Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Tapas Paul

বিতর্কের রেশ ছুঁয়ে তাপসের অকালপ্রয়াণ

মৃত্যু ভুলিয়ে দিয়েছে অনেক কিছুই। রাজনীতির দু’টি যুযুধান শিবিরও যেমন এখন কার্যত তাপস-বন্দনায় সরব।

তাপস পাল।

তাপস পাল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:২১
Share: Save:

‘দাদার কীর্তি’র গোবেচারা নিপাট ভাল ছেলেটি হয়ে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি তিনি। বরং গত কয়েক বছরে তাঁর জীবনের চিত্রনাট্য উল্টো দিকে ঘুরেছে চমকপ্রদ ভাবেই।

রাজনৈতিক সভায় ‘ধর্ষণের হুমকি’ দিয়ে অপযশ কিংবা রোজ়ভ্যালি-কাণ্ডে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআইয়ের জিম্মায় দীর্ঘ হাজতবাস— নানা বিতর্কে জড়িয়েছে প্রাক্তন সাংসদ তাপস পালের জীবন। বেশ কয়েক বছর ধরে স্নায়ুর জটিল সমস্যা, সুগার, হার্টের গোলমালেও ভুগছিলেন তিনি। তবু শেষ অঙ্ক যে এতটা এগিয়ে এসেছে তা সম্ভবত কেউই আঁচ করেননি। সোমবার গভীর রাতে সেই জীবননাট্যে যবনিকাপাত। মুম্বইয়ের হাসপাতালে মাত্র ৬১ বছরে বয়সে চলে গেলেন উত্তমকুমার-পরবর্তী যুগে টালিগঞ্জের ডাকসাইটে নায়ক, দু’বারের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাপসের স্ত্রী-কন্যা নন্দিনী ও সোহিনী তাপসের দেহ কলকাতায় নিয়ে আসেন। আজ, বুধবার টালিগঞ্জের ফিল্ম স্টুডিয়ো, রবীন্দ্রসদনে কিছু ক্ষণ তাঁর দেহ রাখার কথা। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তাপসের শেষকৃত্য হবে।

২০০৯-এ কৃষ্ণনগরে প্রথমবার সাংসদ হয়ে তাপস যাঁকে ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’ বলে বার্তা দেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিনেতা-সাংসদ তাপসের মৃত্যুতে অভিনয় ও রাজনৈতিক জগতে অপূরণীয় ক্ষতি হল।’’ ফেসবুকে শোক জানান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

মৃত্যু ভুলিয়ে দিয়েছে অনেক কিছুই। রাজনীতির দু’টি যুযুধান শিবিরও যেমন এখন কার্যত তাপস-বন্দনায় সরব। মঙ্গলবার ‘দাদার কীর্তি’র কেদারের মৃত্যুসংবাদে ঘুম ভাঙার পরে এই মৃত্যু কেন এত ত্বরান্বিত হল সেই চর্চাতেই মেতেছে আমবাঙালি। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার প্রতিক্রিয়াতেই সেটা স্পষ্ট। কলকাতার মেয়র ও মন্ত্রী তৃণমূলের ফিরহাদ হাকিম (ববি) যেমন বলেছেন, ‘‘উনি (তাপস) বড় ভাল মানুষ ছিলেন। কেন্দ্রের বদলার রাজনীতির জেরে মানসিক চাপেই শেষ হয়ে গেলেন।’’ অন্য দিকে, বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘তাপসের অভিনয়-জীবন এবং জীবন অসময়ে ফুরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে ভাবতে হবে কেন এটা হল! কাদের সঙ্গে তাপস রাজনীতিতে ছিলেন?’’ বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর মতে, ‘‘তাপস পাল রাজনীতির লোক ছিলেন না। তাঁর জনপ্রিয়তাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। যে ভাবে তিনি বিতর্ক এবং অভিযোগে জড়িয়েছিলেন, তাতে অসৎসঙ্গে সর্বনাশ কথাটা হয়তো বলা যায়।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের বক্তব্য, ‘‘অসময়ে, কষ্টদায়ক ভাবে তাপসকে বিদায় নিতে হল। যাঁদের হয়ে রাজনীতি করতে গিয়েছিলেন, তাঁরা যে পরিস্থিতিতে তাঁকে ফেলেছিলেন, তাপস হয়তো তারই শিকার।’’

তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান-পর্বেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাপসের পদার্পণ অধুনালুপ্ত আলিপুরের বিধায়ক হিসেবে। দু’বারের বিধায়ক তাপস, ২০০৯ এবং ২০১৪য় কৃষ্ণনগরের সাংসদও নির্বাচিত হন। এর পরেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিতর্কের সূত্রপাত। অর্থলগ্নি সংস্থা রোজ়ভ্যালির সঙ্গে জড়িত তাপস পাল বেআইনি ভাবে অনেক টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ১৩ মাস ধরে ২০১৮র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভুবনেশ্বরে সিবিআই হেফাজতে তিনি বন্দিও ছিলেন। তার পরে জামিন পান।

পারিবারিক সূত্রের খবর, জানুয়ারির শেষে মুম্বইয়ে মেয়ের কাছে যাবেন বলে কলকাতা ছাড়েন তাপস। গত ৩ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ হয়ে মুম্বইয়েই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। তাপস সেরে উঠছিলেন। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র থেকে বার করাও হয়েছিল। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সব শেষ।

‘‘ভাবিনি এ ভাবে সব শেষ হবে।’’— দুপুরে মুম্বই থেকে ফোনে বলছিলেন তাপসজায়া নন্দিনী। চন্দননগরের প্রবর্তক বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণি থেকে তাপসের সহপাঠী-বন্ধু শান্তনু পাল ওরফে বাবুও শোকে বিহ্বল। মাস দুয়েক আগে ভুবনেশ্বরে কোর্টে হাজিরার পরে তাপসের ডাকে ওঁর সঙ্গে পুরীতে জগন্নাথ-দর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। ‘‘বলেছিল, দেড় মাস বাদে কলকাতা ফিরবে। আবার অভিনয় শুরু করবে।’’— রুদ্ধকণ্ঠে বলছিলেন শান্তনুবাবু।

এ দিন সকাল থেকে সংবাদমাধ্যমে টালিগঞ্জের চিত্রজগতের বিভিন্ন প্রজন্মের তারকাদের শোকোচ্ছ্বাস। গোলাপকাঁটায় জর্জরিত নায়ক নয়, সহজ-সরল ঘরোয়া তাপসকে নিয়েই তাঁরা মুখর। তবে ২০১৪ সালে নেতা তাপস পালের মুখে প্রতিপক্ষের বাড়ির মেয়েদের হুমকির সংলাপও জনতার স্মৃতিতে টাটকা থেকে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tapas Paul Celebrity Death Mamata Banerjee TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE