ছবি: কৌশিক সরকার
ভরা কোপাই। মেঘের মিনারে হঠাৎ হঠাৎ রোদের ঝিকিমিকি। যেন বর্ষার হাসিতে একমুঠো শরৎ।
এমনই এক এলোপাথাড়ি জল-হাওয়ার ভোরে ইমনে সুর তুলছেন বেগমজান।
প্রেম মে কোহরে পুরানা জমানা নয়া হো গ্যয়া
ইয়ে ক্যায়া হো গ্যয়া
কভি সাস থামি কব সাস ছোড়ি
হর দর্দ মেরি বায়া হো গ্যয়া…
তাঁর স্নান-ভেজা একরাশ এলো চুলে কখনও জল, কখনও রোদ খেলে যাচ্ছে। ঠিক ঝাড়খণ্ডের পাতজোরের আবহাওয়ার মতো।
‘‘গতরাত থেকেই ভীষণ এক্সাইটেড বিদ্যা। আশাজির কণ্ঠে ‘বেগমজান’য়ের প্রথম গান,” মনিটরে চোখ রেখে বললেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
প্রায় এক মাস হতে চলল, দুমকার এই জনমানবহীন জঙ্গল-পাহাড় ঘেরা লালমাটির প্রান্তরে তিনশো জনের ইউনিট নিয়ে শ্যুট করছেন সৃজিত। অ্যাক্সিডেন্টের পরে পায়ে আবার চোট পেয়েছেন শ্যুট করতে করতে। কিন্তু শ্যুটিং থামেনি। ইউনিটের একজন, কাঁকড়াবিছের কামড় খেয়েছেন। দেখা গেছে মাঝরাতে দু-একটা বিষাক্ত সাপও। তবুও কিছু থেমে থাকেনি। সকাল ৭টা থেকে সন্ধে ৭টা অবধি চলছে টানা শ্যুট। এমনকী লাঞ্চ ব্রেকের কোনও গপ্পো নেই। যে যার সময়মতো হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
‘‘আমার জীবনে এত ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করেছি কিন্তু সৃজিত হচ্ছে ফাস্টেস্ট! উফ! সারাক্ষণ কাজ, দশটা-বারোটা টেক... নিজের কাজ নিয়ে খুব ফোকাস্ড ও। ওর সঙ্গে কাজ না করলে বুঝতেই পারতাম না,’’ শটের ফাঁকে বললেন বিদ্যা।
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কালো বারমুডা আর কালো টি শার্টের সৃজিত। কাছে এসে বললেন, ‘‘আচ্ছা বিদ্যা কী বলছে? সুজয় ঘোষ না সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কে বেশি ভাল?’’
বিদ্যা একগাল হেসে জবাব দিলেন, ‘‘আরে যা বলছি ছাপার অক্ষরে পড়ে নিও, এখন বলা যাবে না।’’ বিদ্যাকে থামিয়ে সৃজিত, ‘‘না, আসলে সেই বুঝে ঋতু না বিদ্যা কে বেশি ভাল সেই উত্তরটা দেব কিন্তু!’’ ছোটখাটো ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছে। বিদ্যার জন্য এসেছে স্পেশাল মেকআপ ভ্যান। সেখান থেকে হাভেলিতে বেগমজান প্রবেশ করতেই ফ্লোরের সবাই কাজ ছেড়ে উঠে দা়ঁড়ালেন আর পরিচালক আদাব ঠুকতেই বিদ্যা গেয়ে উঠলেন সেই গান—‘ইয়ে কেয়া হো গ্যয়া’। সদ্য ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর ফোন পেয়েছেন সৃজিত। ঋতুপর্ণা জানতে চেয়েছেন কেমন করছে বেগমজান। যোগ করলেন সৃজিত, ‘‘একটু যেন অভিমান করেই বলল, আমাকে তো নিলে না। আসলে ‘রাজকাহিনী’তে চরিত্রটা করতে গিয়ে ঋতু নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙেছিল। ঋতুর ওই ডিগনিফায়েড, আধুনিক নারীর লুক থেকে মেজাজি বাংলা-হিন্দি মেশানো ধরা গলার বেগমজান, যে দু’পা ফাঁক করে বসে গালি দেয়। উফ! রক্ত-ঘাম দিয়ে গড়েছিল ও নিজেকে,’’ সৃজিত থেকে থেকেই ফিরে যাচ্ছেন ‘রাজকাহিনী’তে। ঠিক যেমন ‘বেগমজান’য়ে অভিনয় করতে গিয়ে কম-বেশি প্রত্যেক অভিনেতাই শট দেওয়ার পর সৃজিতকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘আচ্ছা, ‘রাজকাহিনী’র চেয়ে এটা ভাল হল না খারাপ?’’
বেশ মজা করেই বললেন সৃজিত, ‘‘রাজেশ শর্মা শট দেওয়ার পর বলল, ‘আচ্ছা বলো তো কাঞ্চন ভাল না আমি?’ অন্য দিকে প্রিয়াঙ্কা তো অভিনয় করতে করতে বলেই বসল, ‘যতই শট ওকে বলো, তোমার চোখে তো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড উইনার সুদীপ্তা চক্রবর্তী লেগে আছে।’’’
নিজের মোবাইল থেকে সৃজিত দেখালেন নাসিরুদ্দিন শাহ-র লুক। “যিশু সেনগুপ্তর চরিত্রে চাঙ্কি পাণ্ডের লুকটাও কিন্তু একটা চমক,’’ চায়ের গ্লাস হাতে বললেন সৃজিত।
বিদ্যা অবশ্য কিছু বলেননি। তিনি তো নিজেই বেগমজান। বেগমজান-য়ের সব রহস্য ছড়িয়ে আছে ওঁর শরীরে। ন’ হাজার স্কোয়ার ফুটের হাভেলিতে তিনি যেন যন্ত্রণার নারী। কখনও সেকেলে দেরাজে, কখনও পঞ্জাবি হাভেলির জাফরিতে তাঁর ধূসর চোখের ছায়া পড়ছে থেকে থেকে। এমনই সব শট নিচ্ছেন সৃজিত। কখনও বিদ্যার চোখের সামনে নেমে আসছে রাত। হাভেলির বাইরে জ্বলে উঠছে মশাল। পুরনো সিন্দুক, সাবেকি আরামকেদারা, লন্ঠনের কাঁপা আলোয় বেগমজানের হাভেলি তখন মায়াময়! ‘‘সেটটা প্রায় এক মাস ধরে তৈরি করা হয়েছে। শুনেছি ঝড়় এসে সব ভেঙে দিয়েছে, আবার হাভেলি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
ঠিক যেমন বেগমজানের জীবনে ঝড় আসে, ঝড় যায়। এত রিয়্যাল একটা সেট। এখানে দাঁড়ালেই সংলাপ চলে আসছে,’’ ডিপ কাট, ঘেরওয়ালা লং কামিজ পরে ধূসর চোখে বললেন বিদ্যা। হাভেলি যেন কথা বলে ওঠে। শিবাজী পাল, মৃদুল বৈদ্য, শাশ্বতী কর্মকাররা সেট তৈরিতে কোনও কমপ্রোমাইজ করেননি। ‘রাজকাহিনী’ ছবিটা প্রথমে বাইলিঙ্গুয়াল করার কথা ভেবেছিলেন সৃজিত। আর বিদ্যাই ছিলেন তাঁর বেগমজান। তখন বিদ্যার সময় হয়নি। কিন্তু প্রথম হিন্দি ছবিই রিমেক? সঞ্জয়লীলা বনশালি নাকি বলেন নিজের ছবি আর রিমেক করা যায় না... কথাটা শুনেই মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে সৃজিত বললেন, ‘‘সঞ্জয়লীলা বনশালি এ প্রশ্ন আমায় করেছেন। ‘বেগমজান’ ‘রাজকাহিনী’র রিমেক নয়। এখানে মাউন্টব্যাটেন, দেশভাগ ডিটেলে নেই। বরঞ্চ ‘বেগমজান’ অনেক বেশি সম্পর্কের গল্প। নতুন অভিনেতাদের দল, নতুন ভাষা... একই ছবি হলে পরিচালক হিসেবে আমার কোনও উত্তেজনা থাকত না।’’
এগারো জন মেয়ের গল্প বলবে ‘বেগমজান’। তবে এ বার কাশ্মীরি, রাজস্থানি, পঞ্জাবি মেয়ের ক্যানভাসে। কথার ফাঁকে ছুটে এলেন ইউনিটের এক জন—‘‘দাদা, বিদ্যা গামছা দিয়ে চুল বাঁধতে পারে?’’ সৃজিত খুবই বিরক্ত! ‘‘পঞ্জাবে কি মেয়েরা চুল বাঁধার জন্য গামছা ব্যবহার করে? বুদ্ধিটা খাটাও না বাবা।’’ মনিটরে চোখ থাকলেও সব দিকে তাঁর সমান নজর। শান্তিনিকেতন হয়ে পাতজোর-য়ের রাস্তায় যেতে যেতে গাড়ির চালক বললেন, বিদ্যা বালনকে দেখতে দুমকা গ্রাম উপচে পড়ছে। পুলিশ, কমান্ডো দিয়ে তাদের আটকাতে হচ্ছে। অন্য দিকে শ্যুটিং দেখতে এলে চা-স্ন্যাকস, আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি রাখছে না সৃজিতের ইউনিট। শুধু জানানো হচ্ছে হাভেলির কোনও ছবি, চরিত্রদের ছবি, এমনকী হাভেলিতে সেলফি তোলাও বারণ!
সদ্যই নাসিরুদ্দিন শাহ শট দিতে গিয়েও নাকি ইউনিট-য়ের একজনকে ধমকেছেন। বেচারা সেলফি তুলতে চেয়েছিল! নাসির সেলফি একদম পছন্দ করেন না। নাসিরুদ্দিন শাহের সঙ্গে কাজ করে অভিভূত সৃজিত বলছিলেন, ‘‘স্কিৎজোফ্রেনিক ওয়েদারে শ্যুট করা ঝামেলার। এই বৃষ্টি তো এই রোদ। এরকম এক দিনে নাসিরজিকে বললাম সূর্য ডুবতে কয়েক মুহূর্ত বাকি, আপনার তো চেঞ্জ আছে। উনি মেক আপ রুমে গেলেন না পর্যন্ত, ওখানেই চেঞ্জ করলেন।” রোজ শান্তিনিকেতন থেকে দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে আসতে হচ্ছে এই জঙ্গল-লালমাটির পাহাড়ে। কোথাও বিরক্তি নেই। বৃষ্টির দৃশ্য হওয়ার কথা, পুরো শ্যুটিং শেষ না হতেই রোদ। বিদ্যা তৎক্ষণাৎ রেডি হয়ে গেলেন অন্য শ্যুটের জন্য। ‘‘এত বড় মাপের অভিনেত্রী অথচ কোনও ট্যানট্রাম নেই,’’ বলছিলেন সৃজিত।
মুম্বইয়ের লোকজন সৃজিতের একটানা কাজ দেখে বেশ অবাক! সৃজিত জানান, মুম্বইয়ের টাকা আছে, তাই বলিউড রয়েসয়ে কাজ করে। একটা সিন শেষ না হলেও পরের দিনের জন্য ফেলে রাখতে পারে। বাংলায় পয়সা কম, তাড়া বেশি। তাই খুব দ্রুত কাজ গুটিয়ে নিতে হয়।
‘বেগমজান’য়ে জান লড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু টালিগঞ্জের ‘কেলোর কীর্তি’ আর ‘বাদশা দ্য ডন’ কত টাকার ব্যবসা করল সেই অঙ্কটা সৃজিতের ঠোঁটস্থ। বললেন, “টলিউডের পরিচালকরা রিপিটেটিভ হয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা হিট তো গোয়েন্দাই করে চলেছে সবাই। কমেডি হিট তো কমেডি। একটা প্লটে অনেক চরিত্রের ছবি তো সেটাই চলছে। থিম চেঞ্জ করতে হবে। যেমন কৌশিকদা করছে। অঞ্জনদা করছে। বাজারের কথা ভাবলে, আমার তো একের পর এক ‘কাকাবাবু’ করলেই চলে যেত।’’ পুজোতেই রিলিজ ‘জুলফিকার’। অনেক ছবির সঙ্গে আবার লড়াই। ঠিক কতটা ব্যবসা দেবে তাঁর ছবি। ‘বেগমজান’ শেষ করেই হয়তো বা নতুন ছবির কাজে হাত দেবেন। প্ল্যান আছে কাকাবাবু থ্রি ডি করার। সেই ভাবনাও ঘুরছে মাথায়…
‘রাজকাহিনী’তে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
সৃজিতের ‘বেগমজান’য়ে সাতটা গান। সুর দিয়েছেন অনু মালিক। অনুপম রায় এ বার নেই কেন? ‘‘স্পিনিং ট্র্যাকে স্পিনার আর গ্রিন টপে ফাস্ট বোলার। খেলার এটাই নিয়ম। তাই অনুপমকে নিয়ে ভাবিনি। তবে ও কিন্তু তনুশ্রী দত্তের মতো গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স করে চলেছে। এ বার পুরোপুরি সিনেমা করা উচিত ওর,’’ হাসতে হাসতে বললেন পরিচালক।
টানা শ্যুটের মাঝে বিদ্যা হঠাৎ হাজির হচ্ছেন হাটে। ভিড়ের আবদার মেটাতে সেলফি তুলেছেন। অনেক কাঁথাশা়িড় কিনেছেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘‘ডিরেক্টর যদি ছাড়ে রবীন্দ্রভবন যাব।’’ রাতে হোটেলে ফিরে শট নিয়ে আলোচনা করতে করতে সৃজিতের সঙ্গে ‘বনলক্ষ্মী’র প্ল্যানিংটাও সেরে নিচ্ছেন।
বেগমজানের ঘর। বিদ্যা ধুনো দিচ্ছেন। ঘরে ধোঁয়া। আর বিদ্যার প্রোফাইলে বন্দি সৃজিতের চোখ। অ্যাসিসট্যান্ট সৌম্যকে বলছেন, ‘‘উফ, একটু চুপ করে ফ্রেম দেখ। কী লাগছে! ফ্রেমের প্রেমে না পড়লে সিনেমা করা যায় না।’’
এখানে কি শুধুই ফ্রেম?
একটু বুঝিয়ে দিলেন সৃজিত, ‘‘প্রেম তবে নারী নেই, ফ্রেম...প্লিজ আর এ নিয়ে কথা নয়।’’ প্রেম জমবেই বা কী করে? মোবাইল, থ্রি জি কোনও কিছুর সাড়াশব্দ নেই এই মিডল অব নো হোয়্যার জোনে। শুধু বেগমজান আর পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়... মুখোমুখি বসিবার...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy