Advertisement
১১ মে ২০২৪

পাপ ধুতে ধুতেই তো সময় কাবার, জবাব আরাবুলের

ইট কাঠের এই কাঠামোটাকে শুধু বাড়ি বললে কম বলা হয়! পোলের হাট থেকে বিশ বিশ মাইল দূরের মানুষও জানেন এ ‘অফিসের’ মাহাত্ম্য! উঠোন গোবরে নিকিয়ে পারলে সেখানে এখন গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেন আরাবুল ইসলাম।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪১
Share: Save:

ইট কাঠের এই কাঠামোটাকে শুধু বাড়ি বললে কম বলা হয়! পোলের হাট থেকে বিশ বিশ মাইল দূরের মানুষও জানেন এ ‘অফিসের’ মাহাত্ম্য!

উঠোন গোবরে নিকিয়ে পারলে সেখানে এখন গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেন আরাবুল ইসলাম।

ভাঙড়ে ওঁর নামটাই যথেষ্ট। দুপুরে ঘেমে নেয়ে প্রচার থেকে ফিরেছেন। চেয়ারটা ঘুরিয়ে বসতে না বসতেই বিরক্তিটা বেরিয়ে এলো— ‘‘পাপ ধুতে ধুতেই তো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দিদির উন্নয়নের প্রচারটা করবো কখন!’’ রাখ ঢাক নেই। রুমালটা টেবিলে রেখে ফের বিড় বিড় করে বললেন, ‘‘কী পাপ রে বাবা। কান পাতা দায়।’’

কী পাপ? আরাবুলের ব্যাখা, ‘‘প্রায় পাঁচ দশক ভাঙড়ের আদি কংগ্রেস পরে তৃণমূল সমর্থকেরা সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লাকে শত্রু ভেবে এসেছেন। এখন রাতারাতি কী এমন কাজ তিনি করে ফেলেছেন যে, তাঁকে বন্ধু তৈরি করে দেবো বলুন তো? রেজ্জাক সাহেবের নাম বহু কংগ্রেস ও তৃণমূল নেতা খুনে জড়িত বলে রটনা রয়েছে। বিরোধীদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তিনি জেল খাটিয়েছেন বলেও অনেকে এসে অভিযোগ করে যাচ্ছেন।’’ এক সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে আরাবুলের আক্ষেপ, ‘‘ভাঙড়ের লোকেদের কপালটাই খারাপ। সেই ২০০৬ সালে এক বার আমি সিপিএমকে হারিয়ে বিধায়ক হয়েছিলাম। ২০১১ সালে পরিবর্তনের হাওয়াতেও তৃণমূলের এক গোঁজ দাঁড়িয়ে আমাকে ১০ হাজার ভোটে হারিয়ে দিল।’’ গজগজ করে চলেন ‘তাজা নেতা’— ‘‘এমন এক জন সাংসদ হয়েছেন, যিনি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরেই বিমান ধরে
বিদেশ চলে গিয়েছেন। মাঝেমধ্যে দিল্লি উড়ে আসেন। ওখান থেকেই আবার বিদেশে চলে যান। ভাঙড়ের মানুষ সাংসদের মুখ দেখতে পান টিভিতে! কপাল কপাল!’’

এ বার পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন আরাবুল। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম নেতা এখন তৃণমূল প্রার্থী। সমর্থকেরা তাই মুখ ঘুরিয়ে রয়েছেন। আর রেজ্জাক সাহেব অভ্যাসবশত উল্টোপাল্টা কথাও বলে ফেলছেন। তাতে সমর্থকেরা আরও বিগড়ে যাচ্ছেন।’’ আরাবুল বলে চলেন, ‘‘তিনি সিপিএমের নেতা। ওদের লোকেরা হয়তো ওঁর কথা মেনে
নিত। আমাদের লোকেরা কেন মানবে?’’

জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রাক্তন সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লাকে ভাঙড়ে প্রার্থী করার পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা তেলে-জলে মেশানোর চেষ্টা করছেন। রেজ্জাকের নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন আরাবুল ইসলামকে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কি হয়েছে? তেল আর জল কি মিশেছে? মেশেনি যে প্রকারান্তরে তা স্বীকার করছেন আরাবুলই। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৬ সালে ভাঙড়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে নানা ঘটনায় আমাকে একের পর এক অভিযোগে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক বার জেলও খেটেছি। কিন্তু কোনও দিন দলের বিরুদ্ধে একটাও কথা বলিনি। আমি কিন্তু অকৃত্রিম তৃণমূল। দল আমাকে সাসপেন্ড করেছে, আবার ফিরিয়েও নিয়েছে। আমি কিন্তু অন্য দলে যোগ দিইনি। নিজের কাছে আমার দলটা অনেক বড়। ভুল-ত্রুটি হয়েছে ঠিকই, তবু দলবদল করিনি। আমার সঙ্গে রেজ্জাক মোল্লার কী ভাবে মেলবন্ধন হবে বলুন তো?’’

জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, দলের অস্বস্তি শুধু ভাঙড়ের রেজ্জাক নন। তাঁর একদা ছায়াসঙ্গী ক্যানিং (পূর্ব)-এর তৃণমূল প্রার্থী শওকত মোল্লাও। ভাঙড় লাগোয়া ক্যানিং (পূর্ব) কেন্দ্রের আর এক প্রাক্তন সিপিএম নেতা তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু ক্যানিং(পূর্ব)-র ছায়া কী ভাবে ভাঙড়ে পড়ছে?

আরাবুলের কথায়, ‘‘এখন তো গুরু-শিষ্যের কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। শওকত বলছেন, রেজ্জাক আমার হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছিলেন। ওই বন্দুক তিনি ব্যবহার করেছেন। এতে কি হচ্ছে জানেন? রেজ্জাক সাহেবের গা থেকে ‘খুনি’ তকমাটা সরানোই যাচ্ছে না। তৃণমূল সমর্থকদের একেবারেই বোঝানো যাচ্ছে না।’’

বছর তিনেক আগে রেজ্জাক মোল্লাকে রাস্তায় ফেলে মারধর করার অভিযোগ উঠেছিল আরাবুলের বিরুদ্ধে। তার জন্য তাকে গ্রেফতারও হতে হয়েছিল। সে কথা কি মনে পড়ে আরাবুল ইসলামের?

‘‘তা পড়ে’’, কবুল করছেন আরাবুল। শুধু কবুলই করছেন না, ওই ঘটনায় তাঁর একটা রাজনৈতিক প্রাপ্তিও হয় বলে মনে করেন আরাবুল। বলেন, ‘‘ওই দিন ভাঙড়ের কাঁটাতলায় তৃণমূলের সভা-মঞ্চের সামনে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন রেজ্জাক সাহেব। চুপ করতে বলেছিলাম। আচমকা পা হড়কে রাস্তায় পড়ে গেলেন রেজ্জাক সাহেব। তার পরে তো ইতিহাস।’’ কী ইতিহাস? আরাবুল বলেন, ‘‘ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে আমার নতুন নাম হল তাজা নেতা।’’ এ বার বেশ জোরে হো হো করেই হেসে উঠলেন আরাবুল। ফের বলেন, ‘‘আমি কিন্তু তাজা নেতা।’’

তবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সভায় দলের ঘোষিত প্রার্থী রেজ্জাক মোল্লার পাশেই রয়েছেন আরাবুল ইসলাম। সম্প্রতি রেজ্জাক সাহেবকে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলাও শিখিয়েছেন তিনি। এই গেম খেলা শেখানোর মধ্যে আরাবুলদার একটা ‘গেম প্ল্যান’ আছে বলে মনে করেন তাঁর ছায়াসঙ্গীরা। সেটা কী রকম? বরাবর বিতর্কিত কথা বলে দলকে ঝামেলায় ফেলা স্বভাব ঠোঁটকাটা রেজ্জাক সাহেবের। তিনি যাতে উল্টোপাল্টা কথা বেশি বলে জলঘোলা না-করেন, সেই কারণেই নাকি তাঁকে মোবাইলের গেম-এ ব্যস্ত রাখতে চাইছেন ‘দাদা’।

কিন্তু আরাবুল কি পারবেন রেজ্জাক মোল্লাকে জিতিয়ে আনতে? গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রায় ৬০ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল। সে ভোটও হয়েছিল আরাবুলের নেতৃত্বেই। রটনা রয়েছে, নির্বাচনের দিন আরাবুল বাহিনী বুথ দখল করে দেদার ছাপ্পা মেরেছিল।

কিন্তু এ বার কী হবে? আরাবুলের কথায়, ‘‘ছাপ্পা হোক বা ধাপ্পা। মানুষই তো ভোটটা দেয়। চার দিক ঘুরে ফিরে এ বার তো মনে হচ্ছে মানুষই যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দেখা যাক, নির্বাচনের দিন কী হয়।’’

ঘড়ির কাঁটা ৫টা ছুঁইছুঁই। মোবাইলে ফোন এল রেজ্জাক সাহেবের। শোনপুরের সভায় যেতে হবে। উঠে পড়লেন আরাবুল। দরজার কাছে গিয়ে বলেন, ‘‘প্রচার সভা তো নয়, এ যেন পাপ ধোয়ার প্রকল্প!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2017 Arabul Islam TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE