Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিদেশি বিমান-ভোজে পোস্তবড়া, মালাইকারিও

বুদ্ধদেব বসুর সেই আক্ষেপ এখন অবান্তর। তাঁর মতো অনেকেই একদা ভাবতেন, বাঙালি রান্না হল অন্তঃপুরলক্ষ্মী! কিন্তু তা ব্যবসার হাটে অচল। এই ২০১৪-য় দাঁড়িয়ে তাঁরা নির্ঘাত তাজ্জব হবেন। গত দেড় দশকে কলকাতার রেস্তোরাঁয় বাঙালি পদের জয়জয়কারই শেষ কথা নয়!

সুনন্দ ঘোষ ও ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৪ ০২:১১
Share: Save:

বুদ্ধদেব বসুর সেই আক্ষেপ এখন অবান্তর।

তাঁর মতো অনেকেই একদা ভাবতেন, বাঙালি রান্না হল অন্তঃপুরলক্ষ্মী! কিন্তু তা ব্যবসার হাটে অচল। এই ২০১৪-য় দাঁড়িয়ে তাঁরা নির্ঘাত তাজ্জব হবেন।

গত দেড় দশকে কলকাতার রেস্তোরাঁয় বাঙালি পদের জয়জয়কারই শেষ কথা নয়! দেশ-বিদেশের শহরেও সর্ষে-পাঁচফোড়নের খাঁটি বাঙালি ঝাঁঝ রসিকমহলে আলাদা মাত্রা পাচ্ছে। এ বার মাটির পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশপথেও বাংলার স্বাদ-গন্ধ তার পতাকা মেলে ধরছে।

যাত্রী আপ্যায়নের প্রতিযোগিতায় কোনও বিমানসংস্থার টেক্কা সর্ষে মাছ। কারও তুরুপের তাস পোস্তর বড়া কি লুচি-আলুভাজা! বিদেশ-বিভুঁয়ে পাড়ি দেওয়া বাঙালির মন জয়ে বিমানে রীতিমতো এলাহি আয়োজন।

আরব সাগরের তীরে দুবাইয়ের হেঁশেলে অবধি খাঁটি বঙ্গীয় রেসিপি মেনে তৈরি হচ্ছে সর্ষে মাছ। কলকাতা-ভেটকির অভাবে সামুদ্রিক স্যামনেই চেষ্টা চলছে। কলকাতা থেকে যাতায়াত করা এমিরেটস বিমানসংস্থার যাত্রীদের পাতে মাঝ আকাশে পরিবেশন করা হচ্ছে সেই মাছ।

পিছিয়ে নেই সিঙ্গাপুর, তাই, কাতারের মতো অন্যান্য বিদেশি বিমানসংস্থাও। কলকাতা থেকে যাতায়াত করা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মেনুতে ডাল-সব্জির পাশে বাঙালির প্রিয় মাছও রয়েছে। তাই এয়ারওয়েজের উড়ানে থাকছে কখনও ভেটকি, কখনও চিংড়ির মালাইকারি। কাতার এয়ারওয়েজের যাত্রীরা পেতে শুরু করেছেন লুচি-আলুভাজা। সিল্ক এয়ারের যাত্রীরা কামড় মারছেন পোস্তর বড়ায়।

সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইন্স, লুফৎহানসা, সুইস এয়ারের মতো যে সমস্ত বিদেশি বিমানসংস্থা কলকাতা থেকে বিমান চালায় না, তারাও নিজেদের মেনুতে বাঙালি খাবার রাখতে শুরু করেছে। কারণ, কলকাতা থেকে এই সব সংস্থার উড়ান না থাকলেও দিল্লি-মুম্বই থেকে অনেক বাঙালি যাত্রীই আকাশপথে তাদের আতিথেয়তা নেন। এ সব ক্ষেত্রে বিমান ছাড়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে নিজের পছন্দের খাবারের কথা জানিয়ে রাখলে সেই মতো খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে মাঝ আকাশে।

বিমানে ভারতীয়দের রুচিমাফিক খাবার পরিবেশনের দস্তুর অবশ্য নতুন কিছু নয়। দেশি-বিদেশি সমস্ত বিমানসংস্থা ইতিমধ্যেই সে পথে হেঁটেছে (অথবা বলা যায় ‘উড়েছে’)! তবে এত দিন আমিষ-নিরামিষে উত্তর ভারতীয় খানা বা দক্ষিণী ইডলি-বড়ার প্রাধান্যই চোখে পড়ত। ভারতীয় আঞ্চলিক রুচির দিকে ততটা খেয়াল ছিল না বিমানসংস্থাগুলির। ক্রমশ সেই ধারাই পাল্টাচ্ছে। মুম্বই থেকে বিভিন্ন উড়ানে গুজরাতি যাত্রীদের কথা ভেবে আকছার শাক-ঢোকলার দেখা মিলছে। আবার কেরল থেকে পশ্চিম এশিয়াগামী বিমানগুলিতে মালয়ালি স্টু-আপ্পামের রমরমা। সেই ভোজ-মানচিত্রেই এ বার ঠাঁই পাচ্ছে বাংলা।

বলে রাখা যাক, এত দিন এয়ার ইন্ডিয়ার কলকাতা থেকে যাতায়াত করা উড়ানে বড়জোর সকালে রাধাবল্লভী-আলুর দমের দেখা মিলত। কিংবা দুর্গাপুজোর চারটে দিন ব্যতিক্রম হিসেবে বাঙালির প্রিয় কষা মাংস বা লাউ-চিংড়িরা ঠাঁই পেত এয়ার ইন্ডিয়ার মেনুতে। এখন কিন্তু বছরভরই ভোজের পাতে বাঙালিয়ানায় জোর দিতে চলেছে বিদেশি বিমানসংস্থাগুলি।

“বাঙালি রান্নার জন্য অবশ্যই এ এক স্বীকৃতি,” বলছেন একেলে বাঙালি খানার একটি সর্বভারতীয় রেস্তোরাঁ চেন-এর কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আশা, পাতুরি-মালাইকারি কিংবা বাঙালি চচ্চড়ি অবাঙালি অতিথির কাছেও প্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তবে বিমানে শুক্তো-চচ্চড়ি-মাছ পরিবেশনের সময়ে খাইয়ের স্বাচ্ছন্দ্যটুকুও দেখা উচিত। অঞ্জনের মত, “হয়তো অনেকেই একটু শুকনো-শুকনো চাখতে পছন্দ করবেন। দরকারে রান্নার চেনা আদলে পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলের মনটা খোলা রাখতে হবে।”

তবু ভেবে শিহরণ জাগে। আন্তর্জাতিক উড়ানে বাঙালি ঘরানার সর্ষে মাছ থেকে পোস্তর বড়া! এই সমাদরের রহস্যটা কী?

আসলে, এখনও দল বেঁধে ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে কুলু-মানালি বা রাজস্থানে বেড়াতে গেলে বাঙালি মধ্যবিত্ত

আগাম বলে রাখেন, নিয়মিত মাছের ঝোল বা বৈকালিক তেলেভাজাটা চাই-ই চাই! বিমানসংস্থাগুলির দাবি, বাঙালি বিমানযাত্রীদের চাহিদাও খুব আলাদা নয়।

সেটাই জানাচ্ছেন তাই এয়ারওয়েজের ম্যানেজার ভিচায়া সিংতোরোজ। তিনি আশাবাদী, খাইয়ে খুশি করতে পারলে বাঙালি নির্ঘাত পরের বার ওই সংস্থার উড়ানকেই বেছে নেবে। জোরদার সমীক্ষা চালিয়েছেন এমিরেটসের কর্তারাও। সংস্থার এয়ারক্রাফ্ট কেটারিং-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রবিন প্যাডগেটের কথায়, “বাঙালিরা খাবারের মেনুকে ভীষণ গুরুত্ব দেন। তাঁদের জন্য রান্নার ঘরোয়া স্বাদও আনার চেষ্টা করছি!”

বিমানবন্দর সূত্রের খবর, কলকাতার তাজ এবং ওবেরয় কেটারিং থেকে খাবার তোলে সিল্ক এয়ার, ড্রাগন এয়ার, ভুটান ও কাতার এয়ারওয়েজ। মুরগির ঝোল, ধোকার ডালনা, ছানার পায়েস পাওয়া যায় তাদের মেনুতে। কিন্তু এমিরেটস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, তাই এবং

চায়না ইস্টার্ন নিজের নিজের দেশ থেকে খাবার তুলে নিয়ে আসে। কলকাতার ব্যবসায়ী সৈকত বসু, সুমন ঘোষালরা খেয়ে খুশি হলেও বলছেন, “মাছটা কলকাতার হলে কিন্তু স্বাদ আরও খুলত।”

“হৃদয়ের চাবিটা তো উদরের পথ ধরেই মেলে,”--- হাসছেন বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ রাম রায়। তবে বাঙালি রান্নাকে নিয়ে কিছুটা অবিশ্বাসের সুরও কাজ করছে তাঁর মধ্যে। বলছেন, “আজকাল দুনিয়াসুদ্ধ বেশির ভাগ লোকই তো বার্গার-স্যান্ডউইচে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তরুণদেরও বাঙালি রান্না নিয়ে আদিখ্যেতা কম!”

যুগ বদলের এই চ্যালেঞ্জ সামলে ঐতিহ্যের বাঙালি রান্না দিয়ে কি বাজিমাত করতে পারবে বিদেশি বিমানসংস্থাগুলি? উত্তর দেবে সময়।

মুম্বইয়ের এক অনুষ্ঠানে হাজির শাহরুখ খান। এএফপি-র ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bengali food in flight sunanda ghosh riju basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE