সব্যসাচী
কী পোশাক পরব আর কী ভাবেই বা নিজের উপস্থাপন করব— পুরোটাই নির্ভর করে নিজের পছন্দের উপর। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যখন সর্বত্র লড়াই করে সমান অধিকার কেড়ে নেওয়ার হইহই রব উঠেছে, তখন বিদেশে একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়লেন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়।
সম্প্রতি হার্ভার্ড ইন্ডিয়া কনফারেন্সে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের সব্যসাচী বলেন, ‘‘যদি কেউ আমাকে বলেন যে, আপনারা জানেন না কী ভাবে শাড়ি পরতে হয়, তা হলে বলব, আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। এটা সংস্কৃতির অংশ। প্রত্যেকেরই উচিত নিজেদের সংস্কৃতির পাশে দাঁড়ানো।’’
আর ঠিক এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, শাড়িই কি ভারতীয় নারীর পরিচায়ক? শাড়ি না পরলে কি সংস্কৃতিকে অপমান করা হয়?
সব্যসাচীর শাড়িতে রানি এবং দীপিকাও মজেছেন
ওই অনুষ্ঠানটিতে সব্যসাচী আলোচনা করেছিলেন শাড়ি পরার সমস্যা নিয়ে। বলেন, গোটা বিশ্ব শাড়ির মাধ্যমেই ভারতীয় নারীদের চিনতে পারেন। তাঁর মনে হয়, পাশ্চাত্য পোশাকের প্রতি ঝুঁকে, নিজের সংস্কৃতি ভুলতে শুরু করে অনেক ভারতীয় নারী-পুরুষ ছিন্নমূল হয়ে যাচ্ছেন। সব্যসাচীর বক্তব্য, শাড়ি পরা আদতে শক্ত ব্যাপার নয়। বলেন, ‘‘শাড়ি পরে নারীরা যুদ্ধও করেছেন। মা-ঠাকুমারা শাড়ি পরে রাতে ঘুমোতে গিয়েছেন। সকালে ওঠার পর তাঁদের শাড়িতে বিন্দুমাত্র ভাঁজও পড়ে না।’’ শুধু শাড়ি নয়, সব্যসাচী প্রসঙ্গ তোলেন ধুতি পরা নিয়েও। বলেন, ‘‘ভারতীয় নারীরা তবু শাড়িকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ধুতি এককথায় মৃত।’’
এখানেও বিতর্ক। শাড়ি পরতে না পারা যদি লজ্জাজনক হয়, তা হলে ধুতির চল প্রায় উঠে যাওয়া সত্ত্বেও সব্যসাচী কেন পুরুষদের প্রতি মন্তব্য করলেন না? অনেকে এতে খুঁজে পেয়েছেন লিঙ্গ-বিভাজনের গন্ধ! কমেডিয়ান তন্ময় ভট্ট টুইট করেছেন, ‘হয়তো কিছু তরুণী শাড়ি পরছেন না, কারণ আপনি সেই শাড়িগুলো বিক্রি করছেন আশি হাজার টাকায়!’
এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘‘একটা বিষয় হয়— এখনকার জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে রোজ শাড়ি পরা হচ্ছে না। এটায় সমস্যার কিছু নেই। আর উল্টো দিকে অন্য বিষয়টা হল— অনেকেই গর্বের সঙ্গে নাক উঁচু করে বলেন, আমি ওই শাড়ি-টাড়ি পরতে পারি না। সে ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা ঐতিহ্যকে অপমান করা হয়। আর তা হলে, বিষয়টা দুঃখজনক বটেই।’’
বিতর্কের প্রত্যুত্তরে সব্যসাচী জানিয়েছেন, ‘‘পোশাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যে উদ্যাপনের কথা আমি বলেছিলাম, সেটা নারীবাদী বিতর্কে পরিণত হয়ে গেল। এটা লিঙ্গভিত্তিক বিষয় নয়। প্রসঙ্গটা শাড়ি নিয়ে বলে উঠে এসেছে মহিলাদের কথা। নারীদের স্বাধীনতা বা কী পরতে চান— তা নিয়ে মন্তব্য করিনি।’’ প্রসঙ্গত, ধুতির চলকে মৃত বলা আসলে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত... সেটাও স্পষ্ট করে দেন ডিজাইনার। বলেন, তিনি লক্ষ করেছেন, অনেক মহিলাই যাঁরা বলেন যে শাড়ি পরতে পারেন না, তাঁদের কণ্ঠস্বরে বেশ গর্ব থাকে। সেটা তাঁর কাছে ঐতিহ্যের অপমান।
কৌশিকী চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এটা জেন্ডার বায়াসড বক্তব্য বলে মনে করছি না। কথা বলার সময় তো অত মেপে আমরা কথা বলি না। কথা বলতে গিয়ে যে ভাবটা আমাদের মধ্যে আসে, সেটাই প্রকাশ করার চেষ্টা করি। ধুতি মৃত— এই কথা বলার মধ্য দিয়েই উনি প্রকাশ করে ফেলেছেন ওঁর হতাশা। কোথাও বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাঙালি এবং ভারতীয় হয়েও ধুতির চলটা ধরে রাখতে আমরা অক্ষম। এবং ‘শেম অন ইউ’ বলার মধ্য দিয়ে যদি লজ্জাপ্রকাশ করা হয়, তা হলে কোনও কিছুকে বজায় রাখতে পারিনি— সেটাও সমান ভাবে লজ্জাপ্রকাশেরই নামান্তর। আমি ওঁকে যতটুকু চিনি, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি উনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। যদি কিছু নষ্ট হয়ে যায়— সেটা ওঁর ভাল লাগছে না। সেই জায়গা থেকেই হয়তো উনি মন্তব্যটা করেছেন। হয়তো সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে উনি মেয়েদের আরও বেশি করে সচেতন এবং শ্রদ্ধাশীল হতে বলছেন।’’
কৌশিকী,অভিষেক, চূর্ণী এবং নুসরত
অভিনেত্রী নুসরত জাহান পাশ্চাত্য পোশাকে সাবলীল হলেও ভালবাসেন শাড়ি পরতে। তিনি বলেন, ‘‘শাড়ি-ধুতি আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। তবে শাড়ি না পরতে পারলে সেটা লজ্জাজনক, আমি তা মনে করি না। শাড়ি পরতে ভাল লাগলে পরবে, না লাগলে পরবে না। তার মানেই এটা নয় যে, কেউ শাড়ি বা সংস্কৃতিকে অপমান করছে। আমি শাড়ি ভালবাসি। কেউ শাড়ি না পরতে চাইলে তো জোর করার কিছু নেই। কেউ শাড়ি না পরলে সব্যসাচীর কালেকশনও তো বিক্রি হতো না!’’
ডিজাইনার অভিষেক দত্ত আবার অনেকের মতোই সব্যসাচীর মন্তব্যকে লিঙ্গভিত্তিক বলে মানতে নারাজ। বলছেন, ‘‘জেন্ডার বায়াসড-এর চেয়েও এটা ফ্যাশন-বায়াসড স্টেটমেন্ট বলে আমার মনে হয়। উনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন যে, ঐতিহ্য রক্ষার্থে সকলে যেন শাড়িটা পরতে জানেন। তার মানেই এটা নয় যে, শাড়ি পরতে কাউকে বাধ্য করা হচ্ছে। বাঙালি হয়ে যদি আমরা বাংলা না শিখি বা বলতে না পারি, তা হলে কি সেটা গর্বের বিষয় হয়?’’
এত বিতর্কের মাঝে কেউ সব্যসাচীর বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থ খুঁজে তুলেছেন হাজারো প্রশ্নবাণ। আবার কেউ বা অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন সব্যসাচীর বক্তব্যের পিছনে লুকিয়ে থাকা অভিপ্রায়। আর সব্যসাচী নিজে বলছেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় আসলে উঠে আসছে গণতান্ত্রিক বিতর্ক। এবং সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর!’’
পরে বিতর্কের চাপে পড়ে অবশ্য নিজের বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন সব্যসাচী। আর সেখানেও ব্যবহার করেছেন সেই সোশ্যাল মিডিয়াকেই। ইনস্টাগ্রামে তিনটি ভিডিও পোস্টের মাধ্যমে ক্ষমা চান সব্যাসাচী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy