‘ব্রজের বাঁশরী’ পালা দেখছেন ইমতিয়াজ। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
‘সাবধান পিতা সাবধান’ বলে গর্জে উঠলেন উষা।
সিঁথির সিঁদুর আজ সে মুছবে না কিছুতেই। কারণ? “সতীর সিঁদুরের শক্তি সামান্য নয়। এরই শক্তিতে সূর্যদেব একদিন অন্ধকারে মুখ দেখেছিলেন...”
অতিনাটকীয় এক মুহূর্ত। টানটান উত্তেজনা। দর্শকাসন থেকে কেউ আইফোনে বন্দি করে রাখলেন সে মুহূর্ত। কেউ ঝুঁকে সামনের চেয়ারে হেলান দিয়ে আরও মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলেন।
যাঁরা নিয়মিত যাত্রা দেখেন, তাঁদের কাছে অবশ্য এটা নতুন কোনও অভিজ্ঞতা নয়।
তবে পার্থক্য একটাই।
সে দিন বলিউডের নামকরা পরিচালক ইমতিয়াজ আলি দর্শকাসনে। স্মৃতি রোমন্থনের টানে বা অন্য কোনও পেশাদার কারণে তিনি বাগবাজার স্ট্রিটে।
গলার স্বর নামিয়ে বললেন, “তখন আমার বয়স খুবই কম। জামশেদপুরে থাকতাম...” সেখানে নিয়মিত যাত্রা দেখতে যেতেন। খোলা মাঠে। মাঝখানে এক মঞ্চ। কোনও পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে একবার একটা পালা দেখতে গিয়েছেন ছোট্ট ইমতিয়াজ। সেখানে হনুমান সেজে এক অভিনেতা দর্শকাসনের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মঞ্চের দিকে। হঠাত্ পেছন থেকে কেউ একজন দুষ্টুমি করে এক টান মারলেন হনুমানের লেজে। আর তা নিয়েই উত্তেজনা!
বহু দশক কেটে গিয়েছে তার পর। আজ কাজের চাপে আর যাত্রা দেখা হয় না। ইমতিয়াজ বলিউডের অন্যতম ব্যস্ত পরিচালক যে! আলিয়া ভট্ট আর রণদীপ হুডাকে নিয়ে সদ্য ‘হাইওয়ে’ পরিচালনা করে তিনি আপাতত শিরোনামে।
কলকাতা এসেছিলেন এক বিজ্ঞাপন শু্যট করতে। আর তার মাঝে শুক্রবার বিকেলে ফিরে গেলেন যাত্রা দেখতে!
ইচ্ছে ছিল সেই ছোটবেলার মতো করে মাঠে বসে যাত্রা দেখার। কিন্তু শু্যটিং শিডিউলের মাঝখানে তাঁর অবকাশ কোথায়? কোন যাত্রা দেখবেন, তা ঠিক করার ভার পড়ল অর্ণব রায়ের ওপর। এক সময় যাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্ণব। ইমতিয়াজ যে ইউনিটের সঙ্গে কলকাতায় কাজ করলেন, তার সঙ্গে অর্ণব যুক্ত।
“ইমতিয়াজের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে ও বিশাল বড় কোনও যাত্রা দেখতে চাইছিল না। চেয়েছিল এমন একটা যাত্রা দেখতে, যেখানে বিবেকের চরিত্র থাকবে,” অর্ণব বলেন। আরও জানান, কম সময়ের মধ্যে অতটা অ্যারেঞ্জ করতে পারা যায়নি। “যোগাযোগ করেছিলাম রূপকুমার ঘোষের আকাশবাণী যাত্রা সংস্থার সঙ্গে। নতুন আলু উঠলে ইচ্ছে আছে ওকে এক বার মাঠে বসিয়ে যাত্রা দেখানোর,” তিনি বলেন।
শুক্রবার সারা রাত ধরে বিজ্ঞাপনের শু্যটিং। তার আগে বিকেলবেলায় যাত্রা দেখানোর আয়োজন করা হল বাগবাজার স্ট্রিটের ফণীভূষণ যাত্রা মঞ্চে। পালার নাম ‘ব্রজের বাঁশরী’। সময়ের অভাবে পালার শুরুতে যে কনসার্টটা করা হয়, সেটাকে খানিকটা ছোট করে পরিবেশনা করা হল। আর তার পর শুরু হল মূল পালা।
প্রেম আর ভক্তিরস মিলিয়ে পৌরাণিক কাহিনির আধারে লেখা এই পালা। অডিটোরিয়ামের দ্বিতীয় সারিতে ইমতিয়াজ বসে। হলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে তাঁর ইউনিটের লোকজন। জামশেদপুরে বড় হয়েছেন বলে যাত্রার সংলাপের ভাষাটা একদম অপরিচিত নয়। আর অসুূবিধে হলে জিজ্ঞেস করে নেওয়ার সুযোগও ছিল। কত রকমের প্রশ্ন! যাত্রার পোস্টারে কি বদল হয়েছে আজকাল? এখনও কি সেই আগের মতো লিথো পোস্টার পাওয়া যায়?
পোশাক নিয়েও কত কৌতূহল তাঁর! যে দৃশ্যে পালার অন্যতম মুখ্য চরিত্র উষা মঞ্চে প্রথম বার আত্মপ্রকাশ করলেন, সেখানে তাঁর পরনে সিল্কের শাড়ি। কিন্তু সেটা পরা ভরতনাট্যম নর্তকীদের স্টাইলে। আবার যে দৃশ্যে উষার স্বয়ম্বর সভা, সেখানে তাঁর পরনে লেহঙ্গা! মন দিয়ে সব ডিটেলিং নজর করলেন তিনি।
‘হাইওয়ে’-র প্রোডাকশন ডিজাইন করেছি। কলকাতায় এসে
ইমতিয়াজের সঙ্গে যাত্রাটা দেখলাম। গোটা পালাটা আমরা রেকর্ডও করলাম’
স্নিগ্ধা বসু
তার সঙ্গে আরও এক আকর্ষণ পালার সংলাপ। কখনও উষা গাইছেন, ‘চলো পিতা, জ্বালাও চিতা শেষ আহুতি দিয়ে মোর।’ কখনও বা বলছেন ‘বিদ্যার নামে ওই আবর্জনার স্তূপ আমি আর গ্রহণ করব না... এই শাস্ত্রপাঠে শুধু অহংকার বাড়ে। যা আমি জানতে চাই, তা এই দৈত্যকুলের কোনও শাস্ত্রে লেখা নেই...’
আর তার সঙ্গে নেপথ্যে সমান তালে বেজে চলেছে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। সব থেকে বেশি যা নজরে এল, তা হল মঞ্চে মাইক্রোফোনের ব্যবহার। ছাত থেকে তিনটে লাইনে সারি দিয়ে ঝোলানো ছিল ১২টা মাইক্রোফোন। আর সেগুলো প্রত্যেকটাই দড়ি দিয়ে বাঁধা। প্রয়োজনে যাতে সেগুলোকে ওঠানামা করানো যায়। আর সে দড়িগুলো একসঙ্গে ওঠানামা করাচ্ছিলেন পালারই এক টেকনিশিয়ান।
যেই না মুখে নীল রং ঘষে কৃষ্ণ চরিত্র সেজে এক অভিনেতা মঞ্চে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছেন বাঁশি বাজাতে বাজাতে, ওমনি মাইক্রোফোনের দড়ি ধরে এক টান। এক সেকেন্ড দেরি হলেই সটান গিয়ে মাইক ধাক্কা খাবে অভিনেতার কপালে। লং-ডিস্ট্যান্স হাইট অ্যাডজাস্ট করার সে নিপুণ ব্যবস্থা দেখে ইমতিয়াজ তো অবাক। কী টাইমিং! সব কিছু একেবারে নখদর্পণে।
ইমতিয়াজের পাশেই বসেছিলেন ‘রকস্টার’, ‘হাইওয়ে’, ‘ককটেল’, ‘থ্রি ইডিয়েটস’, ‘গুজারিশ’, ‘ধুম থ্রি’ আর ‘পিকে’র প্রোডাকশন ডিজাইনার সুমিত বসু, স্নিগ্ধা বসু আর রজনীশ হেদাও। “আজ এই পালাটা দেখে আমরা দারুণ ইমপ্রেসড। ওই ভদ্রলোকের কী দারুণ কোঅর্ডিনেশন! লাইট আর সাউন্ড একসঙ্গে ডিজাইন করছিলেন। একজন তো আবার স্পেশাল ইফেক্টসের দৃশ্যে হাত আর পা একসঙ্গে ব্যবহার করে আলোটা ঠিক করছিলেন! মাল্টি-টাস্কিং করছেন মাল্টি ট্যালেন্টেড সব শিল্পী। কোনও রিটেক নেই, তবু একবারও কেউ ফাম্বল করলেন না!” দেখতে দেখতে বললেন স্নিগ্ধা।
মাঝে মধ্যে নিজের আইফোন বের করে ছবি তুললেন ইমতিয়াজ। অভিনেতাদের উত্সাহ দেওয়ার জন্য গান শুনে হাততালি দিলেন। এ দিকে পালা যত এগোতে থাকে, গানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হঠাত্ মঞ্চে ঠুমকা দিতে দিতে নেচে উঠলেন এক চরিত্র। কোমরের ভাঁজে ভাঁজে তার কামনার আবেদন। জিমে যাওয়া সাইজ জিরো হিরোইন নন তিনি। তবে ক্ষতি নেই। এই চাষি বৌয়ের ভূমিকায় অভিনেত্রী দেবযানীর নাচ ইমতিয়াজের ইউনিটে দারুণ হিট। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলে হারমোনিয়াম, বাঁশি, ঢোলক, তবলার সঙ্গে সঙ্গে অক্টোপ্যাড আর সিন্থেসাইজার। আর তার তালে তালে চাষি বৌয়ের ঠুমকা।
‘ভেবেছিলাম ঐতিহ্যবাহী আর্টফর্মগুলো দেখে ঝালিয়ে নেব।
তাই এই পালাটা দেখলাম। এর পর ইচ্ছে আছে মাঠে বসে যাত্রা দেখার’
ইমতিয়াজ আলি
পেছনের সিট থেকে কেউ আবার সেই ঠুমকা দেখে উলুধ্বনি দিলেন!
এ যেন যাত্রার আইটেম নাম্বার! লোকনাট্যের রসাস্বাদনের মোক্ষম রসদ। এ দিকে ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকে। বিজ্ঞাপনের শু্যটিংয়ের তাড়া। হোটেলে ফিরে গিয়ে আবার রেডি হয়ে কফি হাউজে ফিরতে হবে শু্যটিং করতে। “একসঙ্গে সবাই মিলে বেরিয়ে গেলে শিল্পীদের ভাল লাগবে না। তাই এক এক করে বেরোতে হবে,” বললেন ইমতিয়াজ।
তার পর স্লিং ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মাথা নিচু করে হল থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। সামনেই বাগবাজারের তেলেভাজার দোকান। বাল্ব দিয়ে গরম করে রাখা কাঁচের বাক্সের ভিতর খান কুড়ি ফুলুড়ি রাখা। তার মধ্য থেকে ইমতিয়াজ বেছে নিলেন নিজের পছন্দের তেলেভাজা। মিনিটের মধ্যে শালপাতার ঠোঙা ভর্তি করে চলে এল কচুরি আর তেলেভাজা। খেতে খেতে বললেন, “ছোটবেলায় অনেক যাত্রা দেখেছি। ইচ্ছে ছিল ট্র্যাডিশনাল আর্ট ফর্মগুলো দেখে আবার ঝালিয়ে নেওয়ার। দারুণ লাগল। এর পর ইচ্ছে আছে মাঠে বসে যাত্রা দেখার। আসলে আমরা তো সিনেমায় ওই একই জিনিস করি। শুধু তার ধরনটা একটু আলাদা।”
ইমতিয়াজ গাড়িতে উঠে যাওয়ার পরেও তাঁর ইউনিট থেকে একজন থেকে যান অডিটোরিয়ামে। গোটা পালাটা শু্যট করেন তিনি। এটা কি শুধু মাত্র পরিচালকের শখ? না কি এর পিছনে অন্য কোনও পেশাগত কারণ রয়েছে? পরের ছবির শু্যটিংয়ের হোমওয়ার্ক... অথবা অন্য কিছু... সে বিষয়ে অবশ্য ইমতিয়াজ এখনও মুখ খুলতে রাজি নন। জুলাই নাগাদ দীপিকা পাড়ুকোন আর রণবীর কপূরকে নিয়ে শু্যটিং শুরু করবেন। এমনটা বলছেন না যে, ছবির শু্যটিং করতে কলকাতায় আসবেন। তবে স্নিগ্ধা জানালেন, “ইমতিয়াজের পরের ছবিটাও প্রেম নিয়েই। এই যাত্রার মূল বক্তব্যটাও একটা মেয়ের ভালবাসাকে ঘিরেই। যেখানে সে তার বাবার বিরুদ্ধে যেতেও ভয় পায় না। আমরা এই যাত্রাটা রেকর্ড করছি, যাতে কিছু জিনিস স্টাডি করে রাখা যায়।” কোথায় সেটা ব্যবহার হবে, তা বললেন না। কী ভাবে ব্যবহার হবে জানালেন না সেটাও। “তবে এটুকু বলতে পারি যে, সুমিত আর আমি গর্ভনমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফ্ট-এর ছাত্র। যদি বাংলার শিল্পকলাকে কোনও ভাবে হিন্দি ছবিতে ব্যবহার করতে পারি, তা হলে আমাদের খুব ভাল লাগবে,” স্নিগ্ধা বলেন।
‘রকস্টার’, ‘হাইওয়ে’ দেখেছি। আমার পরম সৌভাগ্য যে পরিচালক আমাদের পালা দেখলেন’
চম্পা হালদার
ততক্ষণ সন্ধে নেমে গিয়েছে। তিন ঘণ্টা পনেরো মিনিটের পালা শেষ। মঞ্চ থেকে নেমে উষা শুনলেন ইমতিয়াজ চলে গিয়েছেন! তিরিশ বছর ধরে অভিনয় করছেন উষা। সন্ধ্যা রায় থেকে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীলা মজুমদার থেকে সন্তু মুখোপাধ্যায় সবার সঙ্গেই অভিনয় করেছেন এই চম্পা হালদার। তবে বলিউডের কোনও সেলিব্রিটি তাঁর পালা দেখতে আসেননি। “‘রকস্টার’, ‘হাইওয়ে’ দু’টোই দেখেছি। এ আমার পরম সৌভাগ্য যে ইমতিয়াজ আলি এসে আমার অভিনয় দেখে গেলেন। চিত্পুর যাত্রা পাড়ায় এটা একটা বড় খবর। একটাই আফসোস, কথা বলতে পারলাম না। যখন আমি অভিনয় করি, তখন তো আর মঞ্চ থেকে দর্শকাসনে কে আছেন বোঝা যায় না। তখন আমি একজন ক্যারেকটার। শুধুই উষা। চম্পা হালদার তখন নেপথ্যে। সামনে কে বসে, কিছুই বুঝতে পারি না। পালা শেষ হওয়ার পরে শুনলাম উনি এসেছিলেন... যদি একবার কথা বলতে পারতাম...”
জীবনের হাইওয়ে-টা হয়তো এ রকমই। কখনও ভাল লাগা। কখনও না-লাগা। আর কখনও ইস্-যদি-আরও-কিছু-হত নিয়েই বেঁচে থাকা... এও বোধহয় অন্য একটা যাত্রাপথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy