রসিকের অপেক্ষায় ভোট-মিষ্টি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
লম্বাটে ‘হাত’-এর ঠিক পাশেই হাসছে নিটোল ‘ঘাসফুল’। গায়ে গা ঠেকিয়ে খুনসুটি করছে ‘কাস্তে-হাতুড়ি’ আর ‘পদ্মফুল’। মিঠে-মহাজোট নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও অশান্তির খবর নেই। আধাসেনারও প্রয়োজন পড়ছে না। তবে, কাচের শো-কেসে আঙুল ঠেকিয়ে ‘ভোটারদের’ মিষ্টি আবেগে বেশ একটা মৃদু ধাক্কধাক্কি আছে।—‘আমায় একটা কাস্তে-হাতুড়ি দিন না!’ মিহি গলার অনুরোধ উপচে কড়া নির্দেশ আসছে, ‘চাট্টে হাত প্যাক করে দাও তো ভাই।’ গত কয়েকদিন ধরে ভিড় আর চাহিদার হাঁকডাক সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছেন বহরমপুর কল্পনা মোড়ের মিষ্টির দোকানটা।
মহাজোট যতই মিঠে হোক, ভোটের বাজার বলে কথা! তাই কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে চর্চা চলছে তা নিয়েও। বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে হার-জিতও রয়েছে। শুধু রবিবার রাতের ফলাফলের নিরিখে বাজিমাত করে হাসছে ‘হাত’। হাতের কাছে গো-হারা হেরেছে ‘ঘাসফুল’। তৃতীয় স্থানে
রয়েছে ‘পদ্মফুল’। আর ‘কাস্তে-হাতুড়ি-তারা’ রয়েছে তালিকার সব শেষে। ওই মিষ্টির দোকানের মালিক পূজন ঘোষ বলছেন, ‘‘এটা কিন্তু একদিনের রেজাল্ট। পরের দিকে ছবিটা কিন্তু পাল্টাতেও পারে!’’ রাজ্যে ভোটের বাদ্যি বাজতেই সন্দেশের পাকেও অন্য মিশেল দিয়েছেন পূজনবাবু। প্রায় ৫৫ বছরের পুরনো ওই দোকানে শো-কেস জুড়ে আটপৌরে মিষ্টির পাশাপাশি
সাজানো রয়েছে—‘হাত’, ‘ঘাসফুল’, ‘কাস্তে-হাতুড়ি’ ও ‘পদ্মফুল’। ভোটের আঁচ বুঝে পূজনবাবু জুতসই একটা নামও দিয়েছেন— ‘সন্দেশের ভোট যুদ্ধ’। ভোটও এমন মিষ্টি হয় নাকি? পূজনবাবু হাসছেন, ‘‘একবার চেখেই দেখুন না!’’
তবে এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় প্রথম এমন সন্দেশ তৈরি করেছিলেন পূজনবাবু। মিষ্টিপ্রেমীদের কাছ থেকে দারুণ সাড়াও মিলেছিল। সেই বছরেই ফুটবলের বিশ্বকাপ চলাকালীন বিভিন্ন দেশের ফুটবল দলের পতাকা আঁকা সন্দেশও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পূজনবাবু বলছেন, ‘‘চমচম তো হররোজ বানাই। কিন্তু এমন চমকে দেওয়ার সুযোগ তো তেমন মেলে না। তাই এ বারেও ভোটের বাজারে অন্যরকম স্বাদ আনতেই এই উদ্যোগ।’’
তবে এই মিষ্টি তৈরির হ্যাপাও কিন্তু কম নয়। রাজনৈতিক দলের প্রতীক আঁকা সন্দেশ না হয় তৈরি হবে। কিন্তু ছাঁচ মিলবে কোথায়? শেষতক কলকাতার চিৎপুরের নতুনবাজারের একটি দোকান থেকে কাঠ কেটে আলাদা আলাদা প্রতীকের ছাঁচ তৈরি করে আনা হয়। ছানার সঙ্গে মোয়া মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে সন্দেশ। কড়া পাকের। তারপর ছাঁচে ফেলে নানা প্রতীকের আকার দেওয়া হচ্ছে। উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আলাদা আলাদা এসেন্স। কংগ্রেসের প্রতীকে পাইনঅ্যাপেল, তৃণমূলে ভ্যানিলা, বিজেপিতে অরেঞ্জ আর সিপিএমে স্ট্রবেরি।
পূজনবাবুর দাবি, শুরু থেকেই হিট ওই সন্দেশ। বিকেলের পরে দোকানে ঢুঁ মারলেই শোনা যাচ্ছে—‘আমাকে চারটে হাত আর দু’টো ঘাসফুল দিন তো।’ সোমবার সন্ধ্যায় ভিড়ের মধ্যে থেকেই একজন বলে বসলেন, ‘‘কই হে, আমাকে চারটে হাত আর চারটে কাস্তে হাতুড়ি দাও। স্বাদও চেখে দেখা হবে। জোটধর্মও বজায় থাকবে।’’ এ দিন মিষ্টির দোকানে এসেছিলেন স্থানীয় এক কলেজ পড়ুয়া। এ বছর প্রথম ভোট দেবেন তিনি। নতুন সন্দেশ দেখে চেয়ে বসলেন ‘ঘাসফুল’। অন্যেরা কী দোষ করল? ‘‘নারদ-কাণ্ডের পরে তৃণভোজী হতে ইচ্ছে হল, তাই।’’ হাসতে হাসতে জবাব ওই তরুণীর।
পূজনবাবু জানান, এখন পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ওই সন্দেশ তৈরির বরাত মেলেনি। তবে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই চেখে দেখেছেন। বাড়ির জন্যও নিয়ে গিয়েছেন। ৬০ গ্রাম ওজনের ওই ‘হাত’, ‘ঘাসফুল’, ‘কাস্তে-হাতুড়ি’ ও ‘পদ্মফুল’ সবেরই এক দর— ২০ টাকা।
মিষ্টি-ভোটে পিছিয়ে নেই সরপুরিয়া-সরভাজার শহর, কৃষ্ণনগরও। নেদেরপাড়ার কাছে একটি নামী মিষ্টির দোকানে গত লোকসভা ভোটে তৈরি হয়েছিল এমন নানা প্রতীকের আকারে
মিষ্টি। ভোটের বাজারে বিকিয়েছিলও খুব। এ বারে কী করছেন? দোকানের মালিক গৌতম দাস বলছেন, ‘‘এ বারেও চমক থাকবে। ভোটের আঁচ আর একটু বাড়লে আমরাও পাকটা কড়া করে দেব।’’
মিষ্টির মতো সত্যি ভোটও যদি এমন মিঠে হত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy