Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ফেলে আসা প্রতীকের ‘ছায়া’ই নতুন ছায়ার বিড়ম্বনা

বাঁ হাতে ঝুলছে রঙের ডাব্বা। ডান হাতে তুলি। দেওয়াল লেখার কাজ শেষ। ‘আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে চন্দ্রকোনা বিধানসভার প্রার্থী ছায়া দোলুইকে ভোট দিন।’ পাশে ঘাসের উপর জোড়া ফুল প্রতীক।

সুমন ঘোষ
চন্দ্রকোনা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ২২:৫৬
Share: Save:

বাঁ হাতে ঝুলছে রঙের ডাব্বা। ডান হাতে তুলি। দেওয়াল লেখার কাজ শেষ।

‘আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে চন্দ্রকোনা বিধানসভার প্রার্থী ছায়া দোলুইকে ভোট দিন।’ পাশে ঘাসের উপর জোড়া ফুল প্রতীক।

পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক যুবক। দেওয়ালে আটকে গেল তাঁর চোখ। হেসে লুটোপাটি। তা দেখে, পথচলতি আরও দু’একজন দাঁড়িয়ে গেলেন। হাসির কারণ জানতে চাইলে কিছু না বলে দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। দেওয়ালে কী এমন ছিল? একটু খেয়াল করতেই বোঝা গেল কারণটা। দেওয়ালের এক পাশে পুরনো লেখা জ্বলজ্বল করছে এখনও। ‘বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী ছায়া দোলুইকে ভোট দিন’। পাশে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে!

উত্‌সাহে দেওয়াল লিখতে থাকা কর্মীরাও দেখে তো হতবাক! বেশ কিছু ক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কেউ বললেন, এখুনি ওটা মুছে ফেলা উচিত। কেউ বললেন, অন্যের দেওয়াল মুছলে যদি কমিশনে অভিযোগ জানায়? আলোচনার মাঝে ব্লক নেতাকে ফোনে ধরলেন এক জন। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু নির্দেশ এল। দেখা গেল, তাড়াতাড়ি সাদা রং দিয়ে ঢেকে ফেলা হচ্ছে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে। একই ভাবে ঢেকে ফেলা হল ‘বামফ্রন্ট মনোনীত’ শব্দগুচ্ছও। পুরনো ছায়া দোলুইয়ের পাশে নতুন করে আঁকা হল ঘাসের উপর জোড়া ফুল!


তৈরি হচ্ছে বাবরসা

এর পর কমে গেল খাটুনি। দেওয়ালে পুরনো ছায়া দোলুই। মাঝে বামফ্রন্ট মনোনীত ও তারা-হাতুড়ি-কাস্তেতে সাদা ছোপ। শুধু প্রতীকটা পাল্টে গেল। ঘাসের উপর জোড়া ফুল!

আর এই ফেলে আসা কাস্তে-হাতুড়ি-তারার ‘ছায়া’টাই হচ্ছে নতুন ছায়ার বিড়ম্বনা।

আগের বার চন্দ্রকোনা বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিআইএমের প্রার্থী ছিলেন ছায়া দোলুই। জয়ীও হয়েছিলেন। সিপিএমের এই বিধায়ক পরে তৃণমূলে যোগ দেন। এ বার তিনি তৃণমূলের প্রার্থীও। এক তৃণমূল কর্মী তো বলেই ফেললেন, “কী করে ভোট চাইতে যাব। যেখানে ভোট চাইতে যাচ্ছি, দলের সমর্থকেরাই প্রশ্ন করছেন, গত বার ওই ছায়া দোলুইকে ভোট না দেওয়ার জন্য সিপিএম কম অত্যাচার করেছে! এ বার সেই ছায়া দোলুইকেই ভোট দিয়ে জেতাতে হবে! বলুন তো, এ প্রশ্নের কী উত্তর রয়েছে।” তবু তো দলের প্রার্থী জেতাতে হবে। তাই উপরতলার নেতারা চাপ দিচ্ছেন। এমনকী নিজেরা গিয়ে মিটিং, মিছিল করছেন, সেই সময়েই কেবল নিচু তলার কর্মীরা হাজির। কিন্তু, অন্য সময়? জাড়ায় গিয়ে জানা গেল, দেওয়াল লিখছেন তৃণমূল কর্মীরা। সংখ্যায় মাত্র ৪ জন। উত্‌সাহ নেই। কিন্তু, রাস্তায় দেওয়াল লিখন চোখে না পড়লে বকা খেতে হবে। তাই খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোথায় পুরনো দেওয়াল লিখন রয়েছে। তাতে ঝামেলা কম। শুধু সিপিএমের প্রতীকটাতে সাদা রং দিয়ে তার উপর ঘাসের উপর জোড়া ফুল আঁকলেই হল। নতুন করে সর্বত্র দেওয়াল লিখছেন না কেন? এক কর্মী জানিয়ে দিলেন, ‘‘বুথ পিছু হাজার টাকা করে দিয়েছে। তাতে কী হয়।”

শুধু জাড়া কেন? শ্রীনগর, রামজীবনপুর, কৃষ্ণপুর, চন্দ্রকোনা— সর্বত্রই এক সুর। শ্রীনগরের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা গেল, সাত সকালেই দলীয় কর্মীদের আড্ডা। আড্ডায় নির্বাচনের কথা নেই। কোথায় পাড়া বৈঠক বাকি, কোন ভোটারদের এখনও মন জয় করা যায়নি, এ সব কথা নয়। আলুর দাম কত চলছে, ছেলেটা মামা বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরেছে, এই সব খোসগপ্পো। চা-পানের শেষে এক জন বললেন, ‘‘না! উঠতে হবে। একটু পঞ্চায়েত অফিসে যাব।’’ প্রচারে না গিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে কেন? ‘‘একটু কাজ আছে।’’ বোঝা গেল, বুথ পিছু আশানারূপ ভোটের খরচ মেলেনি, তার উপর সিপিএম বিধায়ককে তৃণমূলে এনে জেতানোর জন্য লড়াই কী ভাল লাগে! তাই বসে গিয়েছেন। আর সেই সুযোগে নিজেদের মাটি শক্ত করতে নেমে পড়েছে সিপিএম। লক্ষ্মীপুরের পথে যেতে গিয়ে রাস্তায় দেখা হল ষাটোর্ধ মোবারক আলির সঙ্গে। ভোট নিয়ে কথা বলতেই জানালেন, “এ বার কী জোট সরকার হচ্ছে?” সম্পূর্ণ এক অরাজনৈতিক খেটে খাওয়া মানুষের মুখে এমন কথা শুনে একটু বিস্মিত হলাম। বোঝা গেল যে দলই জিতুক না কেন সিপিএম ধীরে ধীরে নিজেদের জমি ফেরানোর চেষ্টার মরিয়া। আর তারই প্রতিফলন মোবারক আলির কথায়।

এ বার আসা গেল ক্ষীরপাইয়ে। ক্ষীরপাইয়ের ‘বাবরসা’-র কথা কার না জানা। এই মিষ্টি অতি সুস্বাদু। এর শিল্পকলাও নজরকাড়া। কথা বলে জানা গেল বাবরসা নিয়ে লোককথাও। কোনও এক সময়ে মুঘল সম্রাট বাবর শাহ নাকি এই পথে গিয়েছিলেন। এই মিষ্টি খেয়ে প্রশংসাও করেন। সেই স্মৃতিতে অপভ্রংশে মিষ্টির নাম হয়েছে ‘বাবরসা’। কত পুরনো লোককথা এখনও মানুষের মনে টাটকা। স্মৃতি কখনও মধুর হয়, আবার কখনও বেদনার। বাবরসা-র স্মৃতি মধুর তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু, ছায়া দোলুইয়ের কাস্তে ধরা হাতের স্মৃতি যে বেদনার হয়ে উঠেছে, তা বোঝা গেল চন্দ্রকোনার আনাচে-কানাচে।

ছবি: কৌশিক সাঁতরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE