অ্যাকশন: ক্যামেরার পিছনে চেনা ভঙ্গিতে নির্দেশ দিচ্ছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার।
প্রশ্ন: আপনার বড় হয়ে ওঠা তো উত্তরবঙ্গে?
উত্তর: আসলে আমার ছোটবেলা কেটেছে বগুড়া বলে একটা ছোট ডিস্ট্রিক্ট টাউনে। এখন অবশ্য তা বাংলাদেশের অন্তর্গত। দেশভাগ হওয়ার পর ওখান থেকে চলে আসতে হয়। বগুড়ায় আমাদের যা সম্পত্তি ছিল তা বেচে আমরা চলে আসি সামসিংয়ের কাছে মেটেলি বলে এক জায়গায়। এই জায়গাটি আপার ডুয়ার্সে, প্রায় ভুটান বর্ডারের কাছাকাছি। এক মুসলমান ভদ্রলোকের সেখানে বাড়ি ছিল। তাঁর সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করা হয়। তিনি ওখানে চলে যান এবং আমরা এখানে চলে আসি।
প্র: যখন আপনারা এখানে চলে আসেন, তখন কি আপনি স্কুলের গণ্ডি পার করে গিয়েছেন?
উ: না, তা নয়। তখন আমার কত বয়স হবে, (ভেবে বললেন) ধরুন, চোদ্দো-পনেরো হবে।
প্র: মেটেলি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...
উ: জায়গাটা অপূর্ব সুন্দর। চার দিকে বিরাট উঁচু উঁচু পাহাড়। শীতকালে দেখা যায় দূরের পাহাড়ে বরফ পড়েছে। এ দিক ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চোদ্দোটা চা-বাগান। উঁচু-নিচু পিচের রাস্তা ঢেউ খেলে চলে গিয়েছে। কাছেই গরুমারা ফরেস্ট। চাপড়ামারি ফরেস্ট। মাঝেমাঝেই হাতির পাল চলে আসত। আসলে মেটেলি চা-বাগান কেন্দ্রিক খুব ছোট একটা জায়গা। ঠিক গ্রাম নয়, আবার শহর তো নয়ই। ছোটখাট সব দোকান ছিল ওখানকার চা-বাগানের শ্রমিক এবং মালিকদের রোজকার চাহিদা পূরণের জন্য। তখনও চা-বাগানের মালিক অনেক সাহেব-মেমসাহেবরা ছিলেন। তাঁরা নিজের নিজের বাংলোয় থাকতেন। তাঁদের ম্যানেজাররাও থাকতেন। তারপর ধীরে ধীরে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। সাহেবরা চলে যান, দেশীয় সাহেবরা তার জায়গায় আসেন। কিন্তু শ্রমিকদের অবস্থা যে রকম ছিল, আজও সে রকমই রয়েছে।
প্র: আপনাদের বাড়িটা কী রকম ছিল?
উ: আমরা তো ওই বাড়িটা তৈরি করিনি। পেয়েছিলাম। ওই অঞ্চলের বাড়িগুলো যে রকম হয়, আমাদের বাড়িটাও সে রকমই। কিছুটা কাঠের, কিছুটা সিমেন্টের ঢালাই করা... ধরুন, আপনি একতলায় ঢুকলেন, দুটো ঘর পেরিয়ে হঠাৎ দেখলেন, আপনি একতলায় নয়, দোতলায় দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়ি দিয়ে আপনাকে নামতে হচ্ছে। বাড়িতে তখন আমি বাবা-মা, আমার ছোট ভাই ছাড়াও থাকতেন আমার কাকা। যদিও আমার বাবা আমাদের সঙ্গে খুব কমই থাকতে পারতেন। বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমাদের পরিবারে অনেকেই অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। জেলে জেলেই তাঁদের দিন কাটত। যখন ছাড়া পেতেন, তখন সংসারটা দেখতেন।
প্র: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি বাড়ির ছবিটা পাল্টালো?
উ: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবা রাজনীতির সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এখানে চলে আসেন এবং নানা রকম সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সে সময় এই জায়গাটা খুবই ছোট ছিল। একটা নগন্য প্রাইমারি স্কুল ছিল। বাবার সঙ্গে এখানকার আরও কিছু ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। সবাই মিলে ঠিক করেন, স্কুলটাকে ভাল করে গড়ে তুলতে হবে। সেই মতো তার পিছনে লেগে পড়েন। এখন অবশ্য সেটা মস্ত বড় হয়েছে। মেটেলি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। বিশাল মাঠ, কোয়ার্টার, ল্যাবরেটরি, হস্টেল... সেটা করতে-করতেই অত্যধিক পরিশ্রমে বাবা চলে যান।
প্র: আপনি পড়াশোনা করতেন কোথায়?
উ: আমি পড়াশোনা করতাম কলকাতায়। ভাইও তাই। কিন্তু ওটা ছিল আমাদের ঘাঁটি। মা-বাবা ওখানে থাকতেন, কাকাও থাকতেন। পড়াশোনা শেষ করার পর আমি কলকাতায় ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। আমার ভাই কলকাতায় এমএ, বিটি করে নর্থ বেঙ্গলের ওই জায়গাতেই চলে যায়। শিক্ষকতা করতে শুরু করে।
সেদিন: শিমুলতলায় ‘দাদার কীর্তি’ ছবির শুটিংয়ে পরিচালকের সঙ্গে অনুপকুমার এবং তাপস পাল। ফাইল চিত্র
প্র: আপনাদের সে বাড়ি কি এখনও ওখানে আছে?
উ: হ্যাঁ, সে বাড়ি এখনও আছে। যখনই সময় পাই ছুটিছাটায় ওখানে চলে যাই। ভাই ওখানে থাকে। ও-ই দেখাশোনা করে। আমি যেহেতু কলকাতায় পড়াশোনা করতাম, তাই ওখানে বন্ধুবান্ধব খুব অল্পই রয়েছে।
প্র: ছুটির সময় কাছাকাছি কোথাও বে়ড়াতে যেতেন?
উ: বেড়ানোর জন্য কাছাকাছি বহু জায়গা রয়েছে। অপূর্ব সুন্দর সব জায়গা। ভুটান বর্ডারের তো তুলনা নেই। এ ছাড়াও ঝালং, বিন্দু... তালঝোরা বলে একটা জায়গা ছিল, তখনকার জলঢাকা নদী পেরিয়ে যেতে হত... সে সব জায়গায় মাঝেমধ্যেই যেতাম। বাবার সঙ্গে খুব একটা যাওয়া হত না। মা আর ভাইয়ের সঙ্গেই বেশি যেতাম। তারপর কলকাতা থেকে কিছু বন্ধুবান্ধব গেলে, তাদের সঙ্গেও সে সব জায়গায় বেড়ানো... এসব তো চলতই।
প্র: আপনার ছোটবেলায় দেখা মেটেলির সঙ্গে এত বছরে কিছু কি তফাত দেখতে পান?
উ: হ্যাঁ, পরিবর্তন তো হয়েছেই। জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, অঞ্চলটা দেখতে ভীষণ সুন্দর বলে, একটি রিসর্টও তৈরি হয়েছে। তাই নানা ধরনের টুরিস্টেরও সমাগম হচ্ছে।
প্র: জায়গাটা ঘিরে এমন কোনও স্মৃতি আছে, যা আপনার স্মৃতির মণিকোঠায় আজও উজ্জ্বল...
উ: হ্যাঁ, ওই জায়গাটা ঘিরে আমার একটা স্মৃতি তো খুবই মনে আছে। ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘কাঁচের স্বর্গ’... এই ছবিগুলো আমি তখন করেছি। এর পরই আমার বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় চিকিৎসার জন্য। তখন ওই বাড়িতে আমি ছিলাম আর ছিলেন আমার কাকা। সে সময় ওখানে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। একদিন পুরনো আলমারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে মনোজ বসুর একটা গল্প সংকলন হঠাৎ আমার হাতে আসে। তাতে একটা গল্প খুব ভাল লেগে যায়। ‘আংটি চাটুজ্যের ভাই’। ওখানে বসেই আমি সেই গল্পটা নিয়ে চিত্রনাট্যটা লিখে ফেলি। ফাঁকা বাড়িতে অন্ধকার ঘরে লন্ঠনের আলোয় আমার চিত্রনাট্য লেখা... চারদিকে পাহাড়ে ঝিঁঝির ডাক...তার মধ্যেই আমার চিত্রনাট্য লেখা চলছে। সে সব দিনের কথা আজও আমার খুব মনে আছে। ছবির নাম দিয়েছিলাম ‘পলাতক’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy