Advertisement
E-Paper

টিকে থাকতে অচল পয়সার জোরেই বুক বাঁধছে চিৎপুর

সাদা টাকা দেখা যাচ্ছে না। কালো টাকা রাখা যাচ্ছে না। গোলাপি টাকা ভাঙানো যাচ্ছে না। বলছেন গ্রামের ছেলে সঙ্কল্প। যিনি ক্যানসারগ্রস্ত মায়ের কেমোথেরাপি করাতে না-পেরে ফিরে যাচ্ছেন।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১৮

সাদা টাকা দেখা যাচ্ছে না। কালো টাকা রাখা যাচ্ছে না। গোলাপি টাকা ভাঙানো যাচ্ছে না।

বলছেন গ্রামের ছেলে সঙ্কল্প। যিনি ক্যানসারগ্রস্ত মায়ের কেমোথেরাপি করাতে না-পেরে ফিরে যাচ্ছেন। রেখে যাচ্ছেন প্রশ্ন— স্যার, এখন আমার মা-টা মরে গেলে কে দায়ী হবে? কালো টাকা, সাদা টাকা, না গোলাপি টাকা?

প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে কাজের মেয়ে চম্পাও। তার বাচ্চারা খিদের জ্বালায় কাঁদছে। চম্পা বলছে, ‘‘বাবু, আমার তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই! ওদের কি অচল নোটগুলো খাওয়াব? বাচ্চাদের খিদে তো কালো নোট, সাদা নোট চেনে না!’’

কিন্তু হাসছেন এক জন। তিনি ঠিকাদার রামলাল শেঠ। স্কচের পেগ হাতে অট্টহাসি— ‘আরে আমরাই দেশটা চালাই, সুযোগে বিদেশে পালাই/ আমি এক শিল্পপতি/ তাই আজ পাক্কা সতী/ লাইনে দাঁড়াস তোরা/ যত সব সর্বহারা/ আমার কালো নোট আমারই হাতে/ টান পড়েছে তোদের পাতে... ।’

আর চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার ঘুপচি অফিসে বসে এই সব কান্না-হাসির কিস্সা শুনতে শুনতে উত্তেজনায় ঘুষি পাকাচ্ছেন দুঁদে প্রযোজক কনক ভট্টাচার্য। শোনাচ্ছেন পালা লেখক মঞ্জিল বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি কিনা প্রযোজকের ফরমাসমাফিক সদ্য তাঁর কাহিনি ফেঁদেছেন।

পালার নামও ঠিক হয়ে গিয়েছে। ‘ভালমানুষের ভাত নেই।’ প্রযোজক লোগো ডিজাইন করার হুকুম দিয়েছেন। নামের সঙ্গে মানানসই বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইনও মুখে মুখে রেডি। মঞ্জিল খসখসিয়ে লিখে চলেছেন— কালো টাকা যাদের ঘরে, তারা সুখে বাস করে/ লাইনে দাঁড়ায় গরিব মানুষ, শিল্পপতি ওড়ায় ফানুস/ খিদে পেটে চোখের জলের, প্রতিবাদ হোক নোট বদলের/ কালো টাকা রইল কালো, জনজীবন স্তব্ধ হলো।

শুনে কনক বলছেন, ‘‘দারুণ গান! সুরে ফেললেই জমে একেবারে দই!’’

অগ্রহায়ণের শেষে মালদহ, শিলিগুড়ি, কোচবিহারে কনকবাবুদের ‘খাঁচায় বন্দি ভালবাসা’র টানা বায়না ছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। নায়েক আালিভাই ফোনে কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলেছেন, ‘‘কী করে টাকা পাঠাবো দাদা? ক্লাবের ছেলেরা লাইনে দাঁড়িয়ে সংসারের টাকা তুলবে? না পালার? দু’হাজারের বেশি তো তুলতেও পারছে না!’’ অগ্রিম নিয়েও শো বাতিল হচ্ছে দেখে কনকবাবুর মাথায় খেলেছে নতুন আইডিয়া। নোট বাতিল পর্ব নিয়েই হোক না নতুন পালা!

বস্তুত সেই জ্যোতিবাবু বা সাদ্দাম হুসেনের জমানা থেকেই বাংলার যাত্রা সমকালীন জীবনের আলোয় আলোকিত। ২০১০-এ, বাম শাসনের শেষ লগ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে-বিপক্ষে যেমন পালার ধুম পড়ে গিয়েছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, তাপসী মালিক— সব তখন উঠে এসেছে যাত্রার মঞ্চে। মমতা-জমানায় সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে পালা না-হলেও দু’বছর আগে লোকসভা ভোটের পরে নেমেছিল ‘দিদি তোমার জবাব নেই!’

চিৎপুরে এক অপেরার সুনসান অফিস। —নিজস্ব চিত্র।

একই ভাবে এ বার নোট-নাকাল দেশের কাহিনি। যেখান থেকে যা পারছেন, কুড়িয়ে নিচ্ছেন কাহিনিকার। ‘প্রতিবাদী’ নায়ক বিবেক মুকুজ্জের মুখে বসিয়েছেন মাখো মাখো সংলাপ— ‘এটাই ভারতবর্ষ। যেখানে নোট বাতিলের গেরোয় মেয়ের বিয়ে দিতে না-পেরে সাধারণ পিতা আত্মহত্যা করে। আবার সেখানেই পাঁচশো কোটি খরচ করে প্রভাবশালী নেতার মেয়ের বিয়ে হয়। এক জায়গায় হয় মৃতদেহ সৎকার, অন্য জায়গায় অতিথি সৎকার!’

কনকবাবুদের নায়ক বিবেক কার্যত পালার বিবেক। মঞ্জিলের কথায়, ‘‘পাড়াগাঁয়ে দু’টো ক্যারেক্টার খুব খায়। নির্ভীক সাংবাদিক আর সৎ পুলিশ অফিসার!’’ ঠিক হয়েছে, বিবেক হবেন এক সাংবাদিক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখে ফ্যাসাদে পড়েছিলেন। নোট-কাণ্ডের বাজারে ফের কলম ধরছেন। হবু শ্বশুর টাকা তুলতে না-পেরে মারা যাওয়ায় নিজের বিয়েও ভেস্তে গিয়েছে। নায়ক-নায়িকা মিলে বেরিয়ে পড়েছেন দুর্দশার ছবি তুলে ধরতে। কনকবাবুর দৃপ্ত ঘোষণা, ‘‘যা হবে হোক। নোট-নীতি ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলের অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্কে পাচারের কথা স্ক্রিপ্টে আলবাত থাকবে। লাইনে দাঁড়িয়ে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু, চাষির সুইসাইড, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর দুর্গতি— কিচ্ছু বাদ দেব না।’’ মঞ্জিলের উপলব্ধি, ‘‘প্রতিবাদটাই গল্প। এ হল প্রতিবাদের বই।’’

এমনিতে চিৎপুরে পালা নামানোর গড়পড়তা খরচ কম-বেশি ৫০ লাখ। খরচা তুলতে অন্তত আশিটা শো চাই। ফি শোয়ে হাজার তিনেক লোক না-হলে উদ্যোক্তাদেরই বা পড়তায় পোষায় কী করে? অথচ নোট বাতিলের ধাক্কায় সব হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে। যাত্রাপাড়ার বাতাসে খবর: পুরুলিয়ায় এক পার্টি আঠারো হাজার টাকা লস খেয়েছে। কোন অপেরা নাকি উত্তরবঙ্গে শো না-করেই ফিরেছে। এ পেশায় সব নগদে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে পুরনো নোট নিলেও শিল্পীরা অনেকে ভয়ে মাসমাইনে পর্যন্ত তুলছেন না!

এ হেন মন্দার সময়ে আশার ঝিলিক কিন্তু বাতিল নোটই। ‘বাসা ভাঙা ভালবাসা’য় লেখক-নায়ক অনল চক্রবর্তী যেমন ভিলেনের মুখের গান পাল্টে দিয়েছেন। প্রথমে ছিল— ‘টাকা টাকা টাকা শুধু উড়ছে/ লোকজন সারাক্ষণ হইহই শুধু করছে।’ এখন হয়েছে— ‘পাঁচশো হাজার শুধু উড়ছে, লোকজন সারাক্ষণ ব্যাঙ্কে মাথা শুধু ঠুকছে!’ শুনে আসানসোলের চেলিডাঙা থেকে রঘুনাথপুরের চিনপিনা হেসে গড়াগড়ি। ‘বৃদ্ধাশ্রমে কাঁদছে বাবা-মা’ পালায় ‘বাবা’ বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীও ডায়ালগ পাল্টে বলছেন, ‘‘এই সমাজে বাবা-মা হলেন অচল পাঁচশো-হাজারের নোট!’’

তবে নোট-কাণ্ড নিয়ে আস্ত পালা নামানোর উত্তেজনা আলাদা। যার আঁচে কনকবাবু রীতিমতো ফুটছেন। ‘‘এখন বায়না ফস্কালেও সিজনের দু’-তিন মাস হাতে আছে। প্রধানমন্ত্রীও জানেন, এ ঝামেলা সহজে মেটার নয়। দিন কুড়ির মধ্যে সব নামিয়ে ফেলব।’’— প্রত্যয়ী প্রযোজক। তাঁর আশ্বাস, কাস্টিংয়েও চমক থাকবে।

নোটের চোটে ভেঙে পড়াই শেষ কথা নয়। ঝোপ বুঝে পাল্টা কোপ মারতেও চিৎপুর তৈরি।

demonetizatisation issue Chitpur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy