সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ও জেলাশাসক। নিজস্ব চিত্র।
নন্দীগ্রামের জেলায় এসে রবিবার পুলিশকে রীতিমতো শাসিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘সব হিসেব বুঝে নেওয়া’র হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও টাল খাচ্ছে না পুলিশের আত্মবিশ্বাস। উল্টে ৫ মে, শেষ দফাতেও উর্দির মান রেখে নির্বিঘ্ন ভোট করানোটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকেরা। জেলা পুলিশের এক কর্তা সোমবার সাফ বলেন, ‘‘আমরা এখন নির্বাচন কমিশনের হয়ে কাজ করছি। কমিশনের নির্দেশিকা মেনে ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তাঁর ব্যবস্থা করছি। এতে কারও ক্ষোভ হলে আমাদের কিছু করার নেই।’’
তবে যে মুখ্যমন্ত্রী হুমকি দিচ্ছেন? এ বার ওই পুলিশ কর্তার জবাব, ‘‘আমরা ম্যাডামের থেকে বেতন পাই না। সূর্যকান্ত মিশ্রের থেকেও নয়। আমরা ভারত সরকারের হয়ে কাজ করি। ভোটের দিনও সে ভাবেই কাজ করব।’’
সোমবারই তমলুকে জেলা প্রশাসনিক অফিসে সাংবাদিক বৈঠক করে জেলাশাসক অন্তরা আচার্য ও জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া জানিয়ে দিয়েছে, ভোট অবাধ ও নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেটা যে নেহাত কথার কথা হবে না, তার ইঙ্গিত রয়েছে অলোক রাজোয়িরার অতীতেই। রাজ্যে পালাবদলের পরে ২০১২ সালে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তিনি। ২৫ জন ডব্লুবিপিএস ক্যাডারের অফিসারকে তৃণমূল সরকার আইপিএস হিসেবে মনোনীত করায় ‘সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল’-এ (ক্যাট) রাজ্য সরকার এবং ওই অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তিনি। নবান্ন সূত্রে খবর, ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওটাই ছিল সরকারের বিরুদ্ধে কোন আমলার দায়ের করা প্রথম মামলা। এ হেন এসপি-র নেতৃত্বে ভোটের দিন পুলিশের মেরুদণ্ডের ছবিই বজায় থাকবে বলে জেলা প্রশাসনের একটা বড় অংশের আশা।
সোমবার দিনভর জেলার থানা, পুলিশ ফাঁড়িতে কানাঘুষো চলেছে। জেলার কনস্টেবল থেকে আইপিএস পদমর্যাদার পুলিশ আধিকারিক সকলেরই মত, মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে হুমকি দিয়ে ঠিক করেননি। পুলিশকে ‘ভিতু’ বলাতেও ক্ষোভ ছড়িয়েছে। জেলার এক পুলিশ কর্মীর বক্তব্য, ‘‘নিজের দায়িত্ব পালন করাতেই আমরা ভিতু হয়ে গেলাম! যারা টেবিলের নিচে লুকোয় তারাই হয়তো দিদির মতে সাহসী।’’ জেলার একটি থানার পুলিশ আধিকারিক আবার বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে পুলিশ তার নিজের কাজ করেছে। এবং এতে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে।’’
দিন কয়েক আগেও তৃণমূলনেত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, নির্বাচন কমিশন পুলিশ অফিসারদের বদলি করলে তাঁর কিছু আসে যায় না, কারণ সব অফিসার তাঁরই। তাহলে এখন কেনও পুলিশ নিয়ে ক্ষোভের সুর মুখ্যমন্ত্রীর গলায়।
তাহলে এখন কেন তাঁর গলায় উল্টো সুর?
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের এক কর্তার মতে, “হতাশা থেকেই মুখ্যমন্ত্রী এ সব কথা বলেছেন। পুলিশকে খোলস ছেড়ে বেরোতেই হত। পুলিশ তাই করেছে!” জেলা পুলিশের আর এক কর্তা বলছিলেন, “গত পাঁচ বছরে অনেক অন্যায় সহ্য করতে হয়েছে! শাসক দলের লোক বলে খুনের আসামীকে ধরতে গিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছে! যাদের কলার চেপে ধরে থাপ্পড় মারা উচিত, তারাই উল্টে পুলিশকে হুমকি দিয়েছে। এ সব আর কত দিন চলতে পারে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের একাধিক পুলিশ কর্তার আবার ক্ষোভ, “শুধু চাপ দিলে তো হবে না। ডিএ কোথায়? আমাদের তিনটি সংসার থাকে। থানায় নিজে থাকি। বৌ-বাচ্চা কোয়ার্টারে থাকে। বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে। শাসকদলের অন্যায় আবদারে সাড়া না দিলেই বদলি। তার জন্যই তো পুলিশ খেপেছে।”
আর এই ক্ষোভই পুলিশকে উর্দির মান রাখতে মরিয়া করে তুলেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে এসআই, এএসআই পদমর্যাদার দুই পুলিশ আধিকারিকের নিজের জেলায় ভোট মিটেছে। তবে পাশের পূর্ব মেদিনীপুরে ভোটের দায়িত্ব রয়েছে তাঁদের। দু’জনই বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে হুঁশিয়ারি দিয়ে আমাদের জেদ আরও বাড়িয়ে দিলেন। এখন তো আমরা আর রাজ্য সরকারের অধীনে নয়, কমিশনের অধীনে কাজ করছি। ফলে শেষ দফা ভোটেও উর্দির মান রাখতে যা করার করব।’’ তবে কি জোটের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে বলেই আপনারা এতটা সাহস দেখাতে পারছেন? এ বার এক এএসআইয়ের জবাব, ‘‘তা বলতে পারেন।’’
(তথ্য সহায়তা: সুব্রত গুহ, আনন্দ মণ্ডল, কিংশুক গুপ্ত, সুমন ঘোষ ও বরুণ দে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy