‘রাজ্য জুড়ে বন্যায় বলি’— আধ ঘুম অবস্থায় কফি মাগে চুমুক দিয়ে চোখে পড়ল খবরের কাগজের হেড লাইন। দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা যেন বেড়ে চলেছে। কোথাও বজ্রপাত, কোথাও দেওয়াল চাপা পড়ে, কোথাও জলে ডুবে, অব্যাহত দুর্যোগের জেরে মৃত্যু। কোনও জায়গায় জলের তোড়ে তলিয়ে যাওয়া স্কুলছাত্রের দেহ মিললেও খোঁজ মিলছে না বহু মানুষের। রাস্তায় বেরোলে নজরে পড়ে জমা জলের কারণে মানুষের দুর্ভোগ।—কিছু জন গাড়ি ঠেলছে, এমন বৃষ্টিতে ছাতা কোনও কাজেও লাগছে না, সুপসুপে জামায়, কপালে অজস্র ভাঁজ নিয়ে কোনও রকমে জল ঠেলে অফিস যাচ্ছে। তার পর....নিশ্চিত জ্বর। যে ঋতুটাকে সব চেয়ে ভালবাসতাম, আঁকড়ে রাখা মধুর স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে শিথিল হতে লাগল। গাড়ির জানালা থেকে দেখলাম পাশের বাসের একটা ছেলেকে। ভেজা চুল, জামা, চোখের তলায় কালি, হাতে একটি ফাইল নিয়ে বারে বারে কী যেন দেখছে...। হয়তো কোনও কাজের ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে।
গল্ফ ক্লাবের বাড়ির জানালায় ভর দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দেখছিলাম। মনে পড়ে গেল লক্ষ্মণের কথা। এমনই ঘোর বর্ষায় আমাদের বাড়ির উল্টো ফুটপাথের গ্যারেজে সামনে হঠাৎই জায়গা বেঁধে নিয়েছিল সে কিছু মাসের জন্য। বাইশ-তেইশ বছরের ছিপছিপে গড়ন, লম্বা দাড়ি গোঁফ, স্নিগ্ধ চেহারা, অদ্ভুত ভাসা ভাসা চোখ—ছেলেটাকে দেখেই কেমন মায়া পড়ে গিয়েছিল। ঝোলায় কিছু খাতাপত্র, কী যে সব সময় লিখত? আবার নিজের খেয়ালেই একা একা নিজের সঙ্গেই কথা বলত আর খিলখিলিয়ে হেসে উঠত। আমার কৌতূহলী মন দেখতে যেত তার লেখা। কিন্তু কাছে গেলেই ও খাতা বন্ধ করে উদ্দেশ্যহীন মেজাজে হেঁটে চলে যেত। কত বার জানার চেষ্টা করেছি ওর নাম। জিজ্ঞেস করতে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। আবার নিজের ঘোরে খাতায় মন দিয়ে কী আঁকত। আমাদের বাড়ি থেকে ওর খাবার পাঠানো হত রোজ। বর্ষাকালে ওর রক্ষার জন্যে ওয়াটার প্রুফ বাথরুম কার্টেনস মা দিয়েছিলেন যাতে ও জড়িয়ে থাকতে পারে। ছাতা দিলে নিমেষে হারিয়ে যেত।
মনে পড়ে সেই বার ভয়ঙ্কর শীত পড়েছিল। খোলা আকাশের নীচে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে, কম্বল দেওয়া হয়েছিল ওর জন্য। কিন্তু দুদিন অন্তর দেখতাম যে কে সেই! কুর্তা পায়জামায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে। এই যে দিলাম গেল কোথায়? কেউ হয়তো টেনে নিয়েছে.....বা ওই হয়তো অন্য কোথাও ছেড়ে এসেছে, কে জানে। একদিন রানে ওর জন্য বেশ কয়েকটা কম্বল নিয়ে হাজির। একটা হোমে রাখতে সাজেস্ট করল, যাতে ওর স্থায়ী সমাধান হয়। বাঃ তাহলে তো বেশ! কিন্তু ফোন করব কাকে? শুনেছি সন্দীপ ভুতোরিয়া অনেক সোশ্যাল সার্ভিস করেন। যেহেতু তখন তার সঙ্গে তেমন আলাপ ছিল না, সংকোচে ফোনে পুরো ব্যাপারটা বলতেই, উনি বললেন আমাদের তার জন্য একটা পুলিশ পারমিশন দরকার। তখনকার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দার সঙ্গে উনি যোগাযোগ করিয়ে দেন। আমার অনুরোধে পরের দিনই জিপে ওকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি হোমে। ফোনে একজন মহিলার গলা ‘‘কোয়েল তোমার ওই ছেলেটির আমাদের সাইকিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টে চিকিৎসা চলছে।’’—গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগল। কিছু কথাতেই জানতে পারলাম হোমের নাম ‘ঈশ্বর সংকল্প’। এবং তার কিছু মাস আগেই তাদের নাইট শেল্টার ফর ওম্যান, চেতলা শাখার ওপেনিংয়ে আমি গিয়েছিলাম। শুনে স্বস্তি পেলাম যে একটি অত্যন্ত নির্ভরয়োগ্য স্থানে ওর জায়গা হয়েছে। সংস্থার কত্রী সর্বাণীদির সঙ্গে যোগাযোগে জানতে পারলাম অ্যাকিউট সিজোফ্রেনিক কেস। চিকিৎসা চলছে, কিন্তু সময় লাগবে। ওর খবর নিতেই প্রায়ই ফোন করতাম। কিন্তু মাস যেতেই শুনলাম লক্ষ্মণ অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এবং তার বাড়ির একটি বিক্ষিপ্ত ঠিকানা দিয়েছে। পুলিশের উপকারে জানলাম ওর বাসস্থান জব্বলপুর। বাড়ির লোককে খবর দিতেই তার দাদা এবং দিদি চলে এলেন তাদের দারুণ আদরের ভাইকে নিয়ে যেতে। ওদের মুখেই শুনলাম লক্ষ্মণের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা।