Advertisement
২২ মে ২০২৪

অ্যাটলেটিকোর গ্যালারি থেকে

চোখের সামনে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-জিদান-সিমিওনেরা। মিলানের স্টেডিয়ামে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল দেখে এসে লিখছেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়অনেক বছর আগে দূরদর্শনে যখন কলকাতা ডার্বি কিংবা নেহরু কাপের ম্যাচগুলো হত, সম্প্রচার শুরু হওয়ার আগে একটা মিউজিক বাজত। আমরা তখন বেশ ছোট। মাঠে যাওয়ার অনুমতি পাইনি। সাদাকালো টিভিটাই সব।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর রোনাল্ডোর উচ্ছ্বাস

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর রোনাল্ডোর উচ্ছ্বাস

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

অনেক বছর আগে দূরদর্শনে যখন কলকাতা ডার্বি কিংবা নেহরু কাপের ম্যাচগুলো হত, সম্প্রচার শুরু হওয়ার আগে একটা মিউজিক বাজত। আমরা তখন বেশ ছোট। মাঠে যাওয়ার অনুমতি পাইনি। সাদাকালো টিভিটাই সব। কিন্তু ওই কয়েক সেকেন্ডের মিউজিকই যেন আবহটা তৈরি করে দিত। সুব্রত, প্রসূন, প্রশান্ত, কৃশানু, চিমা, শিশিরদের দেখার রোমাঞ্চ, প্রিয় দলকে সমর্থনের আবেগ আর উত্তেজনার পারদ শেষ অঙ্কে পৌঁছনোর প্রতীক্ষা। এতগুলো বছর পর এখনও সেই শিরশিরানিটা অনুভব করি টিভিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের থিম মিউজিকটা বাজতে শুনলে। কোথায় যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়়া দিয়ে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। সেই ’৯২ সাল থেকে উয়েফা আমদানি করেছে এই মিউজিকের।

এই সুরটা বাজতে থাকলেই পৃথিবীজোড়া মানুষের অ্যাড্রিনালিন যে অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে সেটা নিশ্চিত। গ্যারেথ বেলের একটা ইন্টারভিউ পড়েছিলাম কোনও এক সময়। তাঁকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার স্বপ্ন নাকি দেখিয়েছিল ওই সুরটাই। গোটা পৃথিবীর কত ফুটবলার যে এই স্বপ্ন দেখেই বড় হয়।

এক গ্যালারি দর্শক, স্টেডিয়াম জু়ড়ে বাজছে চ্যাম্পিয়নস থিম আর মাঠের মাঝে লাইনে দাঁড়িয়ে বাইশ জন ফুটবলার। গ্যালারিতে তখন কী হয়? হ্যাঁ, এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালটা, ওই মিউজিকটা গ্যালারিতে বসেই শুনে এলাম। আরও একবার দেখে এলাম, পৃথিবীতে অনেক-অনেক মতবাদ, অনেক ধর্মের পাশে বিরাজ করে আরও একটা ধর্ম, ফুটবল। ফুটবল হাসায়, ফুটবল কাঁদায়, ফুটবল জীবন দর্শনটাই বদলে দেয়। দু’বছর আগে মারাকানা স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল দেখেছি। কিন্তু সে তো প্রেস বক্সের ভাবগম্ভীর আবহাওয়ায়। এবার একেবারে ভরা গ্যালারিতে। হাসি-কান্না আবেগের প্রবল বিস্ফোরণের মাঝে।

টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কর্তারাই। অ্যাটলেটিকো বেয়ার্নকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছতেই অ্যাটলেটিকো কলকাতার সচিব সুব্রত তালুকদারের প্রস্তাব ছিল, ‘‘চলো, যাবে নাকি ফাইনাল দেখতে?’’ এই প্রস্তাব আর কী করে ফেরানো যায়! মাদ্রিদে যোগাযোগ করে কয়েকটি টিকিটের ব্যবস্থা হল। পাসপোর্ট নম্বর পাঠিয়ে ‘বুক’ করা হল টিকিট। আর ফাইনালের দিনকয়েক আগে আমরা পৌঁছেও গেলাম মিলান। ইতালি তখন অল্প-অল্প করে সাজতে আরম্ভ করেছে। গোটা পৃথিবী থেকে আসতে শুরু করেছেন দর্শকরা। ভেনিস, রোম যেখানেই যাচ্ছি দেখছি ভি়ড় জমাচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান, আর্জেন্টিনিয়ান কিংবা স্প্যানিশরা। ফাইনাল ডেস্টিনেশন সান সিরো স্টেডিয়াম, মিলান।

ম্যাচের দিন দুপুরে শেষ অবধি টিকিট হাতে পেলাম। অ্যাটলেটিকোর অ্যাডভাইসার ইগনিশিও ছিলেন টিম হোটেলেই। মিলানের প্রাণকেন্দ্র ডুমোয় এন এইচ প্রেসিডেন্ট নামের একটি হোটেলে ছিলেন কোকে, গাবি, টোরেসরা। সুব্রতবাবুর সঙ্গে সেখানেই হাজির হলাম ইগনাশিও-র সঙ্গে দেখা করতে। প্রচণ্ড ব্যস্ত অ্যাটলেটিকো কর্তা। স্বাভাবিক। ইউরোপের এই ক্লাবগুলোর কর্তাদের কাছে এই ধরনের ম্যাচ বিজনেস প্রেজেন্টেশন দেওয়ার মতো। গোটা পৃথিবীর স্পনসর, পার্টনাররা আসতে থাকেন ম্যাচ দেখতে। তাঁদের সবার টিকিটের ব্যবস্থা, দেখভাল, অনেক দায়িত্ব। অ্যাটলেটিকোর বাকি কর্তারা উঠেছিলেন ওখানেই। ওই হোটেলের পাশেই মিলান ক্যাথিড্রাল। সান্তামারিয়া চার্চ। দুর্দান্ত স্থাপত্যের সামনে বিরাট স্কোয়ার। সেখানেই রোড শো-এর ব্যবস্থা করেছিল উয়েফা। পুরো স্কোয়ারটা জুড়ে রিয়েল আর অ্যাটলেটিকোর ফুটবলারদের কাটআউট, ছবি।

উয়েফার ফ্যান জোন ওটাই। রাতে জায়ান্ট স্ক্রিনে ম্যাচ দেখার ব্যবস্থাও ওখানে। গোটা এলাকাটা তখন লাল-সাদা রঙে ঢেকে গেছে। একই শহরের প্রবল প্রতিপক্ষ দুটো দলের সমর্থকরা অন্য শহরে। কিন্তু কোথাও কোনও ঝামেলা নেই। বরং একই সঙ্গে দল বেঁধে ওরা মেট্রো ভরালেন। আর ট্রেন জুড়ে গানে, স্লোগানে চলল একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

সান সিরোর ঠিক পাশেই মেট্রো স্টেশন। কিন্তু সে দিন আর সে অবধি ট্রেন চালালেন না কর্তৃপক্ষ। নামিয়ে দেওয়া হল অনেকটা আগে। হাজার হাজার সমর্থক তখন পায়ে হেঁটে চলেছেন স্টেডিয়ামের দিকে। সুব্রত বাবুর গায়ে সেদিন অ্যাটলেটিকো কলকাতার টি শার্ট। বেশ কিছু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সমর্থক দেখলাম চিনতেও পারছেন এটিকে-র লোগো। সু্ব্রতবাবুকে ঘিরে ধরেছেন তাঁরা। কলকাতার অ্যাটলেটিকো নিয়েও অনেক প্রশ্ন, অনেক গর্ববোধ তাঁদের। গ্যালারিতে পৌঁছলাম যখন, তখন গান ধরেছেন আলিশিয়া কিস।

স্টেডিয়ামের আশি হাজার দর্শকের আসনে একটা আসনও খালি নেই। আমাদের দিকটায় অ্যাটলেটিকোর সমর্থকরা, অ্যাটলেটিকোর বেঞ্চ। সবাই মিলে পাগলের মতো চিৎকার করছেন— অ্যালেটি, অ্যালেটি। কখনও এক সঙ্গে গাইছেন গান। উড়ছে লাল-সাদা পতাকা।

উল্টোদিকের গ্যালারিটায় সাদার বিস্ফোরণ। রিয়েলের সমর্থকরা ওখানে। অ্যালিশিয়ার পারফর্মেন্সের পরই বাজল ওই অ্যানথেমটা। ইতালিয়ান কিংবদন্তি আন্দ্রে বচেলি যখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ওই গান গাইছেন, কাপ হাতে নিয়ে মাঠে ঢুকছেন এসি মিলান আর ইন্টার মিলানের দুই কিংবদন্তি জানেত্তি আর ফ্র্যাঙ্কো বারেসি। এই মাঠেই মিলান ডার্বিতে কত বার মুখোমুখি হয়েছেন ওঁরা। আজ অন্য দায়িত্বে। একই সঙ্গে মাঠে ঢুকছে দুটো টিমও। বিশ্বাস করুন, ওই উত্তেজনায় নিজেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মনে হচ্ছিল। আমার পাশেই বসে বাংলা সিনেমার তরুণ সঙ্গীত পরিচালক অরিন্দম। সান সিরোতে খেলা দেখতে গেছিল। ও বলছিল ‘‘ইলেকট্রিফাইং শব্দটাও বোধহয় এখানে আন্ডার স্টেটমেন্ট । তাই না!’’

টলেটিকোর সিইও ইগনেশিওর সঙ্গে লেখক

জুয়ানফ্রানের টাইব্রেকারের শটটা বাইরে যেতেই অবশ্য আমাদের গ্যালারির ছবিটা বদলে গেল। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অনেকে। আমাদের আসনের ঠিক পেছনের সারিতেই বছর ছয়েকের এক শিশু বসেছিল বাবার সঙ্গে। গায়ে অ্যাটলেটিকোর ওই লাল-সাদা জার্সি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল ম্যাচের পর। রোনাল্ডোদের ট্রফি নিয়ে ফোটো সেশনও তখন শেষ। দেখি, বাবার কোলে মুখ গুঁজে তখনও কেঁদে চলেছে বাচ্চাটি।

এই প্যাশন, এই একাত্মটাতাই অ্যাটলেটিকোকে তিন বছরের মধ্যে দু’ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে তোলে। একটা ক্লাব যাঁদের বাজেট বার্সেলোনা-রিয়েলের অর্ধেকেরও কম। কিন্তু সঠিক পরিচালনা আর বুক ভরা আবেগ একটা ক্লাবকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে তার উদাহরণ এই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ম্যাচ শেষে গোটা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ টিভিতে যখন রোনাল্ডোদের বিজয় উল্লাস দেখছিল তখন এদিকের গ্যালারির যন্ত্রণায় পুড়তে থাকা ওই মুখগুলো দেখছিলাম আমরা।

তখনও ফুটবলারেরা একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছেন। জুয়ানফ্রান দর্শকদের সামনে এসে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে গেলেন। তার পর ভেঙে পড়লেন কান্নায়। এলেন সিমিওনে কৃতজ্ঞতা জানাতে। ওই কঠোর বেদনায় দগ্ধ হতে থাকা প্রায় তিরিশ হাজার সমর্থকের সঙ্গে যেন আলাদা আলাদা ভাবে কৃতজ্ঞতা আদানপ্রদান করছিলেন ওঁরা। এই যোগাযোগটাই অ্যাটলেটিকোর সম্পদ। ওই লাল-সাদা জার্সিটা পরেই বড় হয়েছেন, গাবি, কোকে, মারিও, সুয়ারেজ, সল নিগুয়েলরা। অ্যাটলেটিকো ফাউন্ডেশেনের ইয়ুথ প্রোজেক্টের নব্বইটা টিমে এ ভাবেই বড় হন ভবিষ্যতের ফুটবলারেরা।

আর তার সঙ্গে আরও দেড় হাজার ফুটবলার খেলে ‘পে অ্যান্ড প্লে’ স্কিমে। বিশ্বের পঁয়তাল্লিশটা দেশের ফুটবলার রয়েছে ওঁদের ইউথ ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামে। ভারত থেকেই যেমন আছেন অনূর্ধ্ব উনিশ ফুটবলার বিদিয়ান্ত সিংহ। যাঁকে এবার আই এস এলে অ্যাটলেটিকো কলকাতার হয়ে খেলতে দেখবেন আপনারা। আর এই সিস্টেমেই একের পর এক ফুটবলার তুলে আনেন অ্যাটলেটিকোর কর্তারা। সের্গেই আগুয়েরো গেলে ফালকাও আসেন। তিনি গেলে চলে আসেন দিয়েগো কোস্টা।

কোস্টাকেও ইপিএলের ক্লাব তুলে নিলে তৈরি হয়ে যান গ্রিজম্যান। আর সিস্টেমটা সফল ভাবে পরিচালনা করেই অ্যাটলেটিকো লা লিগা জেতে বার্সেলোনা আর রিয়েল মাদ্রিদের মতো টিমকে পেছনে ফেলে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে টাইব্রেকারে হারে, রোনাল্ডো, গ্যারেথ বেল, মার্সেলো, র‌্যামোসদের রিয়েল মাদ্রিদকে রীতিমতো মাটি ধরিয়ে দিয়ে।

ক্লাবের পুরো ম্যানেজমেন্ট দেখাশোনার দায়িত্ব যাঁর তিনি ইগনেশিও আর্গুইলো। হার্ভার্ডের ম্যানেজমেন্ট স্কলার। ফুটবল চালাতে গেলে ফুটবলার হতে হয়, কিংবা ময়দানের কর্তা—এই ধারণাগুলোর বোধ হয় আমাদের দেশের কিছু ফুটবল বোদ্ধা কপিরাইট নিয়ে নিয়েছেন।

অ্যাটলেটিকোর মালিক মিগুয়েল অ্যাঙ্কেল কিন্তু ইগনেশিওর তত্ত্বাবধানে ব্র্যান্ড অ্যাটলেটিকোকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীতে। ভারতের ক্লাবে অংশীদার হয়েছেন। চিন থেকে পেয়েছেন বিপুল বিনিয়োগ। সম্প্রতি ফ্লান্সের সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাব এফ সি লেনসকে কিনে নিলেন। ম্যাঞ্চেস্টার, রিয়েল, বার্সেলোনার মতো অ্যাটলেটিকোকেও গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পথে এইগুলোই প্রারম্ভিক ধাপ। ।

সান সিরো থেকে প্রায় ঘণ্টা খানেক বাদে বেরিয়েও ভুলতে পারছিলাম না অ্যাটলেটিকোর ওই শিশুটির কান্না আর জুয়ানফ্রানের ওই ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্যগুলো। আমাদের গ্যালারিগুলোতে এই আবেগ অবশ্য রোজই চুঁইয়ে পড়তে দেখি। কলকাতা ফুটবলের সেই শহর যেখানে প্রিয় ক্লাবের জন্য এক সমর্থক আত্মহত্যাও করেছেন কোনও এক সময়ে। ভালবাসার কত উদাহরণ এই শহরেও। কিন্তু অ্যাটলেটিকোর মতো ভাবতে পারলাম কই আমরা! যত আবেগ, চোখের জল শুকিয়ে গেল যে গ্যালারিতেই। তাই এক লাখের ভরা গ্যালারি নিয়েও আমরা আফশোস করি, আক্ষেপ করি—ক্লাবগুলোর স্পনসর নেই। ক্লাবগুলো ঠোঁট ফোলায়, আমাদের আইএসএল-এ খেলতে দেবে না কেন! একশো বছর বয়স আমাদের। অথচ মাদ্রিদের একটা একশো বছরের ক্লাব পাঁচ বছর আগে প্রায় দেউলিয়া হতে হতে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে!

একবার কি অ্যাটলেটিকো হতে পারি না আমরা? বেশি নয়, শুধু ভারতের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ার, রাজত্ব করার সাহস, স্পর্ধা, স্বপ্নটাও কি একবার দেখতে পারে না আমাদের কলকাতার তিন প্রধান?

পিছনে এত মানুষ, সত্যিই কি অসম্ভব ছিল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

UEFA Champions League Ronaldo Atletico
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE