Advertisement
০২ এপ্রিল ২০২৩
BJP

Bengal Polls: ক্ষোভের পাঁকে পদ্ম ফুটছে দেদার

রায়দিঘির ভোটার কি এ বারও এই সরালের মতোই? গত দু’বার অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের কাছে কান্তির পরাজয় কষ্ট দিয়েছে অনেককে।

বিপন্ন নদীবাঁধ। ঝড়খালিতে বিদ্যাধরী নদীর তীরে।

বিপন্ন নদীবাঁধ। ঝড়খালিতে বিদ্যাধরী নদীর তীরে। নিজস্ব চিত্র।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪৮
Share: Save:

মণি নদীর ভাঙা বাঁধ চুঁইয়ে বিঘে কতক জমি পেরিয়ে নিয়ম করে কোটালের জল আসে মানুষের গেরস্থালি দেখতে। আদেখ্লা কিছু জল রয়ে যায় আলে ঘেরা নিচু জমিতে। রায়দিঘিতে বাম আমলের সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের কুমড়ো পাড়ার বাড়ির পাশে সেই জলে ঝাঁক ঝাঁক লেসার হুইসলিং ডাক, সরাল। স্থানীয়রা বলেন বুনো হাঁস। কাছে ঘেঁষতে গেলে উড়ে যায় দল বেঁধে। আড্ডা জমায় আরও দূরে, অন্য কোনও জমা-জলে।

Advertisement

রায়দিঘির ভোটার কি এ বারও এই সরালের মতোই? গত দু’বার অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের কাছে কান্তির পরাজয় কষ্ট দিয়েছে অনেককে। কারণ, মন্ত্রী হন বা না-হন, বাদাবনের গরিব-গুর্বোরাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বলেন, “হেরেও সুখে-দুঃখে সুন্দরবনের মানুষের পাশে ছিলাম। এই আমপানেও দুর্গতদের আশ্রয় দিয়েছি, দিনের পর দিন খাবার পৌঁছে দিয়েছি। ভোটের জন্যে নয়, এ ভাবেই জীবনটাকে উপভোগ করি আমি। যিনি জিতেছিলেন, তাঁকে তো আর মানুষ দেখেননি! তাঁর দলের লোকেরা শুধু লুটপাট করেছে।” এ বার? বাহ্যিক প্রচারে দুই ফুলকে সমানে পাল্লা দেওয়া সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন, বললেন— “এক-দেড় মাস ধরে পাড়ায় পাড়ায় মদ-মুরগির মোচ্ছব চলছে। তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই দেদার টাকা বিলোচ্ছে। নালিশ করেছি, কমিশনের হেলদোল নেই। ভোটে জিতবে বলে গরিব মানুষগুলোর নীতি-নৈতিকতা ধ্বংস করে দেবে ওরা? এই টাকার জোরের সঙ্গে কঠিন লড়াই লড়তে হচ্ছে এ বার।” তৃণমূল প্রার্থী না-করায় পদ্মের প্রার্থী হয়েছেন এক সময়ে কংগ্রেসের পরিচিত মুখ সত্য বাপুলির ছেলে শান্তনু। বিজেপির প্রার্থী, অথচ তৃণমূলের জেলা পরিষদে বন দফতরের কর্মাধ্যক্ষ তিনি। কান্তি বলেন “মানুষ জানেন, ফুল বদলালেই ভোল বদলায় না! এ কি পিকের স্ট্র্যাটেজি?” শান্তনু বলছেন, “মানুষ তৃণমূলকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। পদ্মই ভরসা তাঁদের। অন্য কোথাও দিয়ে তাঁরা ভোট নষ্ট করবেন না।” আবার এই লড়াইয়ে সমানে টক্কর দিচ্ছেন জোড়াফুলের অলক জলদাতাও।

গত বার হারলেও ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন কান্তি। বলেন, “দলের ক’টা প্রার্থী এত ভোট পেয়েছিল? পাশের কুলতলিতে ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েই জিতে গিয়েছিল রামশঙ্কর।” এ বারেও সেখানে সিপিএম প্রার্থী রামশঙ্কর হালদার। চারমুখী লড়াইয়ে তৃণমূলের যে গোপাল মাঝি গত বার ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন, দলে ‘দম বন্ধ হয়ে আসায়’ তিনি পদ্মে। আবার ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হওয়া এসইউসি-র লোক-লস্করের একটা অংশ ‘তৃণমূলকে শিক্ষা দিতে’ পদ্মবনে ভিড়েছেন। তৃণমূলের গণেশ মণ্ডলও এলাকার প্রভাবশালী। সুতরাং জল বেশ ঘোলা।

শিবনাথ শাস্ত্রী, বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছোটবেলা কেটেছে জয়নগর-বহড়ু-মজিলপুরে। নলেনগুড়ে পাকানো কনকচূড় ধানের খইয়ের ঘরোয়া মোয়াকে শতাব্দ আগে ‘জয়নগরের মোয়া’-য় উন্নীত করেছিলেন বুঁচকি বাবু। ভাল নাম নিত্যগোপাল সরকার। আর এক সরকার দেবপ্রসাদ। সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাটন বয়ে নিয়ে ১৯৭৭ থেকে ২০১১— টানা ৩৪ বছর ছিলেন এখানকার এসইউসি বিধায়ক। মোয়া আর এসইউসি মিলে জয়নগর। ২০১৬-য় সেই জয়নগর সংরক্ষিত আসনে নিজের দলের বিশ্বনাথ দাসকে জিতিয়ে আনেন তৃণমূল নেতা গৌর সরকার। ভোটের মুখে বিজেপিতে যোগ দিলেন তিনি। তার ক’দিন আগেই ‘সাম্প্রদায়িক দলে যাব না’ ঘোষণা করে এ বারের নির্বাচন সম্পর্কে গৌর বলেছিলেন— “জয়নগরে ২৫-৩০ হাজার ভোটে তৃণমূল হারবে। আমি তার দায় নেব না!”

Advertisement

বিজেপির প্রার্থী রবিন সর্দারকে না-মানতে পেরে বসে গিয়েছেন পদ্মের নেতা-কর্মীদের একাংশ। ‘সবার হাতে কাজ’-এর মতো জনপ্রিয় দাবি নিয়ে এলাকা চষছেন সিপিএমের তরুণ প্রার্থী অপূর্ব প্রামাণিক। টর্চ প্রতীকে এসইউসি-র তরুণ নস্করও লড়াইয়ে। আর দলের ভেতরে-বাইরে অভিযোগের পাহাড় গত বারের বিধায়ক বিশ্বনাথ দাস ও ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস আগে ‘দুষ্কৃতীরা’ তাঁর গাড়ি লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল, যা নিয়ে নানা কথা কানাকানি চলে। গায়ে না-মেখে এলাকার নানা অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ‘কাছের মানুষ’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন জোড়াফুল প্রার্থী বিশ্বনাথ।

পদ্মের ভার বাড়াতে ভোটের মুখে বৃহস্পতিবার জয়নগরে জনসভা করেছেন নরেন্দ্র মোদী। বিজেপির দাবি, এই সভা হিসেব বদলে দেবে জয়নগর-কুলতলির। রাম-হাওয়া উঠতে পারে পাশের মন্দিরবাজার, কুলপি, রায়দিঘি, বাসন্তী কেন্দ্রেও।

বাসন্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে কাপে চা ঢালছিলেন বৃদ্ধ দোকানি। ভোটের খবর কী, প্রশ্নের সটান জবাব, “মানুষ মিছে কথা বলছে।” মানে? ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বহুদর্শী, “মন-মন কিছু ঠিক করে ফেলেছে। মুখে সেটা কইছে না। মুখে যা বলছে, সেটা কিন্তু সত্যি না!”

শাসক দলের উন্নয়ন থমকে গিয়েছে বারুইপুরে। সেখান থেকে দক্ষিণ বারাসত, গোচারণ, জয়নগর হয়ে কুলপি পর্যন্ত যোগাযোগের একমাত্র সড়কটি যেমন সরু তেমনই জরাজীর্ণ। হোগল নদীর পাশেই খটখটে নলকূপ। মাটি দ্রুত নোনা হয়ে মার খাচ্ছে চাষাবাদ। আবার মাতলার বুকে আখাম্বা দাঁড়িয়ে ২১টা পিলার জানান দিচ্ছে, ক্যানিং থেকে বাসন্তী রেললাইন টানার একটা প্রকল্প কোনও বাজেটে ঘোষণা হয়েছিল। মোদী সরকারের চলতি বাজেটে সেই প্রকল্পে বরাদ্দ জুটেছে ১ টাকা। জয়নগর-রায়দিঘি রেল প্রকল্পের মৌখিক ঘোষণাই সার, রেলের খাতায় তার নামটুকুও ওঠেনি। ৭৭৩ কিলোমিটার নদীবাঁধ কংক্রিটের করার জন্য ইউপিএ সরকারের বরাদ্দ পাঁচ হাজার ৩২ কোটি টাকার ৮০ শতাংশই ফেরত গিয়েছে। আয়লা, বুলবুল, আমপানের মারে বাকি নদীবাঁধ কঙ্কালসার। বিজেপির সংকল্প পত্রে এ সব সমস্যা গুরুত্ব পায়নি।

তবে, আমপান শুধু ঘরবাড়ি ভাঙেনি, ক্ষতিপূরণ আর ত্রাণ বণ্টনে দলবাজি নিয়ে নালিশের বহর বিস্তীর্ণ এলাকায় ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে শাসক দলের, যা মেরামতে মরিয়া তারা। তৃণমূলের জেলা সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তী বলছেন, “লোকসভা ভোটে সব আসনেই আমরা কমবেশি এগিয়ে ছিলাম। কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্যসাথী মানুষের দুয়ারে পৌঁছেছে। কাজের এই ধারা অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছি। কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে মানছি। সাড়া মিলছে ভালই।”

তবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার পাঁকে পদ্ম ফুটেই চলেছে টুপটাপ। বাসন্তীর ঝড়খালির এক আরএসপি কর্মীর কথায়— “করোনার মতো ছড়াচ্ছে বিজেপি!” তাঁর এক সঙ্গী তখন ফোনে কাউকে বলছেন, “এত বলার পরেও তুই ওদের সঙ্গে বেরোচ্ছিস? ওরা এলে গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমান এক সনে থাকতে পারব? টাকা দিলেই বিকিয়ে যাবি, লজ্জাশরম নাই রে?”

বাদাবনের ছয় কেন্দ্রে চার পক্ষেরই দাবি, জয় দেখতে পাচ্ছেন। তবে ভোটারের মন যেন বুনো হাঁস। কাছে গেলেই ফুড়ুৎ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.