Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Entertainment News

যারা খুনের হুমকি দেয় তারা কেউ লেখা পড়ে না!

কাশ্মীরি সাংবাদিক শুজাত বুখারির মৃত্যুর পর বেশ থমকে আছেন তিনি। দেখে মনে হয় কী যেন খুঁজছেন! না বলা গল্প? অচেনা সুর? সময়? সময়ের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছেন চিত্রনাট্যের খসড়া। চারপাশের পৃথিবীতে স্বাধীনতার মৃত্যু তাঁকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে! তিনি। শ্রীজাত। যন্ত্রণা, প্রেম, ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আড্ডা দিলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।কাশ্মীরি সাংবাদিক শুজাত বুখারির মৃত্যুর পর বেশ থমকে আছেন তিনি। দেখে মনে হয় কী যেন খুঁজছেন! না বলা গল্প? অচেনা সুর? সময়? সময়ের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছেন চিত্রনাট্যের খসড়া। চারপাশের পৃথিবীতে স্বাধীনতার মৃত্যু তাঁকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে! তিনি। শ্রীজাত।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮ ১৬:৩৪
Share: Save:

যার বিয়ের দিন কাটে শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষের বাড়িতে। বইমেলার মাঠ যার লেখার অপেক্ষায়। অরিজিৎ সিংহের প্রথম ছবিতে তাঁর শব্দরাই ঘিরে থাকে। নিউ ইয়র্ক যার আর একটা বাড়ি! তাঁর কথায় কথায় এত দুঃখবিলাস কেন?

বিলাস? এটা কিন্তু বিলাসিতা নয়। আপনি যে সমস্ত কথা বললেন, তার সঙ্গে ডিপ্রেশন বা অবসাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি তো সামান্য, সাধারণ মানুষ। সত্যিকারের খ্যাতনামা আর সফল মানুষজনের তা হলে ডিপ্রেশন হতোই না কোনও দিন। দীপিকা পাড়ুকোন তো সব দিক থেকে সফল, তাঁর অবসাদ হয় কেন? মার্ক রথকো’র মতো যুগান্তকারী শিল্পী অবসাদে আত্মহত্যা করেছিলেন। এমন উদাহরণ অজস্র। তাই বাহ্যিক অবস্থা দিয়ে ভিতরের সবটুকু বুঝে ফেলা যায় না।

তা হলে এ রকম বলা যায় কি, খ্যাতির পাওয়া নিজের কাছে চাহিদা তৈরি করে?

এই চাওয়া কিন্তু নিজের কাছে নয়। এই যে শুজাত বুখারিকে মেরে দেওয়া হল, তার আগে গৌরী লঙ্কেশ— এতে তো এক জন নাগরিক হিসেবে আমি অন্ধকারে ফিরে গেলাম আবার। কেননা, এই মানুষগুলো যা বিশ্বাস করতেন, আমিও তা বিশ্বাস করি। অথচ এঁদের বাঁচানোর কোনও ক্ষমতাই আমাদের নেই। তা হলে লিখে কী হবে? যেখানে পৃথিবীতে প্রত্যেক দিন অসংখ্য নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, বাকস্বাধীনতার গলা টিপে তাকে খুন করা হচ্ছে, সেখানে আপনি ডিপ্রেশনকে এড়াবেন কী ভাবে? আমি মনুষ্যত্ব ছাড়া কোনও ধর্ম মানি না। তাই চারপাশের এই ধ্বংস দেখতে দেখতে মনে হয়, অন্ধকারের পৃথিবীতে লিখে আর কী হবে? একটা সময়ে অবসাদের কারণেই লিখতে পারিনি অবশ্য।

কী করেছেন তখন?

ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। কথা বলেছি। এটা তো ক্লিনিক্যাল বিষয়। ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। তবে আমায় ডাক্তার বলেছেন, এটা সারবে না। কারণ আমি তো অন্য গ্রহে গিয়ে থাকতে পারব না! এর মধ্যেই আমায় থাকতে হবে!

এই যে আপনি শঙ্খবাবুর কথা বলছিলেন, শুজাত বুখারি যখন মারা যান, আমি সেই মুহূর্তে শঙ্খবাবুর বাড়িতে, ওঁর সামনে বসে। ওঁর নাতনি সাম্পান দুঃসংবাদটা দেয়। খবরটা শোনার পর শঙ্খবাবুর মুখ দেখে বুঝলাম, উনি আমার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি হতাশ। শঙ্খ ঘোষের যদি হতাশা আসে, আমার তো অবসাদে ডুবে মরে যাওয়া উচিত।

আরও পড়ুন, আই লাভ ইউ এখন টেম্পোরারি, বলছেন সোমরাজ

বাইরের জগত ছাড়াও লেখার জন্য মন খারাপ হয়?

হয় বৈকি। যখন বুঝতে পারি, যে-লেখা লিখতে চাই, সে-লেখা আসছে না। ফেসবুকে একটা লেখার নীচে দশ হাজার লাইক আর পাঁচশো শেয়ার হতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে তো আর বিচার হয় না, লেখকের নিজের মধ্যে লেখার চূড়ান্ত বিচারক থাকে। তার সামনে নিজের লেখাকে নিয়ে নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে হয় রোজ। আর তখনই বুঝতে পারি, হচ্ছে না। চল্লিশ হাজার শব্দের একটা উপন্যাস ছেপে বই হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাকে ঘিরে অপূর্ণতার বোধ কাজ করে।

শ্রীজাত-র উপন্যাস নাকি কবিতা লোকে কোনটা বেশি পড়ে?

উপন্যাস তো সবে লিখছি। তবে গত বারের উপন্যাস ‘তারা ভরা আকাশের নীচে’-র জন্য প্রচুর মানুষের ভাল লাগার কথা জেনেছি। আসলে কী জানেন? লেখার বিষয় আমার হাতে আছে। কিন্তু কাল যদি কেউ আমায় মেরে ফেলে তা আমার হাতে নেই। আমাকেও তো এক সময়ে দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরতে হয়েছে! আমি এক জন ছাপোষা লোক, সন্ধে হলে সেলিমপুরের মোড়ে দশ টাকার মুড়ি বরাদ্দ যার। তার পিছনেও একজন কোমরে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যাতে কেউ আমার কোনও ক্ষতি না করতে পারে। এর মধ্যে দিয়েও যেতে হয়েছে, একটা কবিতার জন্য।

আসলে ‘অভিশাপ’ পড়ে মানুষ খুব রিঅ্যাক্ট করেছিল...

ওই কবিতার চেয়ে কড়া লেখা আমার বইতে আছে। আসলে যারা খুনের হুমকি দেয় তারা কেউ বই পড়ে না। তা হলে অনেকেই অনেক আগে খুন হয়ে যেত! ‘অভিশাপ’ কবিতাটা ফেসবুকে দেওয়া। লোকে তো শুধু ফেসবুক পড়ে! এই পরিস্থিতি আর যাই হোক দুঃখ বিলাস নয়...বিষয়টা প্রায় লাশের দিকে চলে যাচ্ছিল...

নাহ! লাশ নয়, প্রাণের কথায় ফিরি। আমাদের প্রাণ কি ফেসবুকে আটকে?

তা কেন? পৃথিবীটা ফেসবুক নয়। এত বই ছাপা হচ্ছে। বইমেলায় আমি রোজ যাই বলে জানি, ভিড়ের জন্য অনেক স্টলের দরজা বন্ধ করে দিতে হয়। অনেক প্রকাশক চার-পাঁচ বছরেই বেস্ট সেলার বই প্রকাশ করছেন। এগুলো কী করে হচ্ছে?

লেখার মান কি পড়ে গিয়েছে?
আমার মতো লোক লিখতে এলে এ রকমটাই হবে!



‘আমি বাজারের চেয়ে কাজে অনেক বেশি বিশ্বাস করি।’


এই অতিরিক্ত বিনয় সেই অকারণ মনখারাপের মতোই যা শ্রীজাত-র সিগনেচার! প্লিজ বিনয় বাদ দিয়ে বলুন...

এখন এক ধরনের চল হয়েছে, বাজার দিয়ে শিল্পের মান নির্ধারণ করা, যা আসলে হাস্যকর। কোনও পরিচালককে তাঁর ছবির মান বিষয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি সোজা বক্স অফিস কালেকশন দেখিয়ে দিচ্ছেন। যেন ওইটাই শিল্পের শেষ কথা। কোনও লেখককে লেখার মান নিয়ে অভিযোগ করলে রয়্যালটির চেক তুলে ধরছেন, যেন তার পর আর কিছু বলার নেই। এই তো অবস্থা!

আপনি কি দেখান?

আমি বাজারের চেয়ে কাজে অনেক বেশি বিশ্বাস করি। তার সঙ্গে বাণিজ্যিক সাফল্যের কোনও বিরোধ নেই ঠিকই, কিন্তু কাজটা কাজের মতো হতে হবে।

আপনাকে দেখেছি পরিচিত বন্ধু আর অরিজিৎ সিংহ পাশাপাশি থাকলে আপনি দু’জনকেই সমান গুরুত্ব দেন!

সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? বন্ধুত্বও কি ইদানীং খ্যাতি দিয়ে বিচার করার বিষয় হয়ে উঠেছে নাকি? তা হলে আমি পিছিয়ে আছি। আমরা এখন স্বাভাবিকতা দেখলেই এত আপ্লুত হয়ে পড়ি যে, সেটাকে মহত্বের মর্যাদা দিয়ে ফেলি। কেউ ঘুষ না-খেলে তাঁকে সৎ বলে প্রশংসা করার মতো! কেননা, ঘুষ খাওয়াটাই এখন দস্তুর। ঔদ্ধত্য এখন এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে আমরা সাধারণ সৌজন্যকে বিনয় বলে ভুল করি।

এই সৌজন্য নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন কী করে?

না থাকারই বা কী আছে? সকলে আমাকে আমার মতো করেই ভালবাসেন। আজ অবধি টোনিদা’র একটামাত্র ছবিতে গান লিখেছি। কিন্তু ওঁর সঙ্গে বিলায়েত, রবিশংকর নিয়ে অন্তত একশোটা সন্ধে কাটিয়েছি। রিনাদি যখন আড্ডা দিতে ডাকেন ওঁর বাড়িতে, বা যিশু নীলাঞ্জনা রুদ্র’রা যখন আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসে, তখন কি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে মেলামেশা হয়? একেবারেই না। নিখাদ আড্ডাই হয় কেবল।

আরও পড়ুন, নচিকেতার গানটা কি আপনাকে নিয়ে লেখা? রাজশ্রী বললেন...

কিন্তু আপনার ইন্ডাস্ট্রি মানেই পুরুষ? নারী খানিক কম পড়ছে মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ এটা ঠিক। নারী একটু কম। শ্রেয়া আমার খুব ভাল বন্ধু, কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হয় কম। হলে অবশ্য ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে!

আচ্ছা, শ্রেয়া প্রসঙ্গ এলই যখন তখন জানতে চাই, আপনি যেমন শব্দের লোক তেমনই সুরেরও লোক। এই বিনোদনের দুনিয়ায় গানের স্থায়িত্ব আছে?

নিশ্চয়ই আছে। শ্রেয়া বা অরিজিতের গানের কথাই যদি ধরি, ওদের গান কিন্তু অনেক দিন থাকবে, মানুষ মনে রাখবেন ওদের কাজ। ছবির গান বলুন বা বেসিক গান, আজ কোনও ভাল কাজই হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। আপনি বলতে পারেন, এক জন সলিল চৌধুরী বা এক জন মদনমোহন কেন তৈরি হচ্ছেন না। তাঁরা নিঃসন্দেহে অপার্থিব সৃষ্টি রেখে গেছেন। আবার এখন যে-কাজ হচ্ছে, তার দৌড় বোঝা যাবে ভবিষ্যতে।

সময়ের প্রেক্ষিতে আপনি ও তো দেখছি বদলাচ্ছেন, আজকাল ফেসবুকে সুন্দরী মেয়েদের ছবির তলায় দিব্যি কমেন্ট করেন...

কাদের কথা বলছেন? ওহ! নাম বলাতে চাইছেন? ধরুন ঋতাভরী!

আপনি তো সৃজিতের মতো করছেন! পজেসিভ হয়ে যাচ্ছেন। ওহ! ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে। যাদবপুরে ও পড়ত যখন তখন থেকে আলাপ। আমি মনে করি ও পরের প্রজন্মের মেধাবী অভিনেত্রী। স্নেহ করি ওকে।

এই ইন্ডাস্ট্রিতে স্নেহ?

স্নেহ হয় না বুঝি? ইন্ডাস্ট্রি মানেই তার সব কিছু খারাপ, এমনটা নয়। আবেগের অনেকগুলো রং এখানে খেলা করে। যাদের ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি, তাদের সাফল্যে ভাল লাগা আসে। সাহানা (বাজপেয়ী) যখন হাউস অব কমন্সে এক জন বাঙালি গাইয়ে হিসেবে মঞ্চে ওঠে, আমার গর্ব হয়। এখন সেটাকে আপনি ‘ইন্ডাস্ট্রি ইকুয়েশন’ বলবেন কি না, তা আপনার ব্যাপার।

বলা হয় ‘কবিদের লাইনে অনেক প্রেম!’ আপনারও কী তাই?

তা হলে বলতে হয়, কবিদের দুটো লাইন আছে। আমি কর্ড লাইনে আছি, মেন লাইনে নেই।

আপনি এড়িয়ে গেলে চলবে না। শ্রীজাত মানেই মেসেজ আর হোয়াটস্অ্যাপে প্রেম! এর বেশি এগোন না...

কলকাতায় সৃজিত থাকতে আমরা আর কী প্রেমের খাতা খুলব, বলুন? তবে এই বিক্ষোভের পৃথিবীতে আর প্রেম আসে না আমার। তুমুল প্রেম যদি হয়, তবে তা শহরের সঙ্গে। এই তো, পরশুই আমার এক প্রেমিকার কাছে উড়ে যাব...এইটা ভেবেই ভাল লাগছে।

কফির কাপ শূন্য...

কাজের রাস্তায় ছুটলেন তিনি।

বড্ড তাড়া...

কালই তিনি এক শহরকে ফেলে চলে যাবেন আর এক শহরে...নাহ, শহর নয়, রোমাঞ্চের কাছে। ফ্লোরেন্সের গন্ধ মেখে ম্যানহ্যাটনের সকাল দেখবেন।

আর রাত?

আকাশে তার কোনও সাড়া নেই, কেবল তারায় তারায় বোবা অন্ধকারের চোখের জল।

ছবি: জি আর সোহেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Srijato Tollywood Celebrities celebrity interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE