই প্রকল্পের জল গড়াবে পুনিশোলে, তার সদুত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Water crisis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE