Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিংহাসনের ক্ষয়রোগ

এগারো সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল দল ক্ষমতায় এল তখন একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় পাতায় আমি নিজের কলামে লিখেছিলাম, এই নির্বাচন ছিল মমতা বনাম বামফ্রন্টের।

সমরেশ মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ১৮:৫১
Share: Save:

এগারো সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল দল ক্ষমতায় এল তখন একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় পাতায় আমি নিজের কলামে লিখেছিলাম, এই নির্বাচন ছিল মমতা বনাম বামফ্রন্টের। যে কোনও আসনে মমতার ছবি মুখোশ বানিয়ে প্রার্থী যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তা হলে তাঁর হারার কথা ছিল না। লিখেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গে এবং তার আগে অবিভক্ত বাংলায় যত রাজনৈতিক নেতা এসেছেন তাঁদের সবাইকে জনপ্রিয়তার নিরিখে পিছনে ফেলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বা বিধানচন্দ্র রায় অথবা সুভাষচন্দ্র বসুর নাম মনে রেখেই লিখেছিলাম। সুভাষচন্দ্রকে বাঙালি স্বপ্নের নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছিল তিনি দেশত্যাগ করে আজাদ হিন্দ বাহিনী তৈরি করার পর। এই দেশে থেকে গেলে সুভাষচন্দ্র কখনওই নেতাজি হতেন না। হাওয়াই চটি, সাদা শাড়ির আটপৌরে মহিলাটিকে দেখার জন্য হাজার হাজার বাঙালি প্রতিটি সভায় ভিড় জমাতো। সেই লেখায় লিখেছিলাম, দলীয় নেত্রীকে কাজ করার সময় অনেককেই সহ্য করতে হয়, কিন্তু মু্খ্যমন্ত্রীর চারপাশে প্যারাসাইটদের রেখেছেন কেন? শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে দেখা যাবে বড় গাছ থেকে ঝুরি নেমে এসেছে। বড় গাছের রস খেয়ে সেই ঝুরি লম্বা হয়ে মাটি স্পর্শ করেছে। করার পর সেই মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে সে গাছ হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর চারপাশের ঝুরিগুলো তাঁকে ভাঙিয়ে বেঁচে থাকলেও তিনি তাঁদের গাছ হতে দিচ্ছেন না। নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ দিতে রাজি নন।

ওই লেখা ছাপা হওয়ার কয়েকদিন পরে এক দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ফোন করেন। লেখাটা তিনি পড়েছেন। সেই বিষয়ে কয়েকটা কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘‘আপনি লিখেছেন ওদের আমি গাছ হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না কেন? দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গাছ হলে তো আর দেখতে হবে না।’’

প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চারপাশের কাউকে গাছ হতে দেননি, বরং যিনি তাঁর প্রশ্রয় পেয়ে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছেন, তাঁকে বর্জন করতে একটুও দেরি করেননি। যাবতীয় হিসেব, ফর্মুলাকে প্রায় ভুল প্রমাণ করেছেন আমাদের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অতীত, সেখানকার জীবনযাপন পদ্ধতির ছাপ দ্রুত নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে একরোখা, কাউকে তোয়াক্কা না করার মানসিকতায় পৌঁছে গেছেন তিনি। এই ব্যাপারে তাঁর কোনও দ্বিধা বা সঙ্কোচ নেই। পাশের চেয়ারে বসা অধ্যাপক, যিনি ইংরেজি ভাষায় ডক্টরেট পেয়েছেন, বসে থাকলেও তিনি তাঁর নিজস্ব ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেন না। কবি যে সব বিখ্যাত লাইন লিখে গিয়েছিলেন তা নিজের মতো বদলে নিতে তিনি দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি গভর্নমেন্ট শব্দটিকে গবমেন্ট বলতেন, কিছুতেই শব্দটিকে সঠিক উচ্চারণ করতে পারতেন না। মু্খ্যমন্ত্রী হওয়ার সাড়ে চার বছর পরেও যখন নিজেকে অনেক পরিশীলিত করতে পেরেছেন তখনও তাঁর জিভ গবমেন্ট উচ্চারণ করে চলেছে। আমরা মেনে নিয়েছি কিন্তু যারা সদ্য ইংরেজি শিখেছে তাদের বোঝানো যাচ্ছে না মুখ্যমন্ত্রী ভুল উচ্চারণ করছেন। শিশুরা মনে করে মুখ্যমন্ত্রী ভুল করতে পারেন না।

গত কয়েক বছরে পশ্চিমবাংলার মানুষের চরিত্র অদ্ভুত ভাবে বদলে গিয়েছে। দিঘা থেকে শিলিগুড়ির মানুষ ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে আগের মত কথা বললেও রাজনীতি বিষয়ক কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। যেন তাঁদের কান কিছুই স্পর্শ করছে না। সারদা কেলেঙ্কারির যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাঁরা বিক্ষোভ দেখিয়ে বুঝে গেছেন তাতে কোনও লাভ হবে না, তাই মুখ বন্ধ করেছেন। নারদ কেলেঙ্কারির ছবি টিভি বা কাগজে দেখেও পশ্চিমবাংলার জনতা না দেখার ভান করে আছেন। যে লোকটাকে পর্দায় কয়েক লক্ষ টাকা লোভী মুখে নিতে দেখেছেন, তিনি দরজায় হাতজোড় করে দাঁড়ালে গলে জল হওয়া হাসি হাসছেন। ভোটের আগের দিন যদি কয়েক জন এসে বলে, মামা, আপনার ভোটটা আমরাই দিয়ে দেব, আপনি কষ্ট করে যাবেন না, তা হলে মনে মনে বলবেন, আমরাই রক্ষা পেলাম। চাষের বলদ অথবা মাল বওয়া গাড়ি টানা মোষের কাঁধে মোটা চড়া পড়ে যায়। ফলে সেই কাঁধে কোনও অনুভূতি থাকে না।

জ্ঞানবান হওয়ার পরে জেনেছি গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু কংগ্রেস। আর কং‌গ্রেস চিরকালই বলেছে কমিউনিস্টরা রাশিয়া বা চিনের দালাল, বিশ্বাসঘাতক। চৌত্রিশ বছর ভোট করার পর এ দেশীয় বামপন্থীরা পশ্চিমবাংলার কোনও শহরের একটা গলির সব মানুষকে কমিউনিজমের ছাতার নীচে আনতে সক্ষম হয়নি। আবার এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভাবে ভারতের স্বাধীনতা এনেছে বলে ক‌ংগ্রেস যে দাবি করে তাতে প্রচুর জল মেশানো আছে। গত চার বছরে যারা নিজেদের মুখ দ্যাখেনি তারা হঠাৎ বলতে লাগল নীচের তলার কর্মীরা জোট চাইছেন বলে আগামী নির্বাচন একসঙ্গে লড়তে হবে। এতকাল নীচের তলার কর্মীরা চেঁচিয়ে কিছু বললে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত, হঠাৎ তাদের ফিসফিস কথা যা আমরা শুনতে পেলাম না, তা দুই দলের নেতারা শুনতে পেলেন? কিন্তু জনতা তো থম ধরে আছে। যদি জোট জেতে তা হলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন? যদি সূর্যকান্ত মিশ্র হেরে যান তা হলে তাঁর বিকল্প কে? সেটা তো ঠিক করবেন জরাগ্রস্ত নেতারা। সেই সিদ্ধান্ত কি কংগ্রেস মেনে নেবে? এগারো সালে মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। বিকল্প হিসেবে নেত্রীকে পাওয়া গিয়েছিল। এখন মানুষ মনে মনে যদি পরিত্রাণ চান তা হলে তাঁদের সামনে কোনও বিকল্প নেতা বা নেত্রী নেই।

গতকাল একটি ফোন পেয়েছিলাম ল্যান্ডলাইনে। এক যুবক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আচ্ছা, হিটলার কি খুব খারাপ লোক ছিলেন?’’

বলেছিলাম, ‘‘বইপত্রে তাই জেনেছি।’’

‘‘ভুল জেনেছেন। নইলে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সাহায্য চাইতেন না। ইতিহাসটা একটু ভাল করে পড়ুন স্যার।’’ হেসেছিলেন যুবক, ‘‘মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ আর জার্মানির হিটলারের পরিণতি এক হলেও ওঁরা ইতিহাসে বেঁচে আছেন। থাকবেনও। ইতিহাস একই কথা বারংবার বলে। শুনতে চেষ্টা করুন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE