গুপ্তচরদের দুনিয়ায় সবাই সমান নয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এই মুহূর্তে ভারতে সব থেকে আলোচিত বস্তুটি সম্ভবত গুপ্তচর। ‘ভারত’ মানে মানচিত্রে দেখানো ভূখণ্ডমাত্র নয়। কাঁটাতার, সাতসমুদ্র পার হয়ে ভুবনব্যাপী এক অস্তিত্ব। এই মুহূর্তে ‘ভারতীয় গুপ্তচর’ এমনই এক জবরদস্ত ভূমিকায় নেমে এসেছে যে, তাকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। রীতিমতো উদ্যাপন করে মুক্তি পেয়েছে ‘স্পাই ইউনিভার্স’-এর চতুর্থ কিস্তি ‘পাঠান’। উদ্দাম অ্যাকশন, তীব্র উৎকণ্ঠা, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ভিএফএক্স— সব মিলিয়ে জমজমাট খেলা।
হিন্দি ছবিতে গুপ্তচর নতুন কিছু নয়। ১৯৬৮ সালে রামানন্দ সাগরের পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘আঁখে’ থেকে এই ঘরানার যাত্রা শুরু বলিউডে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের পটভূমকায় ধর্মেন্দ্র-মালা সিংহ অভিনীত সেই ছবির পিছনে ছিল ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক সংঘাত। জাতিসত্তার মুখপাত্র হিসেবে বলিউডের দায়িত্ব ছিল ভারত যে নিছক ঘুমিয়ে নেই— এই তথ্য আমজনতার সামনে তুলে ধরা। গুপ্তচরবৃত্তি এমনই এক কর্মকাণ্ড যে, তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ কেউ জানতে চাইবে না। ফলে স্পাই থ্রিলার একযোগে গণমনোরঞ্জন ও রাষ্ট্রশক্তির বক্তব্য রাখার পরিসর হয়ে উঠতে পারে। হিন্দি মূলধারার ছবিতে তা-ই ঘটতে শুরু করে।
ওদিকে ষাটের দশক বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকা-সোভিয়েত রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াইয়ে সব থেকে ঘনবদ্ধ সময়কাল। ১৯৬২ থেকে শুরু হয় জেমস বন্ড ছবির যুগ। বলিউডেও তার ঢেউ এসে লাগে। গুপ্তচর হিন্দি রোমাঞ্চ ছবির জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ঠান্ডা লড়াইয়ের উপজাত স্নায়ুযুদ্ধ ও ছায়াযুদ্ধে রত ভারত ও পাকিস্তানকে যুযুধান অবস্থায় তুলে ধরে খানিকটা ষড়যন্ত্র আর মহাবীর গুপ্তচরের অসমসাহসী কার্যকলাপে সকল মুশকিলের আসান বার বার পর্দায় ফুটে উঠতে থাকে।
কিন্তু পর্দা আর বাস্তবের গুপ্তচর কি এক? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মনে পড়তে পারে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির ষড়যন্ত্রী মন্ত্রীমশাইয়ের সামনে অনাহারক্লিষ্ট ল্যাকপ্যাকে চেহারার গুপ্তচরকে, যে তথাকথিত শত্রুরাষ্ট্রেরই প্রশংসা করে বসে। কিন্তু সে উদাহরণ খুবই বিরল। বন্ড থেকে পাঠান, গানমাস্টার জি নাইন থেকে টাইগার— একের পর এক বাহুবলীর মিছিল।
তবে ষাটের দশক আর নতুন সহস্রাব্দের ভারতের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। বিশ্বসংসারের সাতে-পাঁচে না-থাকারাও জানেন, তিনি সুখে নিদ্রা গেলেও জেগে আছে দেশের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর মন অন্য দিকে শত্রুপক্ষ ঘুরিয়ে দিলে রয়েছে ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং)। এই বক্তব্যটিকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলিউড ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ‘র’-এর এজেন্টরা মহাবলে বলীয়ান। তাদের অসাধ্য বলে কিছু নেই। প্রায়শই দেখা যায় ‘নির্বাসন’ থেকে ফিরিয়ে এনে ডিপার্টমেন্ট তাদের সাংঘাতিক সব মিশনে পাঠিয়ে দেয়। সে সব মিশনে অ্যাকশন শুরু হয় রকেট লঞ্চার দিয়ে আর তার পর রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে চলে উদ্দাম লড়াই।
কিন্তু প্রশ্ন এই যে, টাইগার কিংবা পাঠান সত্য? না কি হাল্লার মন্ত্রীর সামনে দাঁড়ানো চিমসে চেহারার গুপ্তচর? সাম্প্রতিক সময়ে দুই মেরু দু’রকম বাস্তবতা তুলে ধরছে। প্রথম মেরুতে রয়েছে ‘এজেন্ট বিনোদ’ বা ‘দশাবতারম’। যেখানে নায়ক প্রায় অতিমানব। গুপ্তচরবৃত্তির মহিমাকীর্তন করতে গিয়ে এ সব ছবি বার বার উদ্ভট কার্যকলাপ দেখিয়েছে। ভারত সব সময়েই বিশেষ প্রতিবেশী দেশের হাতে বিপন্ন। সেই বিপন্নতা থেকে দেশকে বাঁচাতেই এজেন্ট বিনোদ, টাইগার বা পাঠান সদাসতর্ক। এ সব ছবিতে ‘বিপন্নতা’ যেমন ভয়ানক, তেমনই ভয়ঙ্কর তা থেকে উদ্ধারের প্রণালী। অবশ্য নিছক ফ্যান্টাসি হিসাবে দেখলে কিছু বলার নেই।
ওটিটি মঞ্চ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সময় ২০১৯ সালে মুক্তি পায় ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর প্রথম সিজ়ন। ‘র’ নয়, এখানে নায়ক ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি’র আধিকারিক। কর্তব্য আর পরিবারের দোটানায় তার জীবন। পরিবার তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেশভক্তি বা তার চাইতেও বড় কিছু পায় সে তার চাকরি থেকে। গুপ্তচরের (বা বলা ভাল দেশের নিরাপত্তা রক্ষার নীরব কর্মীর) এমন চিত্রায়ণ আগে হয়েছে কি? মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত শ্রীকান্ত তিওয়ারির চরিত্র জনপ্রিয়তা পায়। তবে তার আগে বড় পর্দায় এর সূত্রপাত করে গিয়েছিল মেঘনা গুলজার পরিচালিত ‘রাজ়ি’ (২০১৮)। ১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধের পটভূমিকায় সেহমত নামের ২০ বছর বয়সি যুবতীকে ‘র’ প্রশিক্ষণ দেয়। সে পাকিস্তানের এক সেনানায়কের পুত্রবধূ হিসাবে সে দেশে প্রবেশ করে ও গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে। সেহমত বড় বিপর্যয় থেকে ভারতকে বাঁচায়। সেই ছবির ভিত্তি ছিল হরিন্দর সিক্কার লেখা উপন্যাস ‘কলিং সেহমত’ (২০০৮)। সিক্কা এক ভারতীয় সেনা আধিকারিকের কাছ থেকে জানতে পারেন, তাঁর কাশ্মীরি মুসলমান মা এক পাক সেনা আধিকারিককে বিয়ে করেন এবং সেই সূত্র থেকে তিনি ভারতে সে দেশের গোপন সামরিক তথ্য সরবরাহ করতেন। সিক্কা সেই মহিলার সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর উপন্যাসের কাহিনিসূত্র খুঁজে পান।
মেঘনা তাঁর ছবিতে গুপ্তচরবৃত্তি এবং নারীত্বের দোলাচল দেখিয়েছিলেন। যে পাক সেনাধিকারিকের ছেলের সঙ্গে সেহমত এক সুখী দাম্পত্যেই প্রবেশ করে। কিন্তু তার পেশা তার ব্যক্তিগত জীবনকে নিজের হাতে তছনছ করে দিতে বাধ্য করে। সফল গুপ্তচর সেহমত এক ব্যর্থ মানুষ হিসাবে দেশে ফিরে আসে। ছবির শেষে দেখা যায়, এক দিশাহারা ঠিকানায় বৃদ্ধা সেহমত একটি জানলার পাশে বসে রয়েছে। এমন এক মানুষ, যার এ কূল-ও কূল কিছুই নেই।
গুপ্তচরবৃত্তিকে অন্য এক বিন্দু থেকে ধরার চেষ্টা করেছে নীরজ পাণ্ডে পরিচালিত ‘স্পেশাল অপ্স’। সেই ওটিটি সিরিজ়ে ‘র’-এর আধিকারিক হিম্মত সিংহের ব্যক্তিগত জীবন আর কাজের ভুবনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থানকে নিয়ে আসেন নীরজ। হিম্মত এমন এক আধিকারিক, যার অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু এজেন্ট। হিম্মত ব্যক্তিগত ভাবে ‘ফ্যামিলি ম্যান’। কিন্তু কাজের জায়গায় সে বা তার এজেন্টরা অনেকটাই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। কেকে মেনন অভিনীত এই সিরিজ়ে অতিমানবিক গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে রক্তমাংসের মানুষীর দুনিয়া মেশানোর চেষ্টা আছে। মনে হয়, ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ বা ‘রাজ়ি’-র সঙ্গে যেন মিলতে চাইছে বন্ড ঘরানা। জনপ্রিয় এই সিরিজের একটি প্রিক্যুয়েলও নির্মিত হয়। যেখানে হিম্মতের ব্যক্তিজীবনের রহস্য উন্মোচিত হয় তার গুপ্তচরবৃত্তির প্রাথমিক পর্বের আখ্যানের মধ্য দিয়ে। জানা যায়, ব্যক্তি হিম্মতের রক্তে মিশে আছে গভীর বিষাদ। কিন্তু হিম্মতের কর্মক্ষেত্র আর পরিবার— দুই বাস্তবতার মধ্যে কোনও সেতু গড়ে ওঠে কি? ধন্দ থেকে যায়।
আর একটি ওটিটি সিরিজ় হল শিবম নায়ার পরিচালিত ‘মুখবির’। এই সিরিজ় ‘র’ তৈরির সময়ের কথা বলে। স্বাধীন ভারতের প্রাথমিক পর্বের গুপ্তচরবৃত্তি থেকে এক সংহত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ‘র’-এর উদ্ভবের পিছনের ইতিবৃত্ত জানাতে গিয়ে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ইতিহাসের ‘ফাঁক’। এখানে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী রয়েছেন, রয়েছেন ইন্দিরা গান্ধীও। নাম বদলে রয়েছেন ‘র’-এর প্রথম প্রধান আর এন কাও, ডিরেক্টর কে শঙ্করন নায়ার। আর রয়েছে এক ‘মুখবির’ বা গুপ্তচর। জইন হাসান দুররানি নামে সেই যুবককে গুপ্তচর হিসাবে পাঠানো হয় পাকিস্তানে। ছদ্মনামে, ছদ্ম কুলুজিতে। জইন পাকিস্তানে ‘হরফন বুখারি’ নামে আশ্রয় নেয় এমন এক পরিবারে, যাদের এক সন্তান দেশভাগের পরেও ভারতে থেকে গিয়েছিল। জইন নিজের পরিচয় দেয় সেই ব্যক্তির পুত্র হিসাবে। এর পর খুলে যায় এক আপাত মন্থর অথচ রুদ্ধশ্বাস আখ্যান। জইনের হাতে পাক সরকারের গোপনতম নথি আসার পথে প্রেম-অপ্রেম, সন্দেহ-ভালবাসা, বিশ্বাস-বিশ্বাসভঙ্গের তরঙ্গ ওঠানামা করে। দেশপ্রেম, নাকি নিজের কাজের প্রতি সততা— ঠিক কী জইনকে চালিত করে, বোঝা মুশকিল হয়। নিজের কাজের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে জইন বলি দেয় তার প্রেম, প্যাশন এমনকি, আত্মজনকেও। একটা পর্যায়ের পর সে জইন না হরফন, তা নিজেই ঠাহর করতে পারে না। তার ‘মিশন’ সফল করে সে যখন ভারতে প্রবেশ করে, সেনার হাতে তার প্রবল লাঞ্ছনা ঘটে। নিজেকে প্রমাণ করার কোনও অভিজ্ঞান তার হাতে নেই। সে কে? ছিন্নভিন্ন এক জীবন নিয়ে জইন তথা হরফন দাঁড়িয়ে থাকে এক শূন্য ভুবনে। যেখানে সে কেউ নয়, কারওর নয়।
‘রাজ়ি’ বা ‘মুখবির’ দেখতে দেখতে মনে হতে পারে, কে গুপ্তচর? কী তার আত্মপরিচয়? নাগরিকত্বের খাতা থেকে এক দেশ তাকে আবছা করে দিয়েছে, অন্য দেশে সে শত্রুপক্ষ। তার আদৌ কোথাও যাওয়ার আছে কি? ভয়ানক সব অত্যাচার, পদে পদে জীবনের ঝুঁকি পেরোতে পেরোতে সে আর যা-ই হোক, জেমস বন্ড বা তার ভারতীয় রূপ বিনোদ, টাইগার বা পাঠান হয়ে ওঠে না। সে মিশন শেষ করে ‘জয় হিন্দ’-টুকুও বলতে পারে না। কারণ, তার কোনও ‘জমি’ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy