ছবি: কৌশিক সরকার
নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে সারারাত পার্টি। কোরিয়ান ফুড, আর পাবলিক শো। পুজোর চারটে দিন কেটেছে এ ভাবেই। আমেরিকায় শো করে সদ্য শহরে ফিরেছে ক্যাকটাস। সাক্ষাৎকারের কথা শুনেই বললেন, কবরখানায় যাব। উঠল বাই তো কবরখানায় যাই। গিটার নিয়ে কবরখানার ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে প়ড়লেন সিধু। পাশে বাজি, বুটি, বাম্পি, রাতুল আর দিব্যেন্দু।
• ক্যাকটাস মানেই তো ছন্নছাড়া বেহিসেবির দল। উদ্ভট সব নাম আর সাজপোশাকও। এই নিয়েই দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর…
বাম্পি: পাগল না হলে এ ভাবে গানবাজনা করা যেত না। পাগলামি করতে করতেই পঁচিশ বছর।
বাজি: আমেরিকায় শো করছি, উদ্যোক্তাদের একজন ঢাক এনে বলল, দাদা বাজান! ঢাক বাজালাম... ওদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম। দারুণ অভিজ্ঞতা হল।
রাতুল: আমাদের আনন্দ-কান্না সব আলাদা। বাজিদা ঢাক বাজাচ্ছে। আমরা ফোক মেডলি গাইছি। একবার নয়, দু’বার! দর্শকরা উচ্ছ্বসিত। এটাই আমাদের দুর্গাপুজো।
বুটি: মধ্যরাতে পার্টি করতে করতে ইচ্ছে হল তো বেনারস চলে গেলাম। সংসারী মানুষের মতো আগে-পরে ভাবি না। আমাদের সবার পায়ের তলায় সরষে।
সিধু: নর্ম্যাল ইজ বোরিং! বাইরে গেলে তবেই লেখা আসে, গান আসে কিন্তু! উড়ানের গান আর শিকড়ের টান দুটো নিয়ে থাকি আমরা।
বাজি: সিধু ঝুঁটি বাঁধে। আমারও বড় চুল। তবে মৌরলা মাছটাও খেতে ভালবাসি। আমি আবার সংসারীও। ছেলেকে পড়াই। তবে ক্যাকটাস মানেই অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট সব কিছু।
• তাই বুঝি কবরখানায় আসতে ইচ্ছে হল?
সিধু: কবরখানার মতো শান্তি আর কোথাও নেই। মৃত্যু তো আসবেই কিন্তু তার আগে বাঁচার যে তীব্রতা সেটা এখানেই ফিল করা যায়। আর ক্যাকটাস গাছটা তো সে রকম বাঁচার ইচ্ছে নিয়েই এসেছিল।
বাজি: ক্যাকটাসের প্রথম ফোটো শ্যুট হয়েছিল ৯৪-এ। কবরখানাতেই। ২৫ বছর পরে আজ খুব মনে পড়ছে। শুরুর কথা মনে আসছে...কী পাগলামিই না ছিল ভিতরে!
বুটি: বিকেলের এই সময়টা কিন্তু খুব স্পুকি! এ রকম একটা নিস্তব্ধতায় মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার ভিডিয়োটা মনে পড়ছে। কবর থেকে এই বুঝি সবাই উঠে পড়বে!
দিব্যেন্দু: মাথা খাটিয়ে ভেবে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সিমেট্রি কিন্তু বেস্ট জায়গা।
রাতুল: সবচেয়ে বড় কথা এ রকম একটা জায়গা নিজের মুখোশটা খুলে দেয়...
• মানে সব সত্যি কথা এখানে বলা যাবে, তাই তো?
বাজি: এই রে! আপনি ব্যাপারটা তো অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন...
• এই তো বাজি বললেন সাক্ষাৎকারে সব সময় ভোকালিস্টকে বেশি জায়গা দেওয়া হয়। তাই বাজিকেই আগে জিজ্ঞেস করছি। নিজেদের মধ্যে কতটা ঝগড়া হয়?
সিধু: ঝগড়া লেগেই আছে। ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া় যে সময়টুকু পাওয়া যায় তাতে আমরা একটা গান বানিয়ে উঠতে পারি! এইটুকু।
• কী নিয়ে এত ঝগড়া?
বুটি: ঝগড়া কিন্তু মিউজিকাল ডিরেকশন নিয়ে হয়। আর কিছু না।
দিব্যেন্দু: একটা নোটকে আমরা বিভিন্ন ভাবে দেখি, আর সেটা নিয়েই তর্ক হয়।
বুটি: ‘জলের ধারে’ অ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে, আলাদা করে গানটা শুনে মনে হয়েছে খুব ভাল। কিন্তু পুরো রেকর্ড করার পর একজনের হয়তো ভাল লাগল না। সেটা নিয়েই কথা কাটাকাটি শুরু হয়।
সিধু: ব্যান্ডে কোথাও মানসিক অবস্থানটা একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। খুঁজতে হয় কমন গ্রাউন্ডটা। ওই অবস্থানে রিচ করতে পারি বলে আমরা ছ’জন এখনও আছি। পারষ্পরিক কোনও হিংসে নেই।
• তা হলে পটা চলে গিয়েছিল কেন?
বাজি: পটা ভেবেছিল ও স্টার হয়ে গেছে। ও স্টেজে দাঁড়ালেই হবে। আলাদা করে ক্যাকটাসের কোনও দরকার নেই। দেখুন, ও কিন্তু দুর্দান্ত গাইত এমনটা নয়। ক্যাকটাস-ই ওকে তৈরি করেছে। ভাল ভাল গান গাইতে দিয়েছে। পটা ভেবেছিল ও চলে গেলে ক্যাকটাস ভেঙে যাবে। তাই কখনও হয়? শেষে ওকেই যেতে হয়েছে।
সিধু: দেখুন, গানটা না ওয়ান স্পার্ম, ওয়ান ওভাম দিয়ে তৈরি হয় না। সেটা দিয়ে একটা বিন্দুতে পৌঁছনো যায়। কিন্তু ফার্টিলাইজেশন হয় না। মতবিরোধ হচ্ছিল খুব। পটার সঙ্গে। তাই সরে এসেছিলাম দু’জনে। তবে ব্যক্তিগত শত্রুতা কিছু নেই। অদল-বদল তো হতেই পারে।
• এ তো গেল দলের কথা। রূপম ইসলামের সঙ্গে ঝামেলা হল কেন?
বাজি: রূপম ইসলাম এমনই এক ব্যক্তিত্ব যিনি নেগেটিভ এবং পজিটিভ দুটো পাবলিসিটি করেই নাম কুড়িয়েছেন। আমাদের দলের একজনকে নিয়ে ওর সমস্যা হয়েছিল। তাকে নিয়েই ও বিতর্ক তৈরি করতে শুরু করে। কিছু দেখলেই বিতর্কে ঢুকে পড়া ওর স্বভাব। তাতেও তো ওর নাম হয়। আর মনে করে ও-ই বেস্ট। ওর মতো ভাল আর কেউ গায় না। আসলে যুগটাই পাবলিসিটি-র। একেক জন একেক রকম ভাবে পাবলিসিটি করে।
• আর ‘ভূমি’-র সৌমিত্র? তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের লোক। সেখানে আপনারা কোথায়?
সিধু: আমরা এনটারটেনার। রাজনীতিতে আমরা সরাসরি নেই।
• মানে বেঁকিয়ে আছেন?
বাজি: নচি (নচিকেতা) যেমন আগে লাল ছিল, এখন সবুজ। সৌমিত্র তো অনেক দিন হল সবুজ। এগুলো দেখতে দেখতে ঠিক করেছি আমরা সরকারকে সমর্থন করব, কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে যাব না। এই যে বসিরহাট, বাগুইআটি, নানা মেলায় গানের ডাক পাচ্ছি। সেগুলো তো সব সরকারি অনুষ্ঠান। কিন্তু তার জন্য পলিটিক্সে যোগ দিতে হয়নি। গানটা ভাল করে গাইলেই হল।
• এই দ্রুত বদলের যুগে ক্লাসিক রক গ্রুপ থেকে ক্যাকটাস নিজেদের ভেঙে ফোক, কান্ট্রি মিউজিকে চলে গেল। এটা কি বদল, নাকি কম্প্রোমাইজ?
সিধু: প্রথমে ক্লাসিক রকের রাস্তাতে হেঁটেছি আমরা। কিন্তু যুগের সঙ্গে বদলাতেই হবে। তাই নিজেদের ভেঙেছি। সাইক্লিক রক-এর ধারাটা বাংলা শব্দে আমরাই নিয়ে এসেছি। আমরা ইন্টারন্যাশনাল মিউজিকের জায়গা থেকেই কাজ করি কিন্তু।
• এই জায়গাটাতেই প্রশ্নটা। ক্যাকটাস ক্লাসিক রক দিয়ে শুরু করে হঠাৎ করে ‘তুচ্ছ’-র মতো অ্যালবাম তৈরি করল, যেখানে ক্লাসিক রকের মেজাজটা পাওয়া গেল না।
সিধু: আমরা দেখলাম ক্লাসিক রক পেরিয়ে অল্টারনেটিভ রক আসছে। লোকে সেটাই শুনতে চাইছে।
বাম্পি: সিধুদারা যখন শুরু করেছিল তখন অন্য রকম শ্রোতা ছিল। এখন লোকে বারো মিনিট ধরে একটা গান আর শুনবে না। গানের লেংথ এয়ারপ্লে-তে চার মিনিট। তার মানে চার মিনিটের গানে বারো মিনিটের কনসেপ্ট ভরে দিচ্ছি আমরা।
দিব্যেন্দু: লোকে শোনার চেয়ে গান দেখতে চায়। এ বার যেমন আমরা ভিডিয়ো সিঙ্গল রিলিজ করব।
বুটি: লোকে কিন্তু কনসার্ট দেখতে যায়।
বাম্পি: যাই বানাই ভাবতে হবে কী দেখাচ্ছি।
• কিন্তু ক্যাকটাসের মতো রক ব্যান্ডকে ‘সাধের লাউ’ গাইতে হয়?
বাজি: ‘সাধের লাউ’ এমন একটা গান যেটা আমাদের মতো মানুষের শিক়ড় বাক়়ড়ে ঢুকে আছে।
বুটি: দেখুন, পপুলার মিউজিক আসলে পপুলার মিউজিক। আমাকে ভাবতে হবে পপুলার মিউজিক গাইব, না কি নিজে যে গান তৈরি করব সেটা পপুলার মিউজিক হবে। যে বাচ্চা ছেলেদের ব্যান্ডের দল ‘সাধের লাউ’ গায় তারা কিন্তু ক্যাকটাসের ‘হলুদ পাখি’-ও গায়। এখানেই আমরা সফল।
সিধু: মোদ্দা কথা, নিশ অডিয়েন্স থেকে মাস অডিয়েন্স-এ পৌঁছনোর একটা প্রবল চেষ্টা। ইউএসএ-তে শো করতে গেছি। ধরুন সেখানে আমাদের গান পছন্দ করা ৬০-৭০ জন ছেলেমেয়ে আছে। আবার মিস্টার মজুমদারও আছেন যার আমাদের রক মিউজিক নিয়ে কোনও আইডিয়া নেই। তা হলে তাকে কি আমরা ফিরিয়ে দেব? শুধু রক মিউজিক করি সেই ইগো থেকে? আমাদের বাণিজ্যিক দায়বদ্ধতাও আছে।
• কিন্তু সবাই সব গান গাইবে?
সিধু: না, সেটা নয়। ব্যান্ডের একটা নিজস্ব ধারা তো থাকবেই। কিন্তু ‘মাস’-য়ের কাছেও পৌঁছতে হবে তো।
• ২৫ বছর পর ক্যাকটাস ‘মাস’-য়ের কাছে কতটা পৌঁছল? আজও অনেকে ব্যান্ডের গান মানেই ভাবেন চেঁচামেচি।
বাজি: মধ্যবিত্ত বাঙালি আজও ট্রাই করতে ভয় পায়। সালসা স্যালাড বাড়িতে বানাবে না। ঝাল সুজিই খেয়ে যাবে। ওটা ইউরোপ ট্যুরে গিয়ে অনেক দাম দিয়ে খাবে।
সিধু: বাঙালির অ্যাকসেপটেন্স কম ঠিকই। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন নতুন কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে লোকে বিশ্বাস করে। এই প্রজন্মই আমাদের বলেছে তোমরা এসো, তোমাদের সঙ্গে পাগলামি করব, গিটার বাজাব। নাচব। এখন পাড়ায় পাড়ায় হারমোনিয়ামের জায়গা নিয়েছে গিটার।
বাজি: প্রেসিডেন্সি কলেজ আর যাদবপুর-এর ফেস্ট থেকেই কিন্তু ক্যাকটাস উঠে এসেছে।
• কিন্তু এখন কি ক্যাকটাস-এর সেই চাহিদা আছে?
সিধু: ফিল্ম মিউজিককে এখন বেশি প্রোমোট করা হচ্ছে। কারণ সেখানে প্রোডিউসার নামক ব্যক্তি আছেন। তিনি একটা গানের জন্য সুইৎজার ল্যান্ডে গান শ্যুট করাচ্ছেন প্রচুর খরচা করে। যে গান শ্যুট করতে এত খরচা হচ্ছে সেটার পাবলিসিটির জন্য কত টাকা রাখা আছে একবার ভাবুন! ব্যান্ড নয়, নন-ফিল্ম সব গানই অ্যাফেক্টেড হচ্ছে। কী করব? তবে মানুষ এ বার এমন গান খুঁজবে যার স্থায়িত্ব আছে, আর সেই গান তৈরির জন্য উঠেপ়ড়ে লেগেছে ক্যাকটাস!
• উঠেপড়ে লাগলেও ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ভূমি’ যতটা ছড়িয়েছে ক্যাকটাস ততটা ছড়ায়নি কিন্তু।
সিধু: চন্দ্রবিন্দু-ভূমির মিউজিকটাই এমন যা ‘মাস’-কে অনেক বেশি ছুঁয়ে যায়। আমরা সে ভাবে ‘মাস’-য়ের কাছে যাই না। রক গায় শুনলেই লোকে মুখের দিকে তাকায়। আমার বিনুনির দিকে তাকায়। আর আমরা স্টেজে যতই ড্রাম বাজাই, নিজেরা নিজেদের ড্রাম বাজাই না। এটা খুব জরুরি!
• আচ্ছা, বাংলা ছবি নিয়ে না কি বাজির একটা বক্তব্য আছে?
সিধু: এই রে! এটা বলতে হবে?
বাজি: সিধুই বলুক না।
সিধু: (হেসে) ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক যদি দশ হয়, আমরা দশে কিছুই রিচ করতে পারিনি। ‘তুচ্ছ’–র মতো অ্যালবাম করেও আমাদের কোনও প্রোডিউসার নেই।
• বাংলা ছবি নিয়ে কী বক্তব্য সেটা বলুন না…
সিধু: আমাদের মিউজিক বাঙালি ফিল্মের আধুনিকতার চেয়ে অনেক এগিয়ে।
বাজি: বাংলা ছবি আমাদের ধারা অনুকরণ করে। কিন্তু আমাদের অ্যাপ্রোচ করে না। কেন বলুন তো?
• আপনারা খুব এক্সপেনসিভ হয়তো!
বাজি: না। না। আমাদের ডাকলে, প্রোডিউসারের বিদেশে শ্যুটের চেয়ে কম খরচা হবে। আসলে আমাদের অ্যান্টি লবি কাজ করছে হয়তো!
সিধু: ইন্টারন্যাশনাল রক, বাংলা রক এটার যা রেশিও হবে, ইন্টারন্যাশনাল ছবি আর বাংলা ফিল্ম, এটার রেশিও তার চেয়েও খুব খারাপ!...থাক আর বলছি না।
• আপনাদের পিআর ভাল নয়।
বাজি: (থামিয়ে দিয়ে)জানি। সেটা জেনেই এই কাজে এসেছি। আর এ রকমই থাকব!
দিব্যেন্দু: তবে ভাল গান শুনে লোকে নিজেরাই প্রোমোট করে দিচ্ছে এখন। শুধু প্রো়ডাক্টটা ভাল হলেই হল।
রাতুল: ইন্টারনেটটা যদি আমরা ঠিকমতো ব্যবহার করি তা হলে আর পিআর লাগে না কিন্তু।
সিধু: গান ভাল হলে তা থেকে যায়। যেমন ‘বুদ্ধ হেসেছে’। ‘জলের ধারে’ গানটাও মানুষকে ছুঁয়ে যাবে। এখানে সম্পর্কের কথা আছে।
• আপনাদের জীবনে সম্পর্কটা কেমন? অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্টের জায়গা থেকে একটা পরকীয়ার গন্ধ আছে…
সিধু: (হেসে) আমি সিঙ্গল তাই মিঙ্গল করতে ভালবাসি।
রাতুল: আমি যুগের সঙ্গে চলি। এখন মাল্টিপল রিলেনশনশিপের সময়।
দিব্যেন্দু: আমারও একই হাল (হাসি)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy