Advertisement
০৯ মে ২০২৪

অব্যাহত হিংসা, আহত বালকও

ফল প্রকাশের পরে ৪৮ ঘণ্টা পার। রাজনৈতিক হিংসা কমার তো লক্ষণ নেই, উল্টে তা দুই জেলার নানা প্রান্তে ছড়াচ্ছে। এ বার তার জেরে আহত হল সাত বছরের বালকও! শনিবার দুপুরে আরামবাগের বাতানল দক্ষিণপাড়ায় ছয় সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর ও লুঠপাট চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

আরামবাগে সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে হামলার পরে।

আরামবাগে সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে হামলার পরে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০২:৪২
Share: Save:

ফল প্রকাশের পরে ৪৮ ঘণ্টা পার। রাজনৈতিক হিংসা কমার তো লক্ষণ নেই, উল্টে তা দুই জেলার নানা প্রান্তে ছড়াচ্ছে। এ বার তার জেরে আহত হল সাত বছরের বালকও!

শনিবার দুপুরে আরামবাগের বাতানল দক্ষিণপাড়ায় ছয় সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর ও লুঠপাট চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। শেখ হারা নামে এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে হামলার সময়ে হামলাকারীদের ধাক্কায় একটি বাঁশের হুড়কো ছিটকে আলমগির বাদশা নামে ওই পরিবারের সাত বছরের এক বালকের বুকে লাগে। তাকে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শিশুটির মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘‘তৃণমূলের ছেলেরা ভাঙচুর করতে এলে ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকে বসেছিলাম। ওদের ধাক্কায় হুড়কো খুলে যায়। সেটি ছেলের বুকে লেগে যায়। তার পরে ঘরে ঢুকে ওরা হুড়কোটা দিয়ে আমাদের চেপে ধরেছিল।” আলমগির বলে, ‘‘ওরা আব্বাকে মারবে বলে খুঁজছিল। আমারই লেগে গেল।’’

বাতানলের এই অশান্তি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিপুল জনাদেশ পেয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরলেও সব ক্ষেত্রেই হামলায় অভিযুক্ত তারাই। এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা ফেরানোর দাবিতে এ দিন দুপুরে আরামবাগ মহকুমা সিপিএমের পক্ষ থেকে এসডিপিও অপরাজিতা রাইয়ের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ ঘটনার খবর পেয়ে হস্তক্ষেপ করছে। কিন্তু ততক্ষণে তো যা ঘটার ঘটে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে কেন, যেখানে হামলা থেকে বাঁচতে পুলিশকে ফোন করতে হবে? ওরা জিতেছে, উন্নয়ন করুক। উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ি ভাঙার কী সম্পর্ক!’’

জেলা তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্ত অবশ্য বলেন, “এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে দলনেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। বিরোধীরা সকলেই নিরাপদে বাড়িতে থাকবেন। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলার অভিযোগ এলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দল।”

দলীয় কর্মী-সমর্থকদের প্রতি কিছুটা হুঁশিয়ারির সুরে তপনবাবু এ কথা বললেও হামলার অভিযোগ ওঠা বন্ধ হচ্ছে না। শুক্রবার রাতে প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ শক্তিমোহন মালিকের চণ্ডীবাটি গ্রামের বাড়িতে হামলা হয়। শক্তিমোহনবাবু বাড়িতেই ছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “রাত সাড়ে ৭টা নাগাদ তৃণমূলের জনা তিরিশ ছেলে দরজা ভেঙে ঢোকে। পরিবারের সবাই দোতলায় উঠে দরজা বন্ধ রেখে প্রাণ বাঁচায়। ওরা একতলার সব ঘরের জিনিসপত্র ভাঙে। লুঠপাট চালায়।”


আহত বালক।

বাতানল দক্ষিণপাড়ায় একটি ক্লাবে ভাঙচুর চালানো হয়। সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভোট দেওয়ার ‘অপরাধে’ বাছানরী গ্রামের প্রবীণ সিপিএম সমর্থক অমর দে’কে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এমন নানা হামলার খবর মিলেছে গোটা মহকুমা থেকেই। শুক্রবার রাতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তারকেশ্বরের মালপাহাড়পুর গ্রামে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। বেশ কয়েক জন জখম হন। সুষমা মাঝি নামে এক মহিলা-সহ দু’জনকে শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মারের চোটে সুষমাদেবীর মাথা ফাটে। হাত ভাঙে।

তারকেশ্বরের তালপুরেও শাসক দলের হামলার মুখে পড়তে হয় সাধারণ সিপিএম সমর্থকদের। বলাগড় বিধানসভার জিরাট এবং চরকৃষ্ণবাটিতে সিপিএমের দু’টি দলীয় কার্যালয় দখলের অভিযোগ উঠেছে। ব্যান্ডেলের মানসপুরে সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য অমিত ঘোষের বাড়িতে হামলা হয়। জাঙ্গিপাড়ার রশিদপুরে সিপিএমের এক পোলিং এজেন্ট-সহ দলের কয়েক জন সমর্থক বাড়িছাড়া হয়েছেন বলেও অভিযোগ তুলেছে।

এ তো গেল বিরোধীদের উপরে হামলার অভিযোগ। পান্ডুয়া আবার তেতে রয়েছে তৃণমূলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে ঘিরে। শনিবার সকালে দলের পরাজিত প্রার্থী রহিম নবি (যিনি নাকসি মহল্লায় নিজের বুথেও ২৮৩ ভোটে হেরেছেন) দলবল নিয়ে পান্ডুয়া স্টেশন চত্বরের দলীয় কার্যালয় এবং এলাকার অটো ও টোটো সংগঠনের দখল নেন বলে অভিযোগ। ওই কার্যালয়ে এত দিন বসতেন প্রবীণ তৃণমূল নেতা অসিত চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘অগণতান্ত্রিক ভাবে নবি দলবল নিয়ে গোলমাল করছেন।’’ নবির পাল্টা অভিযোগ, ‘‘ওই কার্যালয় থেকে তোলাবাজি হতো। তা বন্ধ করতেই আমরা সেখানে বসছি। এখানকার কিছু নেতার জন্যই ভোটে হারতে হয়েছে।’’ চন্দননগরের বিলকুলি উত্তরপাড়ায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে তৃণমূলের একটি কার্যালয়ে হামলা হয়।


তারকেশ্বরে লন্ডভন্ড সিপিএম কর্মীর বাড়ি।

কী করছে পুলিশ প্রশাসন?

জেলাশাসক মুক্তা আর্য জানিয়েছেন, যেখানে গোলমালের খবর মিলছে, সেখানে দ্রুত পুলিশ গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। একই বক্তব্য পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠীরও। তিনি বলেন, ‘‘সব দিক খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’

হিংসা অব্যাহত হাওড়াতেও। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোলমাল হচ্ছে আমতা এবং উদয়নারায়ণপুরে। ফল প্রকাশের পর থেকেই আমতায় কংগ্রেস ও সিপিএম সমর্থকদের উপর হামলা হচ্ছে। ঝামটিয়ার ধাড়াপাড়ায় জনা চারেক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর করা হয় এবং ভয়ে তাঁরা বাড়িছাড়া হয়ে গেলে পরে লুঠপাট চালানো হয় বলেও অভিযোগ। গাজিপুরে সিপিএমের একটি পার্টি অফিসে তালা মেরে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আমতার জয়ী জোটপ্রার্থী অসিত মিত্র বলেন, ‘‘এই হিংসা বন্ধে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।’’ তৃণমূলের উলুবেড়িয়ার যুব সভাপতি সুকান্ত পালের দাবি, ‘‘ব্যক্তিগত ঝামেলাতে বিরোধীরা রাজনৈতিক রং চড়াচ্ছে।’’ উদয়নারায়ণপুর, সিংটি, পাঁচারুল, রামপুরে পার্টি অফিসে এবং মানশ্রী, গজা, ডিহিভূরসুট-সহ বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের কয়েকটি বাড়ি ও দোকানঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। এ দিকে শুক্রবার রাতে জয়পুরে তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের উপরে চড়াও হয়ে মারধরের অভিযোগ উঠেছে সিপিএম ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। পুলিশের দাবি, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ছবি তুলেছেন: মোহন দাস, দীঙ্কঙ্কর দে, সুব্রত জানা, প্রকাশ পাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vandalize
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE