Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মাউস বনাম কলেজ স্ট্রিট

লড়াই এখনও চলছে। লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত।কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ। পুরনো বইয়ের দোকানগুলোয় এলোমেলো ঘুরছিল সেকেন্ড ইয়ারের প্রদীপ। আনমনে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই আচমকা হাতে অমূল্য রতন। পকেট গীতাঞ্জলির প্রথম সংস্করণ।

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৬
Share: Save:

ডেটলাইন ১৯৬৯

কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ। পুরনো বইয়ের দোকানগুলোয় এলোমেলো ঘুরছিল সেকেন্ড ইয়ারের প্রদীপ। আনমনে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই আচমকা হাতে অমূল্য রতন। পকেট গীতাঞ্জলির প্রথম সংস্করণ।

ডেটলাইন ২০০০

প্রদীপের মেয়ে হিয়া এখন প্রেসিডেন্সির পড়ুয়া। ছুটির পরে বইপোকা মেয়ে বাবার মতোই হাতড়ে বেড়ায় দোকানগুলোয়। মপাসাঁর কালেকশনটাও হাতে এসে গিয়েছে সে ভাবেই।

ডেটলাইন ২০১৫

ইউনিভার্সিটির গেটের পাশে দোকানদারের সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া বাধল দীপ আর তিয়াসের। সেকেন্ড হ্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা প্রায় হাফ দামে মিলছে অনলাইনে। তা হলে দোকানে এসে এত দাম ওরা দেবে কেন?

অনলাইনে বই কেনাকাটার সুখ বাঙালির নাগালে এসেছে বহু দিন হল। কাজের ফাঁকে টুক করে অর্ডার। ব্যস, প্যাকেট বন্দি হয়ে সোজা বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে ঝকঝকে নতুন বই। দোকানের চেয়ে অনেক অনেক সস্তায়। তবে দুষ্প্রাপ্য বা পুরনো বই কিনতে বেশ কিছু দিন আগেও সশরীরে দোকানে যেতেই হত। হালফিলের কয়েকটা সাইট সেই সময়টুকুও বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের সম্ভার নিয়ে বেশ কিছু সাইট হাজির হয়ে গিয়েছে নেট দুনিয়ায়। আসল দামের চেয়ে ঢের কম দামে। আমাজন, ইনফিবিম, ফ্রেন্ডসঅফবুকস, ইন্ডিয়ানইউজডবুকস-এর মতো সাইটগুলোয় সেই সব পুরনো বই কিনতে ভিড়ও নেহাত কম নয়।

ক্লিক, বই এবং...

“পুরনো বই মানে যে একেবারে খারাপ অবস্থায় থাকে, তা তো নয়। বরং বেশ ঠিকঠাক কন্ডিশনেই তো পাই। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে কিনতে হলে অনেকটা সময় হাতে রাখতে হত, দামটাও এতটা সস্তা হত না। তা হলে অনলাইনে কেনাটা মন্দ কী! ” দিল্লির গবেষক সংহিতাও অনলাইনে কিনে ফেলেছেন বেশ কিছু পুরনো বই। “আফগান ইতিহাসের বই আর কয়েকটা উপন্যাস কিনেছি। নতুন কিনলে অনেকটাই বেশি দাম লাগত। সেকেন্ড হ্যান্ড কেনায় অনেকটাই সস্তায় পেলাম। বইগুলো দিব্যি ভাল কন্ডিশনেও আছে,” বলছেন তিনি।

অনলাইনে পুরনো বইয়ের এই রমরমা কিছুটা ছায়া ফেলেছে বইপাড়ার আনাচকানাচেও। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথের বেশির ভাগ দোকানিই একবাক্যে স্বীকার করছেন পুরনো ইংরেজি গল্পের বই, ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞানের গবেষণাধর্মী বই কেনার খদ্দেরে যেন খানিকটা ভাটার টান। যাঁরা আসছেন, তাঁরাও দরদস্তুর করছেন আগের চেয়ে অনেক বেশি। সোজা বলে দিচ্ছেন, ‘এ বইটা তো অনলাইনে আরও শ’খানেক টাকা কমে দিচ্ছে, তারও কমে না দিলে এখান থেকে নেব কেন?’ বই পড়ার অভ্যাসটাও যে কমে গিয়েছে, সেটাও মানছেন অনেকেই।

তবে কি পাল্টে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট এবং বইপোকা বাঙালির সমীকরণও?

ইংরেজি বইয়ের ভাঁড়ার যদি বা তার খানিক আভাস দেয়, বাংলা বইয়ের হাত ধরে কিন্তু এখনও কলেজ স্ট্রিট আছে কলেজ স্ট্রিটেই। তার একটা কারণ অবশ্যই, সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের সাইটগুলোতে এখনও বাংলা বইয়ের দেখা মেলে না বললেই চলে। মিললেও সে বড়জোর হালফিলের গল্প-কবিতা-উপন্যাস। কিন্তু দুষ্প্রাপ্য সব বই, বাংলা সাহিত্যের যে বইগুলো হাতে পাওয়া মণিমুক্তো পাওয়ারই সামিল, সে বইয়ের টানে এখনও কলেজ স্ট্রিটেই ছোটে বাঙালি।

আফসোস ঝরে পড়ে চাকরিসূত্রে মুম্বই পাড়ি দেওয়া পায়েলের গলায়। “ইশশ, কলেজ স্ট্রিটটা যে কী মিস করি! অনলাইনে কেনার মতো পুরনো বাংলা বই কোথায়!” পায়েলদের কথা ভেবে কি পাল্টে যাবে কলেজ স্ট্রিটও? অনলাইনেই মিলে যাবে বইপাড়ায় টইটইয়ের সুখ?

কলেজ স্ট্রিটের এ মাথা থেকে থেকে ও মাথা চষে ফেলে তেমনটা অন্তত মনে হল না। কেউ বলছেন, ওয়েবসাইটে বেচার মতো বইয়ের পুঁজি নেই। দরদামে পোষাবে না, এমনটাও বলছেন কেউ কেউ।

বইপাড়া বইপাড়াতেই

দোকানি সুব্রত ঘোষ বা মহম্মদ মনসুর আলমদের কথায়, “অনলাইনে বেচতে হলে লক্ষ লক্ষ বইয়ের জোগান দরকার। আমাদের দোকানে অত বই কই! আমাদের বইয়ের জোগান তো আসে, মূলত বাড়ি-লাইব্রেরি-স্কুল-কলেজের বিক্রি করে যাওয়া বই থেকে। তার কোনও কোনওটার অবস্থা এমন থাকে যে ওয়েবসাইট নেবে কেন? আবার অনলাইনে কেনা সস্তার নতুন বই পড়া হয়ে গেলে লোকে আমাদের কাছে বেশি দামে বেচতে চায়, সেগুলো বেশি দামে কিনে ওয়েবসাইটে আবার কমে বেচব কী করে! পড়তায় পোষাবে না তো!” ওয়েবসাইটে বেছে বেছে ভালগুলোই নেবে, সে ক্ষেত্রে খারাপগুলো পড়েই থাকবে। লোকসানের এ দিকটাও ভাবাচ্ছে তাঁদের।

আর এক বিক্রেতা নাজমুল হক মল্লিকের ফোন নম্বর আছে ইন্টারনেটে। “ফোনে অর্ডার দিতে পারেন। তবে বই কিনতে হলে দোকানেই আসতে হবে। অনলাইনে বই বেচার ইচ্ছে আছে বটে,” বলছেন তিনি।

কলেজ স্ট্রিটে এসেছেন শুধু পুরনো বাংলা বইয়ের টানে? বললেই যে কেউ এক ডাকে চিনিয়ে দেবেন, ‘পঞ্চাদা’র দোকান। সেই পঞ্চাদাও অবশ্য ওয়েবসাইটে বই বিক্রিতে এতটুকু আগ্রহী নন। পঁয়তাল্লিশ বছর বইপাড়ায় দোকান করা পঞ্চানন দত্ত বলছেন, “এটা নিয়ে ভাবছিই না। দোকানে এসে কেউ একটা বই খোঁজ করলে বলা যায়, আনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। অনলাইনে সেটা হবে না। এ তো আর নতুন বই নয় যে অসংখ্য প্রিন্ট হাতে থাকবে। একটা বই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটাই আসে। বেরিয়ে গেলে ফের অন্য নতুন বই আসে। পুরনো বাংলা বইয়ের, বিশেষত দুষ্প্রাপ্য বইয়ের জোগানের কোনও নিশ্চয়তাও নেই। অনলাইনে এ ভাবে বই বিক্রি হয়?”

পঞ্চাদা অবশ্য আরও একটা কথা মনে করিয়ে দেন। “নিজের হাতে বই ঘেঁটে দেখার যে সুখ, পুরনো বইয়ের হলদে হয়ে আসা পাতার গন্ধ, সে মজা কোথায় ইন্টারনেটের চটজলদি কেনাকাটায়?”

ডেটলাইন ২০১৫

একমুখ তৃপ্তি নিয়ে দোকান ছেড়ে বড় রাস্তার দিকে রওনা দেন বছর পঁয়ত্রিশের যুবক। কাঁধঝোলায় ইন্দ্রজাল কমিক্স আর বাঁধানো কাশীদাসী মহাভারতের উঁকিঝুঁকি। সাক্ষী থাকে পড়ন্ত বিকেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE