Advertisement
১১ মে ২০২৪

আত্রেয়ীর মতোই শুকিয়ে যাচ্ছেন জীবনবাবুরা

চোখের সামনে আত্রেয়ীকে শুকিয়ে যেতে দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন বালুরঘাটের খিদিরপুর হালদারপাড়া এলাকার প্রবীণ মত্স্যজীবী জীবন হালদার।

শুকিয়ে যাওয়া আত্রেয়ী নদী।

শুকিয়ে যাওয়া আত্রেয়ী নদী।

অনুপরতন মোহান্ত
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:২২
Share: Save:

চোখের সামনে আত্রেয়ীকে শুকিয়ে যেতে দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন বালুরঘাটের খিদিরপুর হালদারপাড়া এলাকার প্রবীণ মত্স্যজীবী জীবন হালদার। সকাল থেকে পাড়ায় ভোট প্রচারে ডান-বাম দল পালা করে পাড়া বৈঠক, প্রচার বক্তৃতা-জটলার ভিড় এড়িয়ে তিনি চলে এলেন শ্মশানঘাটে নদীর ধারে। বুড়ো বটের তলায় দীর্ঘক্ষণ বসে থেকেও নদীতে একটি মাছকেও ঘাঁই মারতে না দেখে শূন্য দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকালেন। নদীবাঁধ রাস্তা ধরে জীবনবাবুর কাছে আসতেই হালদারপাড়া থেকে বাতাসে ভেসে আসা ভোট ভাষণের প্রতিশ্রুতি থেকে-থেকে যেন স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে। মাথার উপর চৈত্রের সূর্য বটের ডালপালার ফাঁক গলে গায়ে পড়তেই বৃদ্ধ জীবনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, ধুস কিস্যু হবে না। বাঁধ দিয়ে আত্রেয়ীকে বেঁধে ফেলেছে। মরতে বসেছে নদী।

কিছুক্ষণের মধ্যে বুড়ো বট তলায় এসে হাজির হলেন শহর ফেরত খিদিরপুর এলাকার ভীম হালদার, গণেশ নট্টদের মতো ছোট বৃত্তি ব্যবসায়ে যুক্ত বাসিন্দারা। সে সময় পাশের পিচ রাস্তা ধরে ‘ভোট দিন’ স্লোগান দিয়ে একটি মিছিল চলে গেল। ভোট তাহলে ভালই জমে উঠেছে? প্রশ্ন শুনে ভীম, গণেশরা নির্লিপ্ত সুরে বলেন, “বালুরঘাটে তো শুনলাম তৃণমূলের শঙ্কর চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে আরএসপির সেই প্রবীণ নেতা বিশ্বনাথ চৌধুরী দাঁড়িয়েছেন। তিনি তো বহু বছর ধরে মন্ত্রীও ছিলেন।” এ বার মুখ খুললেন প্রবীণ জীবনবাবু। নদীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ভোট আসে ভোট যায়। আমাদের অবস্থা ওই বুড়ো আত্রেয়ীর মতো। প্রবীণ জীবনবাবুর কথায় হঠাতই মনে হল সত্তরোর্ধ শাসক ও বিরোধী—বালুরঘাটের দুই প্রার্থী শঙ্কর ও বিশ্বনাথবাবুর লড়াইয়ের সঙ্গে কী কোথাও আত্রেয়ীর মিল আছে? যেমন করে জলরাশি হারিয়ে শীর্ণধারা নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরের জীবনরেখা আত্রেয়ী লড়ে যাচ্ছে। নদীর মতোই কী এবারের ভোটের লড়াই বিশ্বনাথের, নাকি শঙ্করের ?

উত্তর খুঁজতে বটতলা ছেড়ে সোজা মত্স্যজীবীদের ডেরায় গিয়ে জানা গেল, এক সময়ের ভরা আত্রেয়ীর বিস্তর মাছের যোগানে পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা পুরো এলাকার মত্স্যজীবীদের চলত জীবন সংসার। শহুরে সভ্যতার দীর্ঘ অবহেলা ও অবিচারে আজ শীর্ণরূপ আত্রেয়ীর। চোখের সামনে পেটের টানে ধীবরের পেশা বদলে কলোনির বাসিন্দারা কেউ তেলকলের শ্রমিক, কেউ বা অন্য পেশা আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ভিন‌্ রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে এলাকা ছেড়েছেন। বিগত কয়েক দশকের মতো গত পাঁচ বছরে এলাকায় কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা হয়নি। দিন যত কেটেছে বালুরঘাটে পাড়ায় মহল্লায় মুদি থেকে মণিহারী দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। ক্রেতা ও ক্রয় ক্ষমতা পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। চাকরি নেই। কলকারখানা হয়নি। বাসিন্দাদের আক্ষেপ, তাতে একই রোজগারের উপর থাবা পড়ে দোকানিদের আয় ক্রমশ কমেছে। যেমন আত্রেয়ী নদী পথে বিভিন্ন জায়গায় আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে সকলে লাগাতার সেচের জল টেনে নেওয়ায় এখন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শুধু বালির চর নিয়ে নদীর অববাহিকা অঞ্চলের কৃষক থেকে মতস্যজীবীদের সংকটপূর্ণ অবস্থা হয়েছে।

বালুরঘাট শহর জুড়ে রাস্তার দুধারে লোহার রেলিং বসানোর কাজে যেন বিরাম নেই। রাত পর্যন্ত ড্রিলিং মেশিনের শব্দ ভোট প্রচারের স্লোগানকে ঢেকে দিয়েছে। শহরের হিলিমোড়ে ত্রিফলা বাতি এবং রাস্তা চওড়া ও সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে। ভোটের মুখে ওই সমস্ত কাজ চালিয়ে যাওয়ার পিছনে শহরবাসী ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা বলে ইতিমধ্যে শাসক দলের বিরুদ্ধে আরএসপি প্রশাসানের কাছে আপত্তি জানিয়েছে। তাতে লাভ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ওই সমস্ত উন্নয়ন কাজের সূচনা নির্বাচন ঘোষণার আগেই হয়েছিল। তাই বালুরঘাট বিধানসভা আসনের বড় অংশ হিলি ব্লক এলাকায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে বিশ্বনাথবাবুকে। হিলির ধলপাড়া ও বিনশিরা এলাকায় পাড়া বৈঠকের প্রচারে দেখা গেল সেই পুরনো মেজাজে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির বিশ্বনাথ গাছতলায় বসে গ্রামের মানুষের কাছে তুলে ধরছেন কৃষি ও জীবন-জীবীকার কথা। ফসলের ন্যায্যমূল্য, সারের মূল্যবৃদ্ধি, সেচ ব্যবস্থার সুফল কতটা মিলেছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা জমায়েত থেকে ঘাড় নাড়তে দেখা গেল। আবার তিওড়ের পাড়া বৈঠকে মধ্যবিত্ত, চাকুরেজীবীদের একাংশের কাছে খাদ্যসুরক্ষা প্রকল্প, বাড়ি থেকে দূরে রেশন দোকানের ঠিকানা বদল, ডিএ থেকে আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ তুলে প্রচারে ঝাঁঝ তুলছেন তিনি।

পাল্লা দিচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী শঙ্করবাবুও। দিনে বিশ্বনাথবাবু যেখানে শেষ করছেন। বিকেল থেকে রাত অবধি সেখানে গিয়ে প্রচারে পাল্টা শান দিচ্ছেন শঙ্করবাবু। গত সাড়ে চার বছরে তিনি এলাকার কী উন্নয়ন করেছেন রীতিমত ছবি সমেত এক তথ্যভিত্তিক পুস্তিকা ছাপিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের বিলি করছেন। বিদ্যুত, রাস্তাঘাট সেতু তৈরি থেকে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পরিষেবামূলক কাজের ফিরিস্তি শঙ্করবাবু ভোট প্রচারে মূল হাতিয়ার। হিলিতে যমুনা নদী বাংলাদেশ থেকে এসে হিলি ব্লকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফের বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। ওই নদীর জলে গরু ভাসিয়ে বাংলাদেশে পাচারের এক ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে হয়েছে কিছু বেকারদের।

আত্রেয়ী পূর্বদিকে বাংলাদেশ থেকে এ জেলার কুমারগঞ্জ ব্লকের সমজিয়া অঞ্চল হয়ে গোপালগঞ্জ দিয়ে পতিরাম অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে বালুরঘাট ব্লক ও শহরের বুক চিরে বিস্তীর্ণ এলাকা পেরিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে ফের বাংলাদেশে পৌঁছেছে। দুই এলাকার ওই দুই নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদ শাসক-বিরোধী দলের ভোট প্রচারের গতির সঙ্গে বালুরঘাটের খিদিরপুরের বুড়ো বটতলার আড্ডার মতোই ওই অঞ্চলের বেশকিছু এলাকায় মানুষ ভোটের প্রসঙ্গ উঠতেই চুপ করে গিয়েছেন। ত্রিমোহিনী এলাকার একাংশ বাসিন্দার কথায়, পাঁচ বছর আগের এক-আমলের শেষ হয়ে আরেক নতুন-আমলের শুরুর পর আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সমাজের কোনও পরিবর্তন হল না। এই কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছেন বলে বাসিন্দাদের অভিমত।

গ্রামের আলরাস্তার ধারে জিগা গাছে পাশাপাশি লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখে বাসে উঠে ফের নদীবাঁধের রাস্তা ধরে বালুরঘাটে পৌঁছে মনে হল খিদিরপুর আর ত্রিমোহিনীর মধ্যে কোথায় যেন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আত্রেয়ী নদীর মতোই বঞ্চনা ও দুঃখে ভরা মানুষের মুখগুলি সহসা ভেসে উঠল। পায়ে পায়ে পড়ন্ত বিকেলে শহরের কল্যাণীঘাটে পৌঁছে মনে হল শঙ্কর কিংবা বিশ্বনাথবাবু যেই জিতুন। বুড়ি আত্রেয়ীর শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে বিলীন হওয়ার পথে একটি জনপদের মানুষের অস্তিত্বের বিপন্নতার মতোই একজন হারিয়ে যাবেন। অপর জন জিতেও কি দূর করতে পারবেন ওই সীমান্ত এলাকার মধ্যবিত্তকে জীবন-জীবিকার সমস্যা থেকে। খিদিরপুরের অশীতিপর মত্স্যজীবী জীবনবাবুদের মুখে কি হাসি ফুটবে? আত্রেয়ীর শীর্ণধারায় সেই সব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে .......।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE